বাসস ইউনিসেফ ফিচার-১ : এসিড দগ্ধ নারীদের অনন্য উদ্যোগ ‘প্রেসার গার্মেন্টস’

275

বাসস ইউনিসেফ ফিচার-১
এসিড-নারী
এসিড দগ্ধ নারীদের অনন্য উদ্যোগ ‘প্রেসার গার্মেন্টস’
॥ মোঃ মাহদী-আল-মুহতাসিম নিবিড় ॥
ঢাকা, ১২ ডিসেম্বর, ২০১৮ (বাসস) : বাংলাদেশে এসিড-হামলার শিকার নারীর সংখ্যা কম নয়। শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হওয়ার পর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা তাদের জন্য খুব কষ্টের। কিন্তু এসিড-সন্ত্রাসের শিকার হবার পরও জীবনযুদ্ধে বিজয়ী ক’জন নারী নিজেরা যেমন স্বাবলম্বী হয়েছেন, তেমনি দেশের স্বাস্থ্যখাতে অবদান রাখছেন। বিভিন্ন হাসপাতালে এসিড-আক্রান্তদের জন্য প্রেসার গার্মেন্টস তৈরি করছেন পাঁচ এসিডদগ্ধ নারী।
প্রেসার গার্মেন্টস হল লায়েক্রা নামক বিশেষ ধরনের কাপড়ের তৈরি পোশাক, যা রোগীর শরীরের মাপ অনুযায়ী বানানো হয়। এটি আক্রান্ত স্থানে সার্বক্ষণিকভাবে একই পরিমাণে চাপ দিতে পারে, যে ক্ষত তৈরি হয় তার বৃদ্ধি কমিয়ে দেয়। কোলাজেন ফাইবার, যা শরীরের এক প্রকার তন্তু-জাতীয় প্রোটিন, দগ্ধ স্থানের স্কার ফুলিয়ে তোলে। প্রেসার গার্মেন্টসের চাপের কারণে কোলাজেন সমান থাকে। অর্ডার অনুযায়ী প্রত্যেক অঙ্গের জন্য আলাদাভাবে এগুলো বানানো হয়।
বর্তমানে এসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশন এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে চলছে এই পোশাক তৈরির কাজ।
মিরপুর চৌদ্দতে অবস্থিত এসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ২০০২ সালে অস্ট্রেলিয়ান প্রশিক্ষকদের কাছ থেকে প্রেসার গার্মেন্টস তৈরির প্রশিক্ষণ নেন দুই এসিডদগ্ধ- আয়েশা বেগম ও রহিমা আকতার ডলি। পরে প্রশিক্ষণ নেন শামীমা আকতার, তসলিমা আকতার, নার্গিস আকতার রানু ও রোকসানা পারভীন। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ফাউন্ডেশন থেকে তারা মাসে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা বেতন পান। এদের মধ্যে রহিমা ডলি এখন বিদেশে আছেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শহিদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং এসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনে আকারভেদে এসব গার্মেন্টস ৮০০ থেকে সাড়ে ৪ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ৮০ হাজার টাকার প্রেসার গার্মেন্টস বিক্রি হয় এই তিন ইউনিট থেকে।
এসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশন হাসপাতালের ব্যবস্থাপক ডা. ফেরদৌস ওয়াহিদ জানালেন, “২০০২ সালের আগে যখন প্রেসার গার্মেন্টস ছিল না, অপারেশনের পর শুধু মলম ও মেডিসিন ব্যবহারেই সীমাবদ্ধ থাকতে হত। যার ফলে রোগীদের শরীর চুলকাত, ফোসকা পড়ে যেত, ফুলে যেত চামড়া। সার্জারির পর যে চামড়া লাগানো হয় সেটি যেন ফুলে না যায় সেজন্য প্রেসার গার্মেন্টস ব্যবহার করা হয়। আর যদি ফুলেও যায়, পরে যেন চামড়া আবার মসৃণ হয়ে ওঠে।”
২০ শয্যার এ হাসপাতালে ৭ জন ডাক্তার রয়েছেন। বিনা খরচে নারীসহ সহিংসতার শিকার দগ্ধ রোগীরা চিকিৎসা পাচ্ছেন এখান থেকে। বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠীর কাছ থেকে অর্থের সঙ্কুলান হয় বলে জানান ওয়াহিদ।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে নারীদের প্রেসার গার্মেন্টস বিক্রির জন্য রুম তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। যেখানে রোকসানা ও তাসলিমা নিজেদের তৈরি সামগ্রী বিক্রি করছেন। রোকসানা বলেন, “একসময় আমিও এমন রোগী ছিলাম। এখন আমি কাজটা শিখে নিজে করছি। অন্যরা আমার তৈরি জিনিস পরছে।”
এ কাজে গত বছর থেকে যুক্ত হন শামীমা। নওগাঁর পতœীতলা থানার চকদুরগা গ্রামের শামীমা ২০১১ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর স্বপ্ন দেখছিলেন সেনাবাহিনীতে চাকরি করার। বিয়ের পর পড়াশুনা করতে দেবে এমন শর্তে ব্যবসায়ী শহীদুল ইসলামের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। পড়ার সুযোগ না-দেওয়া নিয়ে একদিন ঝগড়ার পর ঘুমন্ত শামীমাকে এসিডে ঝলসে দেয় স্বামী।
শামীমা বলেন, “২০১২ সালে বিয়ের ছ’মাস পর এ দুর্ঘটনার শিকার হলে এখানে চিকিৎসা নিই। তখন আয়েশা আপার বানানো প্রেসার গার্মেন্টস পরেছিলাম। গত বছর থেকে আমিও এটি তৈরি করছি। মাসে ১০ হাজার টাকা আয় করি।”
স্বাবলম্বী শামীমা এখন ¯œাতক পর্যায়ে পড়াশুনা করছেন।
২০০২ সাল থেকে এ পেশায় যুক্ত চট্টগ্রামের আয়েশা জানান, বিয়ের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় ২০০০ সালে যখন তিনি এসিডে ঝলসে যান তখন প্রেসার গার্মেন্টস ছিল না। বছরের পর বছর ভুগতে হয়েছিল তাকে।
“আমার চামড়ার অনেক জায়গায় কুঁচকে আছে, সেটা থাকত না। চৌদ্দটা অপারেশন করতে হয়েছে, সেটারও দরকার হত না। সমাজে সবসময় মেয়েদের দায়ী করা হয়। তাই যখন ওদের কথা শুনি, তখন নিজের কথা মনে পড়ে। আমিও তো ওদের মতো ছিলাম।”
২০০৬ সালে বিয়ের পর এক মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে তিনি এখন স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন। মেয়েটি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। আর তিন বছরের ছেলে মায়ের সঙ্গে তার কর্মক্ষেত্রে আসে।
এসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, ১৯৯৯ সাল থেকে দেশে ৩৩৮৬টি এসিড-হামলার ঘটনা ঘটেছে। ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তারা ১৫টি এসিড-হামলার বিষয়ে জেনেছেন।
ফাউন্ডেশনের এক্সিকিউটিভ সেক্রেটারি সুমাইয়া নূরের মতে, এসিডে ওদের শরীরের নানা অঙ্গ ঝলসে গেলেও এরা পরাজয় মেনে না নিয়ে বাঁচতে শিখছেন।
ফাউন্ডেশনের সার্বিক সহযোগিতায় চিকিৎসা পেয়ে সুস্থ হওয়া এই পাঁচ নারী ছাড়াও আরও ১৭ জন নানা কাজ শিখে স্বাবলম্বী হয়ে উঠে এ প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন।
বাসস/ইউনিসেফ ফিচার/এমএমএন/এফওয়াই/১৬৪৬/আহো/-এসএইচ