বাজিস-৩ : ময়ূর নদীর বুকে সব হারিয়েও খুশি শাহাবুদ্দিন

188

বাজিস-৩
খুলনা-ময়ূর নদী
ময়ূর নদীর বুকে সব হারিয়েও খুশি শাহাবুদ্দিন
খুলনা, ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ (বাসস) : গল্লামারি এলাকার মাংস ব্যবসায়ী শাহাবুদ্দিন। দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে ময়ূর নদীর পাড় দখল করে ব্রিজের কোনায় বসে ব্যবসা করে আসছেন। ময়ূর নদী খননে প্রায় ৫ কোটি টাকার কাজ হলেও বেদখল হয়ে যাওয়া নদী তীরের দু’পাড়ে সাবেক মেয়র মো. মনিরুজ্জামান মনি সাহস করে উচ্ছেদ অভিযানে হাত দেয়নি।
তবে এত বছর পর বর্তমান মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক ও জেলা প্রসাশক মো. হেলাল হোসেন ময়ূর নদীর প্রাণ ফিরিয়ে দিতে নদীর পাড় অবৈধ দখল উচ্ছেদ করতে যে অভিযান করেছেন তাতে শাহাবুদ্দিন সর্বস্ব হারিয়ে এখন পথে বসেছে। তবুও শাহাবুদ্দিনের দুঃখ নেই। কারণ শাহাবুদ্দিন এর থেকেও বড় বড় রাঘব বোয়ালেরা ময়ূর নদীর ভেতর পর্যন্ত দখল করে বসে ছিল।
একদিকে ময়ূর নদী নাব্যতা হারাচ্ছিল। আরেকদিকে পঁচা দুর্গন্ধে মানুষ চলতে পারছিল না। এখন ময়ূর নদী তার সৌন্দর্য ফিরে পাচ্ছে। এজন্য সর্বোচ্চ হারিয়েও খুশি শাহাবুদ্দিন। তবে শাহাবুদ্দিনের মত শত শত ব্যবসায়ীর একটাই আবেদন এখন যেভাবে উচ্ছেদ অভিযান চলছে, এ অভিযান যেন কিছু দিন পর নিরব না হয়ে যায়। আবার যেন এ সৌন্দর্য হারিয়ে না যায়। শাহাবুদ্দিনের মতো এখানকার অনেক ব্যবসায়ীদের একটাই দাবি। তাদের পুনর্বাসন যেন বর্তমান মেয়র করেন।
খুলনার ময়ূর নদী দখল করে নির্মিত বেশকিছু অবৈধ স্থাপনা ও মার্কেট গুঁড়িয়ে দিয়েছে জেলা প্রশাসন ও সিটি কর্পোরেশন। ৬ তারিখ মঙ্গলবার খুলনার জেলা প্রশাসক মো. হেলাল হোসেন ও মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেকের নেতৃত্বে উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়। সকাল ১১টা থেকে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত চলা অভিযানে গল্লামারী সেতুর পাশে নদী ভরাট করে তৈরি করা মার্কেট বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, কেসিসি ও পুলিশ কর্মকর্তারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
এ সময় নদীর ওপর তৈরি তিনটি মার্কেট, দেড় ডজন সেমিপাকা ঘর ভেঙে ফেলা হয়। নদীর ভেতরে বালু দিয়ে ভরাট করা অংশটুকুও উচ্ছেদ করা হয়। অনিয়ম আর তদারকির অভাবে এত দিন খুলনার অতি গুরুত্বপূর্ণ ময়ূর নদী খননে কোনো কাজে আসেনি। নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনের লক্ষ্যে নদী খননে ব্যয় প্রায় ছয় কোটি টাকা বিফলেই গেছে। বর্তমানে নদীর পানিতে কোনো প্রবাহ নেই। একটু ভারী বৃষ্টি হলেই নগরীতে ভয়াবহ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। নদী ভরে উঠেছে ময়লা-আবর্জনা আর কচুরিপানার স্তুপে। দেখা দিচ্ছে কালো, নোংরা আর দুর্গন্ধযুক্ত পানি। আবার ফিরে এসেছে পূর্বের চেহারায়। এছাড়া কোথাও কোথাও নদীর দু’পাশে অবৈধভাবে দখল হয়ে আছে। ৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে মাত্র দেড় বছর আগে খনন শেষ হওয়া ময়ূর নদীর বর্তমান অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে। নদীর এ অবস্থা দেখে ক্ষুব্ধ খুলনার সাধারণ মানুষ।
নগরবাসীর অভিযোগ, ময়ূর নদী খননে ব্যয় হওয়া সব টাকাই বিফলে গেছে। অনিয়ম আর খনন পদ্ধতি সঠিকভাবে না হওয়ায় কাজের কাজ কিছুই হয়নি। যে উদ্দেশ্যে খনন করা তা’ ভেস্তে গেছে।
এ বিষয়ে খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির মহাসচিব শেখ আশরাফ উজ জামান বাসসকে বলেন, খুলনার মূল সমস্যা জলাবদ্ধতা আর এ জলাবদ্ধতার মূল কারণ খুলনার প্রবাহমান ২২ টি খাল দখলদারদের হাতে দখল হয়ে যাওয়ায় বাড়ছে জলাবদ্ধতা।
এ খালগুলো দখলমুক্ত করা ছিল আমাদের একমাত্র দাবি। আর এ দাবিটি বাস্তবায়ন করছেন খুলনার মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক এবং জেলা প্রশাসক মো. হেলাল হোসেন। আমরা এটাকে সাধুবাদ জানাই। তবে দখল অভিযান যেন চলমান থাকে এবং পরবর্তীতে কেউ যেন আবার দখল করতে না পারে, সেজন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া ফুটপাতে যে সকল হকার রয়েছে তাদের পুনর্বাসনের দিক বিবেচনা করতে হবে বলে জানান এ নাগরিক নেতা।
জেলা প্রশাসক মো. হেলাল হোসেন বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এ অভিযান শুরু হয়েছে। নদী ও খালের ওপর তৈরি সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে। তিনি আরও বলেন, খুলনা মহানগরীকে বাসযোগ্য করার জন্য ময়ূর নদী ও ২২টি খালের পুরাতন প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে হবে। এ কাজে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা সর্বাত্মক সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছেন। ইতিমধ্যে আমরা তিনটি কমিটি গঠন করেছি। কমিটি রিপোর্ট দিলেই পুরোদমে উচ্ছেদ অভিযান শুরু হবে।
উল্লেখ্য যে, দীর্ঘদিন খননের অভাবে খুলনার ময়ূর ও হাতিয়া নদী ভরাট হয়ে যায়। ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই নগরীতে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ায় নগরবাসীর দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এছাড়া নগরীর গুরুত্বপূর্ণ ২৬টি ড্রেনের মুখ ময়ূর নদীর সঙ্গে মিলিত হওয়ায় নদীটি খনন করলে নগরীর জলাবদ্ধতা অনেকাংশে নিরসন করা সম্ভব হবে।
এ উদ্দেশ্যেই নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে কেসিসির সিআরডিপির (নগর উন্নয়ন প্রকল্প) আওতায় ময়ূর নদীর ৫ হাজার ৯শ’ মিটার অর্থাৎ প্রায় ৬ কিলোমিটার খননের উদ্যোগ নেয়া হয়। এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে এ খনন কাজের ব্যয় ধরা হয় ৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে কেসিসির তৎকালীন মেয়র মনিরুজ্জামান মনি নদীর খনন কাজের উদ্বোধন করেন। কাজটি শেষ হয় ২০১৪ সালের ১০ নভেম্বর। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স জামিল ইকবাল (জেভি) প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে। এরপর গত বছরের আগস্ট মাসে ঠিকাদারকে চূড়ান্ত বিল পরিশোধ করা হয়।
খুলনা সিটি কর্পোরেশনের এষ্টেট অফিসার নুরুজ্জামান তালুকদার বলেন, বর্তমান মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক এর আগে যখন মেয়র ছিলেন, তখন ময়ূর নদীর পাড় গুলো দখল করে যারা মাছ ধরাসহ বিভিন্ন ব্যবসার জন্য ঘের দিয়ে রেখেছিল ময়ূর নদীতে, তা তিনি উচ্ছেদ করেছিলেন। পরবর্তী মেয়র মনিরুজ্জামানের আমলে আমরা কোন উচ্ছেদ অভিযান করতে পারিনি। তবে বর্তমান মেয়র আবার উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেছেন।
চারটি টিম বর্তমানে খুলনার ২২ খাল উদ্ধারের জন্য কাজ করছেন। এখানে সরকারি সার্ভেয়ারসহ বিভিন্ন প্রশাসনের লোক রয়েছেন। যারা আগামী ১৫ দিনের মধ্যে এ প্রতিবেদন জমা দিবেন। এরপরে আবার আমাদের এ উচ্ছেদ অভিযান শুরু হবে বলে জানান তিনি।
বাসস/জেডএইচ/আহো/১৩২০/নূসী