বাসস ইউনিসেফ ফিচার-২ : পতিত জমিতে চা চাষে স্বাবলম্বী নারী

363

বাসস ইউনিসেফ ফিচার-২
পতিত জমিতে চা চাষে স্বাবলম্বী নারী
॥ মাহবুব আলম ॥
ঢাকা, ৩০ মে, ২০১৮ (বাসস) : দিন পাল্টেছে। এখন শুধু সন্তান লালন-পালন নিয়েই ব্যস্ত থাকেন না নারীরা। প্লেন চালানো থেকে শুরু করে দেশও পরিচালনা করছেন। আবার শিল্প-কারখানা থেকে তথ্য-প্রযুক্তি এমনকি কৃষিতেও বিপ্লব ঘটাচ্ছেন তারা। নতুন করে চা চাষে যুক্ত হচ্ছেন উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের নারীরা।
চা উৎপাদনের কথা এলেই আমাদের মনো দৃশ্যপটে ভাসে সিলেট বিভাগের পাহাড়ি অঞ্চলের কথা। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরেই দেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের সমতল ভূমিতেও গড়ে উঠেছে চা বাগান।
চা চাষের প্রসঙ্গ এলেই বড় বড় কোম্পানি কিংবা শিল্পগ্রুপের কথাই আসে। কিন্তু পঞ্চগড়ে প্রান্তিক চাষিরা চা চাষ করছেন এবং তারা সফলও হয়েছেন।
সরেজমিনে ঘুরে ও স্থানীয় প্রান্তিক পর্যায়ের চা চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পঞ্চগড়ে, বিশেষ করে সীমান্তবর্তী উপজেলা তেঁতুলিয়ায় বড় বড় চা বাগানের পাশাপাশি গড়ে ওঠেছে ব্যক্তি উদ্যোগের শত শত বাগান।
অনেকে বাড়ির পাশে পড়ে থাকা এক টুকরো জমিতেই চাষ করছেন চা। ধান কিংবা শাক-সবজি আবাদ না করে চা-কেই ‘অর্থকারী’ ফসল হিসেবে উৎপাদন করছেন নারীরাও। তেঁতুলিয়া দর্জি পাড়ার তেমনই একজন মুক্তা বেগম। হিমালয় কন্যা হিসেবে পরিচিত পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার দর্জি পাড়া ও এর আশপাশের কয়েক গ্রামের নারী-পুরুষের মতো তিনিও একজন সফল চা চাষি।
কথা প্রসঙ্গে মুক্তা জানালেন, বাড়ির পাশের পতিত জমিতে ধান কিংবা অন্যান্য ফসল আবাদ হয় না। স্থানীয় একটি বেসরকারি সংস্থার পরামর্শে তিনি সেখানে চা চাষ শুরু করেন।
‘এইটা ডাঙ্গা (পতিত) জমি। এইখানে অন্য কোনো আবাদ হয় না। গম হয় না, ধান হয় না। এইটা সব সময় পতিত পইড়া থাকতো। এমনিতেই পড়ে থাকে এজন্য এখানে আমরা চা আবাদ করি।’
মুক্তা বলেন, সমিতি থেকে প্রথম প্রথম চা চাষের ধারণা পাই। তারা জমিটা খালি না রেখে চা চাষের পরামর্শ দেয়। কথা মতো চা চাষ করে এখন আমি স্বাবলম্বী।
‘ওই সময় সমিতির কর্মকর্তরা (মাঠকর্মী) কইলো জমি খালি ফেলায়ে রাখবেন কেন? চা চাষ করে জমিডার উনয়ন করেন, লাভবান হন।’
এরপরই বেসরকারি সংস্থার ব্যবস্থাপনায় প্রশিক্ষণ নেন মুক্তা বেগম। তার সেেঙ্গ স্থানীয় আরও কয়েকজন নারীও ছিলেন। যারা এখন চা চাষে সফল।
মুক্তা বলেন, তখন ওরা আমাদের ট্রেনিং দিল। আমরা ট্রেনিং নিয়ে চা চাষ শুরু করি।
‘আমার বাগানের বয়স প্রায় ৯ বছর চলছে। তবে প্রথম তিনবছর সেখান থেকে কোনো পাতা তুলতে পারিনি। তাছাড়া আমরা জানতাম না কিভাবে পানি (সেচ) দিতে হবে, কিভাবে মশা মারার (কীটনাশক) ওষুধ দিতে হবে।’
পরে আবারও বেসরকারি সংস্থার তত্ত্বাবধানেই চা চাষ ও ফসল উত্তোলন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন মুক্তা বেগম। তার ভাষায়, এরপরই আমরা জানতে পারলাম কীভাবে গাছের যতœ করতে হয়, কীভাবে পানি দিতে হয় এবং কীভাবে পাতা তুলতে হবে তাও আমাদের শেখানো হয়।
নিজের ভাগ্যের উন্নয়নের কথা জানিয়ে চা চাষি মুক্তা বলেন, চা চাষ করে আমাদের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন হয়েছে। আগে ছনের (কুঁড়ে) ঘর ছিল এখন আর তা নেই। এখন আমরা পাকা ঘর করেছি। চা চাষে লাভবানের পর বাড়িতে বিদেশি গরুর খামার দিয়েছি।
‘আগে আমার স্বামী ধান-চালের ব্যবসা করতেন। কিন্তু তেমন লাভবান হতে পারেনি। এখন তিনি আমার সঙ্গে শুধু চা বাগান দেখাশোনা করেন। চা বাগানের আয় থেকে অনেক সুন্দরভাবে সংসার চলে। আগের চেয়ে এখন আমরা অনেক ভালো আছি।’
পঞ্চগড় চা বোর্ডের আঞ্চলিক কার্যালয়ের তথ্য মতে, বর্তমানে জেলার দুই হাজার ২৫৫ দশমিক ৫৫ একর জমিতে চা চাষ সম্প্রসারিত হয়েছে। এর মধ্যে ১৮২ জন ক্ষুদ্র চাষি, যাদের জমি ৫ একরের নিচে। বড় বাগান রয়েছে ১৯টির মতো।
চা বোডের্র আঞ্চলিক কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, সরকারের পক্ষে সব ধরনের কারিগরি সহায়তা, ভর্তুকি, ঋণের ব্যবস্থা ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
১৯৯৬ সালে পঞ্চগড় সফরে চা চাষের সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর শুরু হয় চা চাষ। তবে ২০০০ সালে শুরু হয় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে।
এভাবে একসময়ের পতিত গো-চারণ ভূমি ও অনুন্নত জেলা এখন চায়ের সবুজ পাতায় সবুজাভ। সৃষ্টি হয়েছে চোখ জুড়ানো নৈসর্গিক সৌন্দর্য।
এখানকার অর্গানিক চা বিক্রি হচ্ছে লন্ডনের হ্যারোড অকশন মার্কেটে। রপ্তানি হচ্ছে দুবাই, জাপান ও আমেরিকায়। এ বছর চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় ৮ লাখ কেজি।
বাসস ইউনিসেফ ফিচার/মাআ/আসচৌ/১৬১০/আহো/-ওজি