বাসস ইউনিসেফ ফিচার-১ : নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য জীবন যুদ্ধে সফল সেলিনার উপদেশ ‘লেগে থেকে পরিশ্রম করে যেতে হবে’

245

বাসস ইউনিসেফ ফিচার-১
উদ্যোক্তা-সেলিনা
নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য জীবন যুদ্ধে সফল সেলিনার উপদেশ ‘লেগে থেকে পরিশ্রম করে যেতে হবে’
ঢাকা, ২১ মার্চ, ২০১৯ (বাসস) : শূন্য থেকে অনেকেই নিজের ভাগ্যবদলে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তবে কক্সবাজারের দ্বীপ উপজেলা কুতুবদিয়ার মেয়ে সেলিনা আক্তারের (নয়ন সেলিনা) লড়াইটা একটু ব্যতিক্রম।
বিয়ের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় স্বামী নিখোঁজ হয়ে যান। কিন্তু অন্যদিকে না তাকিয়ে দুই সন্তানকে নিয়ে জীবনযুদ্ধের লড়াইয়ে নেমে পড়েন তিনি। ২৪ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৯৫ সালে নিজের কানের দুল জোড়া বিক্রি করে মাত্র ১৭ হাজার টাকায় বেঁচে থাকার সংগ্রাম শুরু করেন সেলিনা। তখন ওই টাকায় ১০০টি মুরগির বাচ্চা কিনে ছোট্ট একটি কক্ষে গড়ে তোলেন পোলট্রি খামার। সেখান থেকে এখন তিনি কয়েক কোটি টাকা টাকার মালিক। তার বার্ষিক আয় এখন ছয় লাখ টাকার বেশি।
অসহায় একজন গৃহবধূ আজ কোটিপতি- বিষয়টি স্থানীয়দের মধ্যে অনুপ্রেরণার সৃষ্টি করেছে। তার ভাগ্যকে অনেকে ‘মিরাকল’ মনে করেন। তার দেখাদেখি এখন অনেকেই ওই এলাকায় পোল্ট্রি খামারসহ নানা ছোট-ছোট উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। তবে সেলিনা বললেন, মিরাকল নয়, ইচ্ছা থাকলেই যে উপায় হয়, সেটি আমি করে দেখিয়েছি, সৃষ্টিকর্তা আমায় সহযোগিতা করেছেন। এজন্য তার প্রতি কৃতজ্ঞ। ইচ্ছাশক্তি আর পরিশ্রম দিয়ে আজকের সেলিনা হয়েছি।
নিজের জীবনের কথা উল্লেখ করে তিনি জানান, নব্বই সালের গোড়ার দিকে এসএসসি পরীক্ষার পরপরই বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের তিন বছরের মাথায় কোলজুড়ে আসে দুইছেলে শাকিল আহমেদ শাওন ও সাজিদ আহমেদ মাওন। সংসারে স্বচ্ছলতা আনতে ১৯৯৫ সালে স্বামী পাড়ি জমান বিদেশে। কিন্তু এরপর তার আর কোনো খোঁজ মেলেনি।
সেলিনার ভাষায়, তখন ছোটছেলে মাওনের বয়স ছয় মাস। সম্বল বলতে ছিল আমার এক জোড়া কানের স্বর্ণের দুল। সেই দুল বিক্রি করে পাই ১৭ হাজার টাকা। ‘তখন ওই টাকা আর কিছু করার আশায় চলে আসি কক্সবাজার শহরে। শহরের ঝাউতলা গাড়ির মাঠ এলাকায় একটি টিনশেড বাসা ভাড়া নিই। ভাড়া এক হাজার ৪০০ টাকা, দুইটি কক্ষ। একটি কক্ষে ১০০টি মুরগির পোলট্রি খামার করি।’ তিনি বলেন, কয়েক মাসের মাথায় লাভ হতে শুরু করে। তখন পরিসর বাড়ানোর জন্য দুই বছরের মাথায় কর্মসংস্থান ব্যাংক থেকে ৪৫ হাজার টাকা ঋণ নিই। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।‘প্রথমে পরিবারের লোকজনই হাসি-ঠাট্টা করেছে। কিন্তু দমে যাইনি। আর পুঁজির পয়সা জোগাড় করতেও বেশ ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয়। কিন্তু এখন অনেকেই ঋণ দিতে আসে,’ যোগ করেন সেলিনা।
প্রথমে জীবন সংগ্রামের দিনগুলোর কথা বলতে গিয়ে কষ্ট ভিড় করে করে সেলিনার চোখে-মুখে। তবে ব্যবসার সাফল্যের দিনগুলোর বলার সময় যেনো বিরাজ করছিলো আনন্দের ঝিলিক।
জানালেন, ব্যবসা শুরুর সাত বছরের মাথায় আয়ের টাকায় পর্যটনশহর কক্সবাজারের দক্ষিণ কলাতলী এলাকায় ১৬ শতক জমি কেনেন। সেখানে তৈরি করেন একতলা বাড়ি। পাশে গড়ে তোলেন পোল্ট্রি খামার, নাম দেন বড় ছেলের নামে ‘শাওন পোল্ট্রি ফার্ম’।
তবে সেলিনা এখন পোল্ট্রির পাশাপাশি গরু-ছাগলের খামারও দিয়েছেন। নিজে খামার দেখাশোনা করেন, কয়েকজন কর্মীও কাজ করেন তার খামারে।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, খামারের এক পাশে মুরগির শেড, অপর পাশে গরু-ছাগলের খামার। উপরে কবুতরের ঘর। পরম মমতায় গবাদি পশুপাখির পরিচর্যা করেন সেলিনা। জানালেন, দৈনিক ২৪০ লিটার দুধ উৎপাদন হয় তার খামারে। আর প্রতিদিন তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার মুরগি ডিম পাড়ে। এগুলো স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে চট্টগ্রামের বেপারীদের কাছেও বিক্রি করা হয়।
এছাড়া কক্সবাজারের বড় বাজারে একটি শুঁটকির দোকান ও বাজারঘাটার কোরালরিফ মার্কেটে তার একটি মোবাইল ফোনের দোকান আছে।
সেলিনা বলেন, দোকান দুটি দেখাশোনা করেন তার ছোট ছেলে মাওন। কক্সবাজার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়েছেন তিনি। আর বড়ছেলে শাওন ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএসসি শেষ করেছেন।
কক্সবাজার শহর ছাড়াও আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় জমি কিনেছেন সেলিনা। শহরের বেসরকারি একটি হাসপাতালেও রয়েছে তার অংশীদারত্ব।
পাশাপাশি জনকল্যাণমূলক কাজও করে যাচ্ছেন সেলিনা। তার ব্যবসার আয়ের টাকা থেকে একটি এতিমখানা পরিচালনাসহ দরিদ্র নারীদের কল্যাণে কাজ করেন তিনি।
সেলিনা বলেন, ইচ্ছাশক্তির জোরে এ পর্যন্ত এসেছি। এক সময় কিছুই ছিলো না। বাপ-ভাইদের কাছ থেকে একবার খেলে আরেকবার পেতাম না। তবে এখন কোনো অভাব নাই। ছেলে দুটোও পড়াশোনা করছে।
সাফল্যের সূত্র হিসেবে তিনি বলেন, স্বামী নিখোঁজ হওয়ার পর অভাবের সংসারে দিশা হারাইনি। এই সংগ্রামে প্রতিবেশীদের বাঁকা বাঁকা কথাসহ নানা কষ্ট নীরবে সহ্য করাসহ যত ঝড়ঝাপটা এসেছে, তা মোকাবেলা করেছি।‘এর মধ্যে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সংস্থা থেকে প্রশিক্ষণও নিয়েছি। যা খুব কাজে দিয়েছে। এখন আগের কষ্ট আর কষ্ট মনে হয় না। নিজেকে বেশ গর্বিত মনে হয়।’
খামারি খাতে সফল একজন নারী উদ্যোক্তা হিসেবে বিভিন্ন সম্মাননাও পেয়েছেন সেলিনা। এরমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাস্ট্রিজের সম্মাননা উল্লেখযোগ্য।
গতবছরের সেপ্টেম্বরে সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে তার হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ।
কক্সবাজারের ব্যবসায়ী আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, সেলিনা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের একজন সদস্য, সফল একজন নারী উদ্যোক্তা। তার দেখাদেখি অনেকেই এখন নিজে কিছু করার প্রত্যয়ে এগিয়ে আসছেন।
নতুন উদ্যোক্তাদের বিষয়ে সেলিনার বক্তব্য হচ্ছে, লেগে থাকতে হবে। পরিশ্রম করে যেতে হবে। তিনি বলেন, নতুন উদ্যোক্তা কিংবা স্বামী পরিত্যক্তা নারীর আত্মনির্ভরশীলমূলক কোনো কাজ শুরু করার ক্ষেত্রে বড় বাধা অর্থ। কারণ তখন কোনো ব্যাংকও ঋণ দিতে চায় না। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আরো নমনীয় হওয়া উচিত।
বাসস/ইউনিসেফ ফিচার/কেটিকে/কেজিএ/১০০০/আহো/এসএইচ