বাজিস-১ : নাটোরে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির সুফল পেতে শুরু করেছেন নারী ও শিশুরা

281

বাজিস-১
নাটোর-নারী ও শিশুরা
নাটোরে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির সুফল পেতে শুরু করেছেন নারী ও শিশুরা
॥ ফারাজী আহম্মদ রফিক বাবন ॥
নাটোর, ৯ মার্চ, ২০১৯ (বাসস) : জেলার বড়াইগ্রাম উপজেলার কালিকাপুর এলাকার মুদীদোকান ব্যবসায়ী আতাউর রহমানের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল সদর উপজেলার আমহাটি গ্রামের হাস্না খাতুনের। এক দশকের বিবাহিত সম্পর্কের সমাপ্তি হয় গত বছরের ২৬ নভেম্বর স্বামীর তালাকের মাধ্যমে। চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ুয়া অসহায় কন্যা ইকফাকে নিয়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হাস্না ৯ জানুয়ারি আসেন লিগ্যাল এইড অফিসে। পারিবারিক কলহের বিবরণ শুনে অফিস থেকে ঐদিনই নোটিশ যায় স্বামী আতাউরের কাছে। ৪ ফেব্রুয়ারি লিগ্যাল এইড অফিসে সিনিয়র সহকারী জজ ও জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার মোঃ মতিউর রহমানের মধ্যস্থতায় বাদী, বিবাদী ও এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে বসে মীমাংসা বৈঠক। বৈঠকে বাদী হাস্না খাতুন অভিযোগ করেন, স্ত্রীর নামে স্বামী বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে সময়মত কিস্তি শোধ করছিলেন না আর তাগাদা দিলে শিকার হতে হচ্ছিল শারীরিক নির্যাতনের। দীর্ঘদিনের এ পারিবারিক কলহ চূড়ান্ত পরিণতি পায় তালাকে। লিগ্যাল এইড অফিসারের উদ্বুদ্ধকরণমূলক বলিষ্ঠ ভূমিকার কারণে সাবেক স্বামী আতাউর ভূল বুঝতে পারেন। সকল ঋণ পরিশোধ এবং স্ত্রীকে নির্যাতন না করার অঙ্গীকার প্রদান করে আবারো স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবন শুরু করার শর্তনামায় সজ্ঞানে স্বাক্ষর করে স্ত্রী-কন্যাকে সাথে নিয়ে বাড়ি ফিরে যান।
একইভাবে লিগ্যাল এইড অফিসের মীমাংসা বৈঠকে তালাকের পরে নির্ধারিত ৯০ দিন অতিক্রম করার প্রেক্ষাপটে আবারো বিয়ে রেজিষ্ট্রির মাধ্যমে ২২ বছরের দাম্পত্য সম্পর্ক জোড়া লেগেছে সিংড়া এলাকার কৃষক সেকেন্দার আলী ও গ্রহবধূ মাছুরা বিবি মেনেকার।
নাটোর সদর উপজেলার আউড়াইল গ্রামের হযরত আলীর উচ্চ শিক্ষিত মেয়ে মুসলিমা খাতুনের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল বিপ্রহালসা গ্রামের আব্দুল কাদের মোল্লার ছেলে আমীর হোসেনের। সংসার আলো করে জন্ম নেয় কন্যা মনিকা। কিন্তু পারিবারিক কলহে ব্যর্থ হয় দাম্পত্য সম্পর্ক। রাগী জেদী আমীর হোসেন তাঁর তিন বছরের কন্যা মনিকাকে রেখে দেন নিজের কাছে। অসহায় মা শিশু কন্যাকে নিজের হেফাজতে নিতে শরণাপন্ন হন লিগ্যাল এইড অফিসের। গত বছরের ২৪ অক্টোবর আবেদনের একদিনের মাথায় ফিরে পান কন্যাকে। বাবার কাছ থেকে ব্যবস্থা কন্যার খোরপোসের।
এমনি সব সাফল্য গাঁথা তৈরিতে ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার নাটোর জেলা কার্যালয়। বর্তমানে আরো আটটি পারিবারিক বিরোধ উভয় পক্ষের সম্মতিতে আদালতে না পাঠিয়ে বিকল্প বিরোধ নিষ্পতির মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা চলছে।
১৯৯৪ সালে বাৎসরিক এক লাখ টাকার কম উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের জন্যে বিনামূল্যে আইনগত সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের অধীন জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার কার্যক্রম শুরু হলেও ২০১৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। ঐ বছরের জুলাই থেকে শুরু হয় বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির কার্যক্রম। এ কার্যক্রমের ব্যাপক প্রচারণার জন্যে ২০১৭ সালের ২৮ এপ্রিল জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস পালন উপলক্ষে দিবসটির মূলভাব নির্ধারণ করা হয়- ‘বিরোধ হলে শুধু মামলা নয়, লিগ্যাল এইড অফিসে আপসও হয়’। শুধু আর্থিক অস্বচ্ছল ব্যক্তিই নয় বরং স্বচ্ছল ব্যক্তিরাও এই অফিসের মাধ্যমে তাদের দেওয়ানী ও ফৌজদারী সংক্রান্ত যে কোন বিরোধের নিষ্পত্তি করতে পারেন।
জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার মাধ্যমে ২২ বছরের সংসার ফিরে পাওয়া গৃহবধূ মাছুরা বিবি মেনেকা বলেন, তালাকের কারণে একমাত্র ছেলের পড়াশোনায় ছন্দপতন এসেছিল, এখন ছেলের পড়াশোনা অব্যাহত থাকবে। লিগ্যাল এইড অফিস আমাকে সচেতনতা দিয়েছে, আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি, সংসারে শান্তি ফিরে এসেছে-এমনই অভিব্যক্তি বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি কার্যক্রমের বিবাদী আতাউর রহমানের।
ছাতনী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হোসেন সরকার বলেন, আমার এলাকার পারিবারিক কলহের মীমাংসা করে দিয়েছে লিগ্যাল এইড অফিস। এ সেবা নিতে এখন বিবাদমান পক্ষগুলোকে লিগ্যাল এইড অফিসে পাঠাবো।
সিনিয়র সহকারী জজ ও জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার মোঃ মতিউর রহমান জানান, স্বল্প সময়ে বিনা খরচে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির চেয়ে ভালো কোন ব্যবস্থা নেই। মামলার বিকল্প হিসেবে এ কার্যক্রমের মাধ্যমে মামলার দীর্ঘসূত্রিতা ও হয়রানি এবং শত্রুভাবাপন্ন অবস্থা থেকে উভয় পক্ষের নিষ্কৃতি ঘটে। ভবিষ্যতে এ কার্যক্রমের পরিধি বৃদ্ধির জন্যে তৎপরতা অব্যাহত থাকবে।
জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা নাটোর জেলা কমিটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এবং ভারপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মোঃ সাইফুর রহমান সিদ্দিক বলেন, সারাদেশের বিভিন্ন পর্যায়ের আদালতে প্রায় ৩২ লাখ মামলা চলমান আছে। বিবাদমান পক্ষগুলোর বিরোধ মীমাংসার জন্যে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি কার্যক্রমের পরিধি সম্প্রসারণ করতে পারলে তা হবে সামাজিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্যে বিরাট এক অগ্রগতি। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে কেউ পরাজিত হয়না, আপোসের মাধ্যমে বিবাদমান উভয়পক্ষই জয়ী হয়। এ জয় মানবতার।
বাসস/সংবাদদাতা/১০৫৫/বেউ/-নূসী