বাসস ইউনিসেফ ফিচার-১ : সচেতনতাই নারীকে স্তন ক্যান্সারের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে

348

বাসস ইউনিসেফ ফিচার-১
ব্রেস্টক্যান্সার-সচেতনতা
সচেতনতাই নারীকে স্তন ক্যান্সারের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে
ঢাকা, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৮ (বাসস) : পৃথিবীতে রোগ-বালাই একটি চিরন্তন বিষয়। তবে আধুনিক বিশ্বে মেডিকেল সাইন্সের কল্যাণে এখন অনেক রোগই প্রতিরোধ করা সম্ভব। আবার কোন কোন রোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার হয় সচেতনতা। তেমনই একটি রোগ মহিলাদের ব্রেস্ট ক্যান্সার। রোগটি ধরা পড়লে একটা সুখের সংসারও অনেক সময় তছনছ হয়ে যায়। তেমনই হয়েছেন তিন সন্তানের জননী আফরোজা খাতুনের জীবনে। ৪৩ বছর বয়সী আফরোজা একজন সফল ব্যবসায়ী। সম্প্রতি মিরপুর মডার্ন শপিং কমপ্লেক্সে খুলেছেন তার ‘আফরোজা বুটিকস হাউস’-এর তিন নম্বর শো-রুম। চাকরিজীবী স্বামীর প্রেরণায় তিনি আজ এ পর্যায়ে আসতে পেরেছেন বলে জানান আফরোজা। কিন্তু গত ২৯ অক্টোবর হতে তাদের সুখের সংসারে হঠাৎ করেই যেন নেমে আসে অন্ধকার। ডাক্তার জানিয়েছেন আফরোজার ব্রেস্ট ক্যান্সার। দ্রুত অপারেশন করতে হবে। অপারেশন করলেও রোগী কতটুকু সুস্থ হয়ে উঠবেন তার নিশ্চয়তাও দিতে পারছেন না ডাক্তাররা।
আফরোজার সাথে কথা মিরপুরে তার শো-রুমে বসেই। তিনি বলেন, গত প্রায় দু’বছর ধরেই তার ডান ব্রেস্টে একটা চাকার মত ছিল। শুরুতে আমি নিজেও ভালো করে বুঝতে পারিনি। আবার যখন বুঝতে পারি তখন লজ্জ্বায় কাউকে বলতেও পারিনি। ভেবেছিলাম সেরে যাবে। কিন্তু দিন দিন চাকাটি বাড়তেই থাকে। পরে একদিন স্বামীকে জানালে সে একজন গাইনি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তিনি জানালেন, অবস্থা ভালো নয়।
জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, আক্রান্ত হওয়ার আগে প্রায় ৮০ শতাংশ রোগী এ রোগের নামই আগে কখনো শোনেনি। এর মধ্যে আবার প্রায় ৯৫ শতাংশ রোগী কোন দিন নিজের স্তন নিজে পরীক্ষা করে দেখেননি।
গবেষণা মতে, প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় হয় মাত্র দুই শতাংশ। এছাড়া ক্যান্সারে আক্রান্ত প্রতি চার জন নারীর মধ্যে একজন স্তন ক্যাান্সারে আক্রান্ত। সাধারণত প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত হওয়া স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর স্তনে কোন ধরনের ব্যথার উপসর্গ থাকে না। রোগীর রোগ শনাক্তকরণের সময় মাত্র ১.২ থেকে ৬.৭ শতাংশের ব্যথার উপসর্গ থাকে।
গাইনি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপিকা ডা. মনোয়ারা বেগম বলেন, বাংলাদেশে নারীদের মধ্যে স্তন ক্যান্সার এক নম্বর সমস্যা। বর্তমানে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও এ রোগের সংখ্যা বেড়ে গেছে আশংকাজনক হারে। মূলত ৪০-৫০ বছর বয়সী নারীরা এই স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকিতে থাকেন সবচেয়ে বেশি।
তিনি বলেন, এ পর্যন্ত সযত নারীর স্তন ক্যান্সার রোগটি নির্ণয় হয়েছে তার মধ্যে অধিকাংশরই প্রধান উপসর্গ হলো স্তনে চাকা। তবে এই চাকা দেখা গেলেই যে স্তনে ব্যাথা অনুভব তা কিন্তু নয়। অনেক সময় স্তনে কোন ধরনের ব্যথা অনুভব হয় না। তার মনে এই নয় যে, ওই নারী স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত নন।
ডা. মনোয়ারা বলেন, স্তন ক্যান্সারে বিভিন্ন ধরনের উপসর্গ রয়েছে। এরমধ্যে অধিকাংশ রোগীর স্তনে চাকা দেখা যাওয়ার হারই বেশি। এছাড়াও স্তন ফুলে উঠা, স্তনের বৃন্ত হতে তরল জাতীয় পদার্থ ঝরা, স্তন ফুলে উঠা, বৃন্তে ক্ষত হওয়া বা দেবে যাওয়া। এসব ছাড়াও আরো অনেক কারনে স্তনে ক্যান্সার দেখা দিতে পারে।
ডা. মনোয়ারা বলেন, মূলত স্তনে চাকা এবং ব্যথা নিয়েই অধিকাংশ নারী ডাক্তারের শরণাপন্ন হন। স্তনে ব্যথাকে মূলত ডাক্তারি ভাষায় মাস্টালজিয়া বলে। তবে ব্যাথা হলেই যে স্তন ক্যান্সার হয়েছে তা কিন্তু নয়। এটি মূলত একটি উপসর্গ। স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর রোগ শনাক্তকরণের সময় মাত্র ১.২ থেকে ৬.৭ শতাংশের ব্যথার উপসর্গ থাকে। অন্যদিকে স্তনে চাকা অনুভূত হলেই যে তা স্তন ক্যান্সার তাও কিন্তু নয়। গবেষণা অনুযায়ী প্রায় ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ চাকাই ক্যান্সার নয়।
তিনি বলেন, স্তন ক্যান্সারের চাকা সাধারনত অসমান, শক্ত এবং অমসৃণ। এটি স্তনের যেকানো স্থানে হতে পারে। এ ধরনের চাকা হঠাৎ করে তৈরী হয় না। দীর্ঘদিন ধরে চাকাটি আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ এন্ড হসপিটালের গাইনোলজী বিভাগের প্রধান ডা. রোকেয়া বেগম বলেন, মুলত নারীদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে এ রোগের ঝুঁকি বাড়তে থাকে। তবে ৪০ থেকে ৫০ বছর বয়সী নারীরা এ ঝুঁকিতে বেশি থাকেন।
তিনি বলেন, অধিক মাত্রায় গ্রন্থিসমপন্ন নারী, পরিবারের কারো স্তন ক্যান্সার ছিল এমন কেউ, বেশি বয়সে মাসিক বন্ধ হওয়া, অতিরিক্ত ওজন, শিশুকে দুধ পান না করানো নারী, অধিক পরিমাণ লাল মাংস খাওয়া নারীরা স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকিতে থাকেন সবচেয়ে বেশি।
তিনি বলেন, মূলত সামান্য সচেতনতাই পারে নারীদের এই রোগ হতে বাঁচাতে। এজন্য প্রতি দুই বছরে অন্তত একবার ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়াই সবচেয়ে উত্তম। এছাড়াও নিজেই নিজের স্তন পরীক্ষা করতে পারেন নারীরা। বিশ বছরের উর্ধ্বে নারীরা যেহেতু স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকিতে থাকেন তাই তারা নিয়মিত নিজের স্তন নিজেই পরীক্ষা করতে পারেন। এতে যদি কোন ধরনের অস্বাভাবিকতা দেখা যায়, তবে সাথে সাথে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
সুতরাং সচেতনতাই পারে একজন নারীকে ব্রেস্ট ক্যান্সারের থাত থেকে রক্ষা করতে পারে। এ জন্য নিয়মিত পরীক্ষা ও ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া প্রয়োজন।
বাসস/ইউনিসেফ ফিচার/সুঘো/স্বব/০৯২৫/আহো/এসএইচ