বাজিস-৭ : শেরপুরে কমিউনিটি বীজতলা কৃষকদের মাঝে সাড়া জাগাচ্ছে

141

বাজিস-৭
শেরপুর-কমিউনিটি বীজতলা
শেরপুরে কমিউনিটি বীজতলা কৃষকদের মাঝে সাড়া জাগাচ্ছে
শেরপুর, ১৭ জানুয়ারি ২০১৯ (বাসস) : কৃষি উন্নয়নে প্রতিনিয়ত যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবস্থা। নিত্য নতুন প্রযুক্তির ছোঁয়ায় লাভবান হচ্ছেন কৃষক। এমন একটি প্রযুক্তি ব্যবস্থা হলো কমিউনিটি (আদর্শ) বীজতলা। এ বীজতলা তৈরি ও চাষে কৃষকের মাঝে ব্যাপক সাড়া জাগাচ্ছে। কমিউনিটি বীজতলাতে কৃষকরা লাভবান হওয়ায় দিন দিন তারা ঝুঁকে পড়েছেন। শেরপুরের সব উপজেলার কৃষকের মধ্যে কমিউনিটি বীজতলা তৈরিতে আগ্রহ ক্রমেই বেড়ে চলছে। এ বীজতলা তৈরি করায় কৃষকের ধান উৎপাদন খরচ ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ কম লাগছে। ফলে কম খরচে বেশি লাভ পাচ্ছেন নকলার কৃষকরা।
কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় প্রায় ৩৭ হাজার কৃষি পরিবার রয়েছেন। এর মধ্যে ১৫ হাজার থেকে ১৬ হাজার কৃষক গড়ে ২ থেকে ৩ শতাংশ জমিতে কমিউনিটি (আদর্শ) পদ্ধতিতে বীজতলা তৈরি করেছেন। উপজেলায় মোট ৮০৬ হেক্টর জমিতে বীজতলা তৈরি করা হয়েছে; এর মধ্যে কমিউনিটি বীজতলা ১৬০ হেক্টর।
নকলা উপজেলার গৌড়দ্বার ইউনিয়নের পাইষ্কা ব্লকের কৃষক পাইষ্কা এলাকার কৃষক আজিজুল ইসলাম, ইদ্রিস আলী, ও আমিরুল ইসলাম, চরকৈয়া এলাকার কৃষানি ইয়াছমিন, আঁখি, ছাহেরা, মালেছা ও কৃষক ফরিদুল, কুর্শাবাদাগৈড় এলাকার কৃষক লিয়াকত আলী, ভূরদী গ্রামের কৃষক ছাইদুল হক, হেলাল, কামাল, কমল ও ঈসমাইলসহ অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগের পদ্ধতির চেয়ে কমিউনিটি পদ্ধতিতে বীজতলা তৈরি করলে বীজ, শ্রম, সার, জায়গা, সেচ ও সময়সহ খরচ অনেক কম লাগে। ফলনও ভালো পাওয়া যায়। আজিজুল ইসলাম জানান, সনাতন পদ্ধতিতে যে জায়গায় ৫০ কেজি বীজ লাগত, সেখানে কমিউনিটি পদ্ধতিতে ৩৫ কেজি বীজ লাগে। তাতে বীজতলা তৈরি থেকে অন্যসব মিলে এক হাজার ৫০০ টাকা খরচ কম হয়। অথচ আগে ৫০ কেজি বীজের চারা দিয়ে আড়াই একর জমি রোপণ করা যেত, আর কমিউনিটি বীজতলার ৩৫ কেজি বীজের চারা দিয়ে ওই জমিটুকু রোপণ করা সম্ভব। এ পদ্ধতি ব্যবহারে আগের চেয়ে ফলন ভালো হয়। তাছাড়া সেবাযতœ করাও সহজ হয়। এমনকি সনাতন পদ্ধতির তুলনায় খরচ প্রায় অর্ধেক লাগে।
কৃষক জানান, স্থানীয় কৃষি অফিসের সহযোগিতা ও পরামর্শে কমিউনিটি (আদর্শ) পদ্ধতিতে যে কোনো জমিতে বীজতলা তৈরি করতে পেরে তারা অধিক লাভবান হচ্ছেন। এসব বীজতলা থেকে চারা তোলা এবং রোপণ করা সহজ হয়। ফলে রোপণে শ্রমিক ও খরচ কয়েকগুণ কম লাগে। ভূরদী কৃষিপণ্য উৎপাদক কল্যাণ সংস্থার সভাপতি ছাইদুল জানান, আগে ২ বিঘা জমিতে বোরো ধান লাগাতে ১২ থেকে ১৫ শ্রমিকের সারা দিন লাগত, এখন কমিউনিটি বীজতলার চারা রোপণ করতে ৮ থেকে ১০ শ্রমিক লাগে। তাছাড়া বর্তমানে কৃষি শ্রমিক পাওয়া কঠিন, তাই এ বীজতলা উদ্ভাবনের ফলে কৃষক সময়, টাকা ও শ্রমসহ সবদিকে লাভবান হচ্ছেন।
উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক জানান, কয়েক বছর আগেও কৃষকরা বীজতলা তৈরি করতে নিচু এলাকায় অন্যের জমি লিজ নিতেন। তাতেও ক্ষতির আশংকা ছিল। কিন্তু কমিউনিটি পদ্ধতিতে যে কোনো জায়গায় বীজতলা তৈরি করা যায়। এতে ক্ষতির আশংকা নেই বললেই চলে। এ পদ্ধতিতে উৎপাদিত চারা ১২ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে রোপণ উপযোগী হয় এবং ফলন অনেক ভালো হয়। তিনি আরও বলেন, কমিউনিটি বীজতলা তৈরি করতে আমরা মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের নিয়মিত পরমর্শ দিচ্ছি। সময় লাগে, ফলন ভালো হয় ও লাভ বেশি পাওয়া যায়। তাই কৃষকরা এ বীজতলার প্রতি ঝুঁকছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা কৃষিবিদ আবদুল ওয়াদুদ ও কৃষিবিদ শেখ ফজলুল হক মণি জানান, তারা কয়েক বছর ধরে কমিউনিটি পদ্ধতিতে বীজতলা তৈরি করতে কৃষককে হাতেনাতে শিক্ষা দিচ্ছেন। বীজতলা তৈরির মৌসুমে ছুটির দিনেও মাঠে ঘুরে কৃষককে পরামর্শ দেন তারা। তারা জানান, উপজেলার ৮০৬ হেক্টর বীজতলার চারা দিয়ে প্রায় ২০গুণ জমিতে রোপণ সম্ভব। ফলে ১৬০ হেক্টর কমিউনিটি (আদর্শ) বীজতলার চারা দিয়ে কমপক্ষে ৩ হাজার ২০০ হেক্টর জমি এবং ৬৪৬ হেক্টর সনাতন পদ্ধতিতে করা বীজতলার চারা দিয়ে প্রায় ১২ হাজার হেক্টর জমি রোপণ করা যাবে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ পরেশ চন্দ্র দাস জানান, উপজেলায় চলতি বোরো মৌসুমে ১৩ হাজার ২৪৭ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের জন্য লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে হাইব্রিড জাতের ৭ হাজার ১১ হেক্টর, উফসী জাত ৬ হাজার ২০৬ হেক্টর এবং স্থানীয় জাতের জন্য ৩০ হেক্টর। ১৩ হাজার ২৪৭ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের জন্য কম-বেশি ৮১০ হেক্টর জমিতে কৃষকরা বীজতলা তৈরি করেছেন। এর মধ্যে হাইব্রিড জাতের ধানের বীজতলা ৪৩০ হেক্টর জমিতে, উফসী জাতের ধানের বীজতলা ৩৭০ হেক্টর জমিতে এবং স্থানীয় জাতের ধানের বীজতলা তৈরি করা হয়েছে ১০ হেক্টর জমিতে। তিনি জানান, চলতি বোরো মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রার জমি থেকে উৎপাদিত ধান হতে চাল পাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫৭ হাজার ৬৮৭ মেট্রিকটন। এতে হাইব্রিড প্রতি হেক্টরে ৪.৭৫ মেট্রিকটন করে ৩৩ হাজার ৩০২ মেট্রিকটন, উফসী প্রতি হেক্টরে ৩.৯২ মেট্রিকটন করে ২৪ হাজার ৩২৭ মেট্রিকটন এবং স্থানীয় জাতের ধান হতে চাল পাওয়ার আশা করা হচ্ছে প্রতি হেক্টরে ১.৯৪ মেট্রিকটন করে ৫৮ মেট্রিকটন। এ কৃষি কর্মকর্তা আরও জানান, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ন্যাশনাল এগ্রিকালচার টেকনোলজি প্রজেক্ট (এনএটিপি ফেজ-২) এর আওতাসহ উপজেলার কৃষকের মাঝে অন্তত ধানের ৩০০টি প্রদর্শনী প্লট দেওয়া হয়েছে (প্রতিটি প্লট এক বিঘা থেকে এক একর)। তিনি বলেন, কৃষি বিভাগের দেয়া পরামর্শে কৃষকরা কমিউনিটি পদ্ধতিতে বীজতলা তৈরি করে লাভবান হয়েছেন। এ পদ্ধতিতে লাভ দেখে অন্যান্য কৃষক নিজ উদ্যোগে এ পদ্ধতিতে বীজতলা তৈরি করছেন। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে উপজেলার সব বীজতলা কমিউনিটি পদ্ধতিতে করা হবে বলে তিনি আশা করছেন। কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবেলায় না পড়লে নকলা উপজেলায় উৎপাদিত বোরো ধান দিয়ে নিজেদের খাদ্য চাহিদা মিটিয়ে অন্যান্য জেলা উপজেলায় সরবরাহ করা সম্ভব হবে। তাতে কৃষি অর্থনীতি আরও দ্রুত উন্নত হবে।
বাসস/সংবাদদাতা/কেইউ/১৪৫০/নূসী