জোসনার দিন বদলের চেষ্টা

2137

ঢাকা, ৩ মার্চ, ২০১৯ (বাসস) : বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যেখানে এক সময় সমাজ ব্যবস্থায় সনাতনী ধ্যান-ধারণা, মূল্যবোধে ও লিঙ্গ বৈষম্য ছিল প্রকট। বর্তমানে সেই ধ্যান-ধারণা তথা দৃষ্টি ভঙ্গীতে এসেছে অনেক পরিবর্তন। তারপরও গ্রামের লোকজনের মধ্যে এখনো সেকেলে চিন্তাধারা বিরাজমান। পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা এবং শিক্ষার অভাবে এত দিন পিছিয়ে থাকলেও বর্তমানে গ্রামে বসবাসরত নারীরা সেই অচলায়তন ভেঙ্গে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে এগিয়ে আসছে। বিশেষ করে গত দশ বছরে এমন কোন ক্ষেত্র নেই যেখানে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন এবং অগ্রগতি আজ বিশ্বে প্রশংসিত। নারীর ক্ষমতায়ন একটি দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও লিঙ্গ সমতার প্রতিফলক। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের কাছ থেকে বিশ্বের বেশ কিছু শেখার আছে। বর্তমান সরকার লিঙ্গ সমতা এবং নারীর ক্ষমতায়নের জন্য এমডিজি ২০১৫ অর্জন ও নারীর প্রতি সকল বৈষম্য বিলোপ (সিডও) এর বিভিন্ন ধারা বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে এমডিজি ৩ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। তার প্রতিফলন হলোÑ বাংলাদেশের গ্রামীণ অনগ্রসর নারীদের ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ।
দেশের উত্তরাঞ্চলীয় জেলা দিনাজপুর। এক সময় উত্তর বঙ্গকে দেশের সবচেয়ে দরিদ্র অঞ্চল বলা হলেও এখন চিত্র পুরোটাই উল্টো। এখন সংসারে নারী-পুরুষ সমানভাবে অর্জন করে । আবার কখনো কখনো নারীরাই চালাচ্ছেন সংসার। দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলার একইর গ্রামের নারীদের কাছে একটি প্রেরণার নাম হলেন জোসনা আরা (৪৪)। সংসারের কাজের পাশাপাশি অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তিনি নিজেও সংসারের ব্যয় নির্বাহে ভূমিকা রাখছেন। তিনি বলেন, ‘মোর জামাই যা টাকা কামায় ওলা দিয়ে হামার সংসার চলে না। দুই বেটা-বেটির খিলানোর ভার হামার উপরি’। জোসনা এক ছেলে ও এক মেয়ের জননী। বিয়ের পর থেকেই তার অভাবের সংসার। স্বামী বুদা মাঠে কাজ করে যে আয় রোজগার করতেন তা দিয়ে বেশ টানাপোড়নের মধ্যেই সংসার চলতো তাদের। তিনি কখনও শিক্ষার আলোয় আলোকিত হতে পারেননি। কিন্তু তিনি নিজের ছেলে মেয়েকে এই আলো থেকে বঞ্ছিত হতে দিতে চাননি। তাই তিনি তার ছেলে এবং মেয়ে দুজনকেই স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন। স্কুলে ভর্তি করানোর পর তাদের অভাবের মাত্রা আরও বেড়ে গিয়েছিল। পরবর্তীতে তিনি সিদ্ধান্ত নেন ঘরের গন্ডি থেকে বের হয়ে তিনি নিজেও সংসারের হাল ধরবেন। তাই তিনি স্থানীয় এক ফার্মে গরু পরিচর্যার কাজ নেন যেখানে তিনি পারিশ্রমিক হিসেবে মাসিক তিন হাজার টাকা পেতেন। এই টাকার পুরোটা তিনি সংসারের ব্যয় নির্বাহে খরচ করতেন না। জোসনা বললেন, ‘জিলা টাকা মুই কামাছুনু ওলাত্তে কিছু সংসারোতও দিছিনু। বাকি যা টাকা আছলো ওলা জমে থুয়ে দিছিনু। কারণ মোর মনোত্ত আছোলো নিজে নিজে কেছু এটা করার’। যখন তার কাছে জমানো মোটামোটি ১৫ হাজার টাকার মত হয় তখন তিনি যে ফার্মে কাজ করতেন তার মালিকের কাছে তার পরিকল্পনার কথা বলেন এবং আর্থিক সহায়তা চান। পরবর্তীতে ফার্মের মালিক তাকে আরও ২০ হাজার টাকা ঋণ দেন। এই ঋণের টাকা আর তার সঞ্চয় করা টাকা দিয়ে তিনি একটি উন্নত জাতের গাভী কিনেন এবং এভাবেই একটি গাভী দিয়ে তিনি তার স্বাবলম্বী হওয়ার যাত্রা শুরু করেন। এই গরুর দুধ স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে তিনি মাসে আরও কিছু আয় রোজগার করা শুরু করলেন। গরু কেনার দুই বছরের মাথায় তিনি যে ফার্ম থেকে ঋণ নেন তা তিনি পরিশোধ করে ফেলেন। ইতিমধ্যে তার বাড়িতে গরুর সংখ্যা দাঁড়িয়ে যায় দু’টিতে।
এখানেই তার স্বাবলম্বী হওয়ার যাত্রা শেষ হয়নি। তিনি বললেন, ‘ঋণ শোধ করার পর মুই ফার্মেত কাজ করা ছাড়ে দিছিনু। মর জামাই জি টাকা কামাসোলো আর মুই দুধ থিকে জি টাকা পাছুনু ওলা দিয়ে হামার সংসার ভাল চলছোলো। এই বছর মুই এনা এনা করে টাকা জমে ফির ৫০ হাজার টাকা দিয়ে একটা ফ্রিজিয়ান জাতের বকনা কিনি। তার সাথে হামার বাড়িত ৬০টা রাজ হাঁস আর ৩০টা মুরগি পালি’। তিনি এই মুরগি ও রাজ হাঁসের ডিম এবং গরুর দুধ বাজারে বিক্রি করে বর্তমানে মাসে ১৫ হাজার থেকে ১৬ হাজার টাকা আয় করেন।
জোসনা খুব বিচক্ষণতা এবং সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে মাত্র চার বছরেরও কম সময়ে সাফল্য পেয়েছেন। তার স্বামী এবং তার আয় রোজগারে তাদের সংসার এখন ভালোভাবেই চলছে। বসত বাািড়টি করেছেন পাকা। কথায় আছে যে রাধে, সে চুলও বাঁধে! একটা সময় পর্যন্ত এ প্রবাদটা সত্যি হলেও কালের পরিক্রমায় নারীরা এখন শুধু রেঁধে কিংবা চুল বেঁধে নয়, তারা পুরুষের সাথে সংসারের হাল ধরে নিজের অবস্থার পরিবর্তন করেছেন। তার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ হলেন জোসনা।