মুক্তিযুদ্ধের বীরত্ব গাথা : উত্তাল মার্চে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল

5281

॥ হাসনাইন আহমেদ মুন্না ॥
ভোলা, ১৪ মার্চ, ২০১৯ (বাসস) : ১৯৭১ সালের উত্তাল মার্চের মাঝামাঝি সময়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল। সৈনিক মোস্তফা কামাল তখন ২৪ বছরের যুবক। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ১৮ এপ্রিল ব্রাম্মনবাড়িয়ায় পাকবাহিনীর সাথে সম্মুখ যুদ্ধে শাহীদ হন তিনি। সেদিন তিনি একাই লাড়াই করে বাঁচিয়ে দিয়েছেন সহযোদ্ধাদের প্রাণ।
মোস্তফা কামালের ভাইর ছেলে মো: সেলিম বাসস’কে বলেন, ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের ২দিন পর ২ মাসের ছুটিতে নিজ জেলা ভোলার দৌলতখান উপজেলার হাজিপুর গ্রামের বাড়িতে আসেন মোস্তফা কামাল। এটি ছিলো তার শেষ নিজ বাড়িতে আসা। মো: সেলিম বলেন, ২ মাসের ছুটি কাটিয়ে জানুয়ারিতে বাড়ি থেকে চলে যান মোস্তফা কামাল। মার্চের মাঝামাঝিতে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি। ঘরে তখন তার ৬ মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী পেয়ারা বেগম।
বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের মাতা মালেকা বেগম (৯৬) বাসস’র সঙ্গে আলাপকালে জানান, তার ছেলে মোস্তফা কামাল সেদিন তাকে বলেছিলেন, দেশের অবস্থা ভালোনা, পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে তিনি আর চাকুরি করবেন না। যে কোন সময় যুদ্ধ শুরু হতে পারে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কি বলেন বর্তমানে সেই অপেক্ষায় আছেন।
মালেকা বেগম আরো বলেন, ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার আগে মরিচ দিয়ে পান্তা খেয়েছেন তার ছেলে। পরে তার কপালে চুমু খেয়ে বলেন, চিন্তা করোনা মা, দেশ স্বাধীন করে তবেই ফিরব আবার। আমার জন্য দোয়া করো মা। এটাই ছিলো ছেলের সঙ্গে মায়ের শেষ কথা। বলেই কেঁদে উঠেন জাতির এ সেরা বীরের জননী। কিন্তু ছেলের আর ফিরে আসা হলোনা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জানলেন ছেলে শহীদ হয়েছেন।
বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের ছোট ভাই মোস্তাফিজুর রহমান বাসস’কে বলেন, ৭১ সালের জানুয়ারি মাসে যখন তার ভাই ছুটি কাটিয়ে বিদায় নেন তখন খুব চিন্তিত ছিলেন। ভাইর মুখে শুনেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবই আমাদের নেতা। তার চূড়ান্ত নির্দেশের অপেক্ষায় আছে পুরো বাঙালি জাতি। তিনি বলেন, মায়ের সঙ্গে যখন শেষ কথা হয় তখন বড় ভাইর ব্রিফকেস তার হাতে ছিলো। ভাইকে তিনি মূল রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসেন। ভাই তাকে ৩টাকা দিয়ে বলেন ভালোভাবে লেখাপড়া করিস। বুঝতে পারেননি ভাইর সাথে আর দেখা হবেনা।
জানা যায়, ১৯৪৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভোলা জেলার দৌলতখান উপজেলার হাজিপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মোস্তফা কামাল। পিতা হাবিলদার মো: হাবিবুর রহমান ও মাতা মালেকা বেগম। ৫ ভাই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। তাঁর স্ত্রীর নাম ছিলো পিয়ারা বেগম। ছোট বেলা থেকেই স্কুলের পড়ার চেয়ে ভালো লাগত সৈনিকদের কুচকাওয়াজ। নিজেও স্বপ্ন দেখেন সৈনিক হওয়ার। ১৯৬৭ সালে কাউকে কিছু না বলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। ক্রমশই স্বাধীনতার দাবিতে সারা দেশ উত্তাল হতে থাকে। ৭মার্চ জাতির পিতার ঐতিহাসিক ভাষণ শুনে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন বীরদর্পে মোস্তফা কামাল।
১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল সিপাহী মোস্তফা কামালের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে এগিয়ে আসা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে ঠেকানোর জন্য আখাউড়ার দরুইন গ্রামে অবস্থান নেয়। ১৮ এপ্রিল বেলা ১১টার দিকে শুরু হয় মুষলধারে বৃষ্টি। একইসাথে শত্রুর গোলাবর্ষণ। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা গুলি করতেই শুরু হয় সম্মুখ যুদ্ধ। মেশিনগান চালানো অবস্থায় এক মুক্তিযোদ্ধার বুকে গুলি লাগতেই। মুহূর্তের মধ্যে মোস্তফা কামাল এগিয়ে এসে চালাতে লাগলেন মেশিনগান।
মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আধুনিক অস্ত্র ছিলোনা। সংখায়ও কম ছিলো তারা। আর পাকিস্তানি সৈন্যরা সংখায় ছিলো বেশি। ভারি অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত তারা। হয় সামনা সামনি যুদ্ধ করে মরতে হবে, নয় পিছু হটতে হবে। কিন্তু পিছু হটতে হলেও সময় দরকার। ততক্ষণ অবিরাম গুলি চালিয়ে শত্রুদের আটকিয়ে রাখতে হবে। কে নেবে এ মহান দায়িত্ব?
এমন সময় আরো একজন মুক্তিযোদ্ধার বুকে গুলি বিধে। ততক্ষণে মোস্তফা কামাল সকল সহযোদ্ধাদের সরে যেতে বল্লেন। পরিখার মধ্যে সোজা হয়ে চালাতে লাগলেন স্টেনগান। মুক্তিযোদ্ধারা তাকে ছেড়ে যেতে না চাইলে তিনি আবারো সবাইকে নিরাপদে যেতে বলেন। অবিরাম গুলি চালাতে থাকেন তিনি। তার গোলাবর্ষণে শত্রুদের থামকে যেতে হয়েছে। নিহত হয়েছে বেশ কয়েকজন পাক সৈন্য। ততক্ষণে দলের অন্য সদস্যরা সাবধানে পিছু হটেছেন। একসময় মোস্তফা কামালের গুলি শেষ হয়ে যায়। হঠাৎ করেই একটি গুলি লাগে তার বুকে। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। তার এমন বীরত্বের কারণে সহযোদ্ধাদের প্রাণ রক্ষা পেয়েছে। দরুইনের মাটিতে সমাহিত করা হয় জাতির এ শ্রেষ্ঠ সন্তানকে। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য বীরত্বে জন্য ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাবে ভূষিত করা হয় মোস্তফা কামালকে।