নারীদের আত্মবিশ্বাস ও মর্যাদা নিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে : প্রধানমন্ত্রী

493

ঢাকা, ৮ মার্চ, ২০১৮ (বাসস): অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন নারীর জন্য অত্যন্ত জরুরী উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ নারীদের আত্মবিশ্বাস এবং মর্যাদা নিয়ে চলে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা পালনের আহবান জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এখানে অর্থনৈতিক স্বাধীনতাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই মেয়েদেরকে বসে থাকলে চলবে না, নিজেদেরও কাজ করতে হবে, লেখাপড়া শিখতে হবে এবং নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকালে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।
নারীর অধিকার সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর দর্শন তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা নারীর অধিকার নারীর অধিকার নিয়ে যতই শ্লোগান দেই যতই বক্তব্য দেই অধিকারতো আর হেঁটে আসবে না।’
তিনি বলেন, জাতির পিতা বলতেন- ‘একটা মেয়ে যদি নিজে অর্থ উপার্জন করতে পারে এবং তার হাতে যদি কিছু টাকা থাকে বা আঁচলে যদি কামাই করে ১০ টাকা বেঁধে নিয়ে আসতে পারেন তাহলে সমাজে-সংসারে এমনিতেই তার অবস্থানটা হবে। কেউ অবহেলা করতে পারবে না। ’
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তৃতা করেন ইউএন রেসিডেন্ট কো-অর্ডিনেটর এবং ইউএন রিপ্রেজেন্টিটিভ ইন বাংলাদেশ মিয়া সেপো। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসিমা বেগম অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা প্রদান করেন।
অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদ সদস্যগণ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাগণ, সংসদ সদস্যগণ, সরকারের পদস্থ কর্মকর্তাবৃন্দ, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিক, আমন্ত্রিত অতিথি, নারী উদ্যোক্তা এবং বিভিন্ন নারী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে নারীর উন্নয়ন-অগ্রযাত্রায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ প্রধানমন্ত্রী ৫ জন জয়িতার হাতে সম্মাননা পদক তুলে দেন।
পদক প্রাপ্তরা হচ্ছেন- অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জনে ঢাকা বিভাগের দৃষ্টি, শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করায় খুলনা বিভাগের মোসাম্মাৎ নাছিমা খাতুন, সফল জননী ক্যাটাগরিতে চট্টগ্রাম বিভাগের পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির হলা ক্রা প্রু মারমা, নির্যাতনের বিভীষিকা পেছনে ফেলে নতুনভাবে জীবন শুরু করায় ঢাকা বিভাগের ফিরোজা খাতুন এবং সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখায় রাজশাহী বিভাগের আমেনা বেগম।
মেয়েদের যে মেধা আছে সেটা আমাদের কাজে লাগাতে হবে এবং একটা সমাজকে যদি গড়তে হয় যে সমাজে প্রায় অর্ধেকই নারী সেই অর্ধেক বাদ রেখে একটা সমাজ উন্নত হতে পারে না। সমাজকে উন্নয়ন করতে হলে নারী পুরুষ সবাইকেই সমানভাবে সুযোগ করে দিতে হবে। নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও করতে হবে এবং কর্মক্ষেত্রেই তাদের যে শক্তি ও মেধা সেটা যেন কাজে লাগে তার ব্যবস্থাও করতে হবে।
এই সময় প্রধানমন্ত্রী কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার পংক্তি ‘বিশ্বে যা কিছু সুন্দর চিরকল্যাণকর/ অর্ধেক তাঁর আনিয়াছে নারী অর্ধেক তাঁর নর,’- উল্লেখ করে বলেন, নারীদের যদি আমরা সুযোগ করে না দেই তাহলে সেটা হবে না।
এজন্য তাঁর সরকার ’৯৬ সালে সরকার গঠনের পর ইউনিয়ন পরিষদে নারীদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা বরাদ্দ করেন যাতে তৃণমূল থেকেই নেতৃত্বটা উঠে আসে, বলেন প্রধানমন্ত্রী।
একটা সমাজে নারী-পুরুষ সকলে মিলে কাজ করতে পারলেই একটা দেশ এগিয়ে যাবে। আর যেলক্ষ্য আমরা স্থীর করেছি, জাতির পিতা আমাদের যে স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন তার সুফল প্রত্যেক ঘরে পৌঁছাতে হবে। আমাদের ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়া শিখে বড় হবে এবং বিশ্বে মর্যাদা নিয়ে চলবে তারা যেন সমানভাবে চলতে পারে সেভাবেই তাদেরকে আমরা গড়ে তুলতে চাই।
শেখ হাসিনা বলেন, কাজেই সমাজে যদি নারী পড়ে থাকে তাহলে সেই সমাজ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। সেজন্যই নারীদের অধিকার সুরক্ষিত করে তাঁদের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া, কর্মক্ষেত্রসহ সর্বক্ষেত্রেই তাঁদের বিচরণ যাতে নিশ্চিত হয় সেটাই আমাদের লক্ষ্য আর সে কাজটাই আমরা করে অনেক দূর এগিয়ে গেছি।
তিনি বলেন, অনেক উন্নত দেশে যা পারে না, বাংলাদেশের মেয়েরা তা পারে সেটাও আমরা প্রমাণ করে দিয়েছি। কাজেই এটাই চাই আপনারা আমাদের বোনেরা একটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে আত্মমর্যাদা নিয়ে চলবেন। তারপরেও পরিবারের প্রতি যে দায়িত্ব সেটাও যথাযথভাবে পালন করবেন। কারণ, কথাইতো আছে সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে, একথাটাও যেন আমরা ভুলে না যাই।

প্রধানমন্ত্রী এ সময় মেয়ের বিয়ের জন্য বাবা-মাকে তাড়াহুড়ো না করে তাদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মত শিক্ষা প্রদানে মনোনিবেশ করার জন্যও তাঁদের প্রতি আহবান জানান।
তাঁর সরকার দেশে বাল্যবিবাহ বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে একটা সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করা একান্তভাবে প্রয়োজন, যেটা তাঁর সরকার করে যাচ্ছে।
তিনি যেখানেই যান সেখানেই এ ব্যাপারে প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক করে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করছেন, বলেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারের নারীদের জন্য দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত অবৈতনিক লেখাপড়া করার ব্যবস্থা, বৃত্তি-উপবৃত্তির শতকরা ৭৫ ভাগ নারীদের জন্য প্রদান এবং নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টিসহ তাঁদের জন্য কর্মসংস্থানের পদক্ষেপ তুলে ধরে অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘নারীদের বিয়ে দিয়ে দিলেই তাদের প্রতি দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। বরং দায়িত্ব আরো বাড়ে। কিন্তু মেয়েকে যদি লেখাপড়া শিখিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে তাহলে সেটাই আমার মনে হয় সমাজ ও পরিবারের জন্য সব থেকে ভালো হয় এবং একটি সুরক্ষার সৃষ্টি করতে পারে। আর বাবা-মা বৃদ্ধ হয়ে গেলে ছেলের বউ যত না দেখে তার চেয়ে মেয়েরা বেশি দেখে এটাও তাদের মনে রাখা উচিত।’
প্রধানমন্ত্রী এটিকে অত্যন্ত বাস্তবকথা উল্লেখ করে বলেন, ‘মেয়েরাইতো ছেলের বউ হয় সেটাওতো ঠিক। তাই বাবা-মা শ্বশুর-শাশুড়ি সকলের প্রতিই নারীদের সমানভাবে দায়িত্ব পালন করা উচিত।’
বাবা-মা শ্বশুর-শাশুড়ির প্রতিও মেয়েরা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করবে সেই প্রত্যাশাও ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী।
বাংলাদেশের নারীরা এখন পিছিয়ে নেই উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে বাধা আমাদের নারীদের ছিল সে বাধা অতিক্রম করে তারা এখন এগিয়ে যাচ্ছে।
সরকার প্রধান বলেন, এয়ারফোর্সে মেয়েরা যুদ্ধ বিমান চালনা শুরু করে দিয়েছে, বিমানেতো মহিলা পাইলট আছেই, রেলেও নারী ড্রাইভার রয়েছে, গাড়ি চালক রয়েছে, অন্যান্য বাহিনী এবং বিজিবিতেও তারা রয়েছে, জাতীয় সংসদে ৫০টি সংরক্ষিত আসন ছাড়াও ২২জন সরাসরি নির্বাচিত নারী সদস্য রয়েছেন এবং সংসদ নেতা, উপনেতা, বিরোধী দলীয় নেতা এবং স্পিকারও একজন নারী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিচার বিভাগে নারী বিচারপতি, প্রশাসনের শীর্ষ পদে ১০ জন নারী সচিব, পুলিশ বাহিনী, র‌্যাব, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনী, প্রশাসনের শীর্ষ পদে ১০ জন নারী সচিব এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদেও নারীরা দায়িত্ব পালন করছেন।
তিনি বলেন, আমাদের মেয়েরা এএফসি অনূর্ধ্ব- ১৪ ফুটবলে আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ নারী চ্যাম্পিয়নশীপের প্রথম আসরে ভারতের বিপক্ষে বিজয়ী হয় বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৫ মহিলা ফুটবল দল। জাতীয় নারী ক্রিকেট দল ২০২০ সালে অনুষ্ঠেয় টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলবে। আমাদের নারীরা এভারেষ্ট শৃঙ্গও জয় করেছে।
সকল জায়গায় মেয়েরা তাঁদের স্থান করে নিয়েছে এবং একটু সাহসের সাথে এগিয়ে গেলেই এই স্থানটা করে নেয়া যায়, বলেন প্রধানমন্ত্রী।
মেয়েরা যে পারে সেটা সর্বত্রই আজ প্রতিষ্ঠিত এমন অভিমত ব্যক্ত করে মেয়েদের কাজের প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মেয়েরা যখন কাজ করে আমি মনে করি খুব ভালভাবেই করে। তাদের কাজের দক্ষতা অনেক বেশি তাতে কোন সন্দেহ নেই।
প্রধানমন্ত্রী বক্তব্যের শুরুতে নারী জাগরণের পথিকৃত বেগম রোকেয়াকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে অন্ত:পুরবাসীনি মহীয়সী নারী বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিবের জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বাংলার মুক্তির সংগ্রাম, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয় এবং বীরাঙ্গণা নারীদের পুনর্বাসনে তাঁর গৌরবদীপ্ত ভূমিকার কথা উল্লেখ করেন।
নারীদের পুনর্বাসন ও ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে জাতির পিতা ‘নারী পুনর্বাসন বোর্ড’ গঠন করেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা সংবিধানের ১৯ ও ২৮ অনুচ্ছেদে জাতীয় জীবনের সকলক্ষেত্রে নারীর সমানাধিকার নিশ্চিত করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য জাতির পিতার পাশাপাশি বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবও ছিলেন সচেষ্ট। মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের তাঁদের পরিবার ফিরিয়ে নিতে চায়নি। আমার মা নিজের গয়না দিয়ে তাদের অনেকের বিয়ে দিয়েছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী নিজের গহনাও তাদেরকে কর্তব্য ভেবেই দিয়েছেন উল্লেখ করে বলেন, এসব নারীদের অনেকেরই বিয়ের বেলায় বাবার নাম লেখা হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমান, ঠিকানা ধানমন্ডি ৩২ নম্বর।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় ‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১’ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় কর্মপরিকল্পনা-২০১৩ গ্রহণ, মাতৃত্বকালীন ছুটি ৪ মাসের পরিবর্তে স্ব-বেতনে ৬ মাসে বর্ধিতকরণ এবং সন্তানের পরিচয়ের ক্ষেত্রে বাবার নামের পাশাপাশি সর্বত্রই মায়ের নাম বাধ্যতামূলক করাসহ তাঁর সরকারের নারী উন্নয়নে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরেন।