বাসস ইউনিসেফ ফিচার-১ : উপকূলীয় এলাকায় নারীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি পাচ্ছে

447

বাসস ইউনিসেফ ফিচার-১
উপকূলীয়-নারী
উপকূলীয় এলাকায় নারীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি পাচ্ছে
ঢাকা, ৩১ মে, ২০১৮ (বাসস/ইউনিসেফ ফিচার) : ‘সময় এখন নারীর : উন্নয়নে তারা বদলে যাচ্ছে গ্রাম-শহরে কর্ম জীবনধারা’- ২০১৮-এর নারী দিবসে এই ছিল মূল প্রতিপাদ্য। হ্যাঁ, নারীরা বদলে যাচ্ছে দ্রুত। তারা বদলে দিচ্ছে দেশকেও। ক্ষমতায়ণের দিক থেকে নারীরা সবচেয়ে এগিয়ে গেছে। যেমন দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী, সংসদ উপনেতা ও বিরোধী দলীয় নেতা নারী এবং স্পিকারও নারী। বর্তমান সংসদে ২০ জন নারী সরাসরি নির্বাচনে সংসদ সদস্য রয়েছেন। সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন ৪৫ থেকে ৫০ উন্নীত করা হয়েছে। এ গেল নারীর সরাসরি ক্ষমতায়ণের দিক।
ক্ষমতায়নের অন্যদিকগুলো যেমন- সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমনবাহিনীতে সাহসিকতার সাথে তারা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে। এছাড়াও বিচারপতি, সচিব, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর, নির্বাচন কমিশনার, রাষ্ট্রদূত, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীরা কাজ করে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে তারা অনেক অবদান রাখছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপে জানা যায়, দেশে মোট ৫ কোটি ৪১ লাখ কর্মজীবীর মধ্যে ১ কোটি ৬২ লাখ নারী। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পোদ্যোক্তাদের মধ্যে নারীর সংখ্যা ১৬ হাজার ৬৯৮ জন। বিদেশে বিভিন্ন পেশায় কর্মরত প্রায় ৭৬ লাখ প্রবাসীর মধ্যে ৮২ হাজার ৫৫৮ জন নারী। এছাড়া বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত গামেন্টস শিল্পে শতকরা ৮০ ভাগ কর্মী নারী। সর্বোপরি দেশের ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবহারকারীর বেশির ভাগই নারী ।
দেশের উন্নয়নে তারা সর্বত্র অবদান রাখছে। তেমনি তাদের জীবন মানেরও উন্নতি ঘটছে। পাশাপাশি তারা ক্ষমতায়ণে অগ্রসরমান। এক্ষেত্রে দেশের পাবর্ত্য এলাকা এবং উপকূলীয় এলাকাও পিছিয়ে নেই। নানাবিধ কারণে উল্লেখিত এলাকার মানুষেরা অনেকটা পশ্চাৎপদ। কিন্তু যুগ ও কালের পরিবর্তনে তারা দরজার চৌকাঠ পেরিয়ে এখন অনেক দূর এগিয়েছে। বিশেষ করে উপকূলীয় ১৭ জেলার নারীরা।
উপকূলীয় নারীরা একসময় ছিল নানা কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। তার ওপর ছিল ধর্মান্ধতা। তারা ঘরের বাইরে বেরোতে চাইতো না। চাওয়া-পাওয়ার ক্ষেত্রে পারিবারিক ভাবে ছিল একেবারে নির্বিকার। সেই উপকূলীয় নারীদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে গেছে। অর্থাৎ জেগে উঠেছে তারা। কৃষি খাতে অবদান রাখছে। এমনকি তারা বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ নিতে কার্পণ্য করছে না। বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ কার্যক্রমের বিভিন্ন পরিকল্পনার অগ্রগতির ধারায় তারা অংশগ্রহণ করছে। এছাড়াও তারা ক্ষুদ্র শিল্প খাতে নানাভাবে অংশগ্রহণ করছে। এতে তারা আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার পাশাপাশি ক্ষমতায়নের দিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে।
উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুরের জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান ও জেলা মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান ফরিদা ইয়াসমিন লিকা বলেন, উপকূলীয় এলাকায় নারী ক্ষমতায়নে অনেক দূর এগিয়েছে। তারা নানাভাবে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে অবদান রাখছে। আগের মতো তাদের গোঁড়ামি নেই। তারা আগে ঘরের বাইরে যেতো না। এখন তারা ঘর থেকে বের হচ্ছে। শিক্ষিতরা বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে। এজন্য তারা ঋণও পাচ্ছে সরকারি ও বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে। ফলে তাদের জীবন পাল্টে যাচ্ছে। পাল্টে যাওয়ায় তারা আজ সমাজে অবহেলিত নয়। সমাজকে তারা অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রভান্বিত করছে। তবে কুটির শিল্পের প্রসার ঘটাতে পারলে উপকূলীয় নারীরা আরো কাজের সুযোগ পাবে।
ভোলার বোরহান উদ্দিন উপজেলার মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান মাহফুজা ইয়াসমিন বলেন, গত ৯-১০ বছরে উপকূলীয় জেলা ভোলায় নারীর ক্ষমতায়ণ অনেক বেড়েছে। মেয়েদের শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। উপকূলীয় এলাকায় চারদিকে পানি আর পানি। এ ভূ-পরিবেশে নারীকে উঠিয়ে আনা কঠিন। কেননা, এখানে দারিদ্র্য, কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা, বাল্য বিয়ের মতো অভিশাপ এখনো পুরোপুরি দূর হয়নি। এমন পরিস্থিতির মধ্য থেকে নারীরা বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। তারা হাফ ছাড়তে পারছে। আর এসবের মূলে রয়েছে উপকূলীয় এলাকায় সরকারের পাইলট প্রকল্প। এসব প্রকল্প অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এতে নারীরা বেশি সুবিধা পাচ্ছে। তাই নারীদের এখন হাটে-বাজারে, মাঠে-ঘাটে সব জায়গায় দেখা যায়। স্থানীয় সরকারের কেন্দ্রবিন্দুতে এ নারীরা। এ টু আই প্রকল্পে তারা অংশগ্রহণ করতে পারছে। এ সুযোগ উপকূলীয় দুর্গম এলাকায় এখন স্বাভাবিক বিষয়। তাছাড়া ভ্রাম্যমাণ কম্পিউটার প্রশিক্ষণে নারীরা সুযোগ বেশি পাচ্ছে। তবে গ্রামীণ তৃণমূলে নারী-পুরুষের মধ্যে সমতা এলে তখুনি নারীর ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠা পাবে। সরকারের সদিচ্ছার বর্হিপ্রকাশ পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন স্তরে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে।
নারী ক্ষমতায়ণে মধ্যবিত্তের চেয়ে দরিদ্র শ্রেণীর নারীরা বেশি এগিয়েছে- এমন মন্তব্য বরিশাল মহিলা পরিষদের নেত্রী রহিমা সুলতানা কাজলের। তিনি বলেন, দুর্গম চর এলাকায় নারীরা এখন ঘরে বসে থাকে না। তারা কৃষি কাজে অংশগ্রহণ করছে। এনজিও, ক্ষুদ্রঋণ সহায়তা, ভিজিএফ ও ৪০ দিনে খাদ্য কর্মসূচিতে মেয়েরা সুবিধা পাচ্ছে। তাদের মধ্যে কোন স্থবিরতা নেই। তাদের কমংস্থান বাড়ছে। মোট কথা সরকারের গ্রহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে তারা এখন স্বয়ং সম্পুর্ন। আগে যারা ঘরে থেকে বের হতো না, এখন তারা স্থানীয় সরকারের সাথে জড়িত। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটিতে সদস্যদের মধ্যে মেয়েদের বাধ্যতামূলক রাখা হচ্ছে। রহিমা সুলতানা আরো বলেন, আন্তর্জাতিক নারী দিবস, শিশু দিবস, মানবাধিকার দিবস সম্পর্কে শুধু শিক্ষিত মেয়েরা যে জানে তা নয়, নারীর ক্ষমতায়ণের জোয়ারে এখন উপকূলীয় গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর অশিক্ষিত, অর্ধ-শিক্ষিত মেয়েরাও এসব দিবসের দিন তারিখ জানে।
নারী ক্ষমতায়নে ও নারী অধিকার বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে পুরস্কৃত হয়েছেন। পাশাপাশির নারী ক্ষমতায়নে প্রসার ঘটায় জাতিসংঘের বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করছে। বাংলাদেশ এমডিজি অ্যাওয়ার্ড, সাউথ-সাউথ অ্যাওয়ার্ড, প্লানেট চ্যাম্পিয়ন, এজেন্ট অব চেঞ্জ, শিক্ষায় লিঙ্গ সমতা আনার স্বীকৃতিস্বরূপ ইউনেস্কোর ‘শান্তিবৃক্ষ’সহ অসংখ্য আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। এসব কারণে নারীর ক্ষমতায়ণে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার সকল দেশের উপরে। এ তথ্য গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ-এর। তাদের মতে, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে সপ্তম অবস্থানে।
নারী ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের এ অর্জনের মূলে রয়েছে সরকারের জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি-২০১১। এ আইনের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নের পাশাপাশি সমাজে ও রাষ্ট্রে সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তার ওপর জাতীয় বাজেটে ২০০৯ সাল থেকে সরকার পর্যায়ক্রমে জেন্ডার রেসপন্সিভ বাজেট প্রণয়ন শুরু করে। এর মাধ্যমে সব মন্ত্রণালয় নারীর অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষমতায়ণ সুসংহত করতে নানামুখী কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।
এ জন্য জাতীয় বাজেটে বরাদ্দও বেশি দেয়া হয়। আর এর সুফল সব নারীরা, বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকার নারীরা বেশি পেয়ে যাচ্ছে। কেননা, সরকার পশ্চাৎপদ ও দুর্গম এলাকার প্রতি বেশি নজর দিচ্ছে। তাই ওই সব এলাকায় নারীর জীবনমানের উন্নয়ন এবং ক্ষমতায়ণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাসস/ইউনিসেফ ফিচার/মরপা/স্বব/আহো/০৯৩০/ওজি