সন্তান যতদিন ভালো-মন্দের পার্থক্য বুঝতে না পারবে- ততদিন তার প্রতি তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে

1371

ঢাকা, ২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ (বাসস) : চৌদ্দ বছর বয়সী সাইম এবারই ক্লাস নাইনে ভর্তি হল। বরাবরই ভালো ছাত্র ছিল সে। কিন্তু ক্লাস নাইনে উঠার পর থেকেই তার আচার আচরণে কেমন যেন পরিবর্তন দেখা দিচ্ছিল। বিষয়টি বাবা-মা দু’জনেই বুঝতে পারলেও শুরুতে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। ভেবেছিল ছেলে বড় হচ্ছে, তাই হয়ত একটু রিজার্ভ থাকতে চাইছে।
সাইম বাসায় যতক্ষণ থাকতো, খুব কম কথাই বলতো অন্যদের সাথে। স্কুল থেকে এসেই সোজা নিজের রুমে ঢুকে যেত। আবার সন্ধ্যায় বের হয়ে যেত। প্রথম কয়েকদিন ঘন্টা খানেকের মধ্যে বাসায় চলে আসলেও এরপর রাত ৮টা/৯টার আগে বাসায় আসত না। এমনভাবেই চলছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন অভিভাবকদের ডাক আসে সাইমের স্কুল থেকে। পরদিনই দু’জনই হাজির হন স্কুলে। সেখানে স্কুলের হেড মাস্টারের কথা শুনে যেন তাদের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। স্কুলের হেড মাস্টার জানান, সাইম প্রায় দিনই স্কুলে অনুপস্থিত থাকে। ক্লাস শিক্ষক জানান, সাপ্তাহিক পরীক্ষার সব কটিতেই তার মার্কস একেবারে কম।
বাসায় ফিরেই প্রথমে সাইমের রুমে ঢুকে সব কিছু ভালো করে দেখলেন তারা। পেলেন বেশ কয়েকটি সিগারেটের প্যাকেট। আর ফেনসিডিলের তিনটি খালি বোতল। তাদের আর বুঝতে বাকি রইল না যে, তাদের আদরের সন্তান মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েছে।
বাবা-মার বড় আদরের সন্তান রুপা। বড় চার ভাইয়েরও খুব আদরের একমাত্র বোন সে। স্কুল পাশ করে এবার কলেজে উঠেছে। ভাইদের সাথে বয়সের ব্যবধান একটু বেশিই। চার ভাইয়ের মধ্যে তিনজন বিয়ে করে সংসারও করছেন। আর একজন করছেন চাকরি। সবাই এক সাথেই থাকেন। কিন্তু এর মধ্যেই রুপার মধ্যে একটা পরিবর্তন দেখা যায়। খুব চঞ্চল আর ভাইদের সাথে সারাক্ষণ ঝগড়া করা মেয়েটি কেন যেন হঠাৎ একেবারে চুপচাপ হয়ে যায়। বাসায় যতক্ষণ থাকে সারাক্ষণই রুমের দরজা বন্ধ করে বসে থাকে। কেমন যেন শুকিয়েও যাচ্ছে মেয়েটি।
একদিন রুপার সেজ ভাই তেজগাঁও গেলেন অফিসের কাজে। সেখানে তিনি দেখলেন রুপা বেশ কয়েকজন বন্ধুর সাথে একটি গলিতে আড্ডা দিচ্ছে। বিষয়টি কেমন লাগল তার। কারণ, এখন রুপার থাকার কথা ছিল কলেজে। আর রুপার কলেজও এখানে না, মিরপুরে। আবার বন্ধুদের চেহারা দেখেও ভালো লাগল না। তিনি দূরে দাঁিড়য়ে দেখলেন রুপা কি করে। হঠাৎ দেখলেন কী একটা প্যাকেট নিয়েই সে তাড়াতাড়ি ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলছে। আবার বেশ কিছু টাকা বের করে দিচ্ছে।
রুপার সাথে কথা না বলেই তিনি কাজে চলে গেলেন। সন্ধ্যায় বাসায় এসে দেখেন রুপা আবার বেড়িয়েছে। তখন তিনি রুপার রুমে গিয়ে পড়ার টেবিলের ড্রয়ার খুলে দেখলেন ওই প্যাকট। খুলে দেখেন, সেখানে গাঁজা। বুঝতে বাকি থাকলো না যে রুপা কেন দিন দিন এমন আচরণ করছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে সন্তানের শারীরিক আর মানসিক বিকাশে বাবা-মায়ের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। সব বাবা-মা’ই চান তাদের সন্তান যেন সুস্থ ভাবে বেড়ে উঠে এবং তাদের মঙ্গল হয়। কিন্তু তাদের অজান্তেই কোন কোন সন্তান বিপথে চলে যায়। হয়ে যায় মাদকাসক্ত। মূলত সন্তান যখন ছোট থাকে তখন বাবা-মায়ের চিন্তা-ভাবনা থকে সন্তানের স্বাস্থ্য এবং যতœ-আত্তির দিকে। কিন্তু সেই সন্তান যখন বড় হয় তখন সেই সন্তানকে নিয়ে চিন্তা-ভাবনার পরিধিও বাড়তে থাকে। স্বাস্থ্য এবং পড়ালেখার পাশাপাশি বাবা-মাকে সন্তানের বন্ধু, স্কুল, খেলা সবকিছু নিয়েই ভাবতে হয়। স্কুলে কাদের সঙ্গে মিশছে? বন্ধুরা কেমন? স্কুলের বাইরে কোন বন্ধু আছে কিনা? যদি থাকে, তবে তারা কেমন? পাড়ার বন্ধুরা কেমন? বন্ধুদের মধ্যে কেউ নেশা করে কিনা? অথবা তাদের সন্তান নেশার খপ্পড়ে পড়লো কিনা? সবদিকেই নজর রাখতে হয় বাবা-মাকে।
মনোবিজ্ঞানী ডা. সাইদুর রহমান সোহাগ বলেন, সন্তান বড় হওয়ার সাথে সাথে আমরা অনেক বিষয় এড়িয়ে চলি। কিন্তু ভালো বাবা-মা হতে হলে সন্তান যতদিন বুঝতে না পারবে- কোনটাতে তার ভালো আর কোনটাতে তার খারাপ ততদিন সন্তানের প্রতি তীক্ষè নজর রাখতে হবে । তিনি বলেন, আমরা অনেক সময় সন্তানের কথা গুরুত্ব দিয়ে শুনি না। এতে তাদের মনে এক ধরনের দাগ লেগে যায়। প্রতিটি বাবা-মার উচিত সন্তানের সব কথা গুরুত্ব দিয়ে শোনা। সন্তানের সাথে যত বেশি সময় কাটানো যায় ততই ভালো। তারপরও যতক্ষণ তার সাথে থাকা যায় ততক্ষণই তার সাথে কথা বলুন। তার ইচ্ছে-অনিচ্ছে, তার বন্ধু-বান্ধবদের খবর, টিচারের খবর, তার ভালো মন্দলাগা ইত্যাদি সব বিষয় নিয়ে কথা বলুন।
ডা. সোহাগ বলেন, সন্তানকে যে আপনি ভালোবাসেন তা সরাসরি প্রকাশ করুন। এতে সন্তান বাবা-মার প্রতি আরো বেশি নির্ভরশীল হবে এবং সব বিষয় তাদের সাথে শেয়ার করবে।
তার মতে সন্তানের সামনে কখনোই কোন অপরাধকে প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। এজন্য কেউ যদি অপরাধ বা অন্যায় করে থাকে তবে তার পক্ষ নেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। এছাড়া বাবা-মা নিজেরা যেন সন্তানের সামনে কোন মিথ্যে কথা না বলে। সন্তানকেও বুঝাতে হবে সে যেন মিথ্যে কথা না বলে।
এছাড়া সন্তানের কোন ব্যর্থতার সমালোচনা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেন ডা. সোহাগ। তার মতে সন্তান ব্যর্থ হলেও তাকে উৎসাহ দিতে হবে যাতে ভবিষতে সে সাফল্য পায়।
সন্তানের ওপর কোন বিষয় নিয়ে চাপ সৃষ্টি করা যাবে না। কারণ সব বাচ্চাই সমান নয়। সস্তানের ভালো কাজের প্রশংসা করতে হবে। আবার ব্যর্থ হলে অন্য কারো সাথে তুলনা করা থেকে বিরত থাকতে হবে। তাকে সারাক্ষণ বকাঝকা থেকে বিরত থাকতে হবে।
সন্তানের সবসময় পাশে থেকে তার নির্ভরতার জায়গা তৈরি করে নেওয়ায়ই হচ্ছে এক আদর্শ বাবা-মার মূল কাজ বলে মনে করেন এই মনোবিজ্ঞানী।