বাসস ইউনিসেফ ফিচার-১ : শিক্ষা শিশুর মৌলিক অধিকার

152

বাসস ইউনিসেফ ফিচার-১
শিশু-অধিকার
শিক্ষা শিশুর মৌলিক অধিকার
॥ মুসলিমা খাতুন ॥
ঢাকা, ২৮ নভেম্বর ২০১৮ (বাসস) : শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড আর আজকের শিশুরাই জাতির আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। সুতরাং উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ার লক্ষ্যে প্রতিটি শিশুকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। অর্থাৎ শিশুদের শিক্ষা যেমন একটা জাতির সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি শিক্ষা শিশুদের মৌলিক একটা অধিকারও বটে। কিন্তু আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক সময় অনেক শিশুই তার এ মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। যেমন ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে সন্তানদের ঠিকমত লেখাপড়া করাতে পারছেন না ভ্যানচালক জয়নাল মিয়া। ‘ছেলেদের লেখাপড়া কেমনে করামু। বরং আমার সাথে কাজ করে টাকা উপার্জন করে, সংসারে অভাব কিছুটা দুর করে, এইডা ভালো’ কথাগুলো বলছিলেন নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলায় নিঝুমদ্বীপের বন্দরটিলা এলাকার ভ্যান চালক জয়নাল মিয়া (৩৫)।
স্ত্রী, তিন ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তার সংসার। সংসারে অভাব লেগেই আছে। হাতিয়ার উত্তরাঞ্চলের আদি বাসিন্দা ছিল জয়নাল। নদী ভাঙ্গনের ফলে এখন এসেছেন নিঝুম দ্বীপের বন্দরটিলা এলাকায়। এখন পর্যন্ত কোন জমি বন্দোবস্ত পায়নি জয়নাল মিয়া। কোন রকমে এক টুকরো খাস জমিতে একটি মাত্র ঘর তুলে বসবাস করছে পরিবার নিয়ে। শুকনো মৌসুমে ভ্যান গাড়ি চালায় আর বর্ষা মৌসুমে ধরে মাছ।
নদীর ঘাট থেকে উঁচু-নিচু রাস্তা দিয়ে ভ্যানে ইট বোঝাই করে নিয়ে যাচ্ছে জয়নাল মিয়া। ছোট্ট ৭ বছরের ছেলে জুয়েল ভ্যানের হ্যান্ডেল ধরে ড্রাইভারের সিটে বসে আছে। এত অল্প বয়সে একজন প্রশিক্ষিত ভ্যানচালক হয়ে গেছে ছোট্ট শিশু জুয়েল। উঁচু-নিচু ভাঙ্গা মাটির রাস্তা দিয়ে ঠিকভাবে ভ্যান নিয়ে যাচ্ছে। ভ্যানের পিছনে এক পার্শ্বে বাবা জয়নাল মিয়া, অন্য পাশে বড় ভাই আজিম (৯) ধাক্কা দিচ্ছে। অনেক পরিশ্রমের ফলে পিতা-পুত্রে মিলে সারাদিনে যে আয় হয়, তা দিয়ে তাদের সংসার চলে।
জয়নাল মিয়া জানান, বন্দরটিলা এলাকায় প্রায় ১৫ হাজার লোক বসবাস করে। কিন্তু ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করার তেমন সুযোগ নেই। এখানে সরকারি কোন প্রাথমিক বিদ্যালয় এখন পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি। তবে নিঝুম দ্বীপ এলাকায় ‘হাসি’ এবং দীপ উন্নয়ন সংস্থা’র অর্থায়নে আটটি উপ-আনুষ্ঠানিক বিদ্যালয় আছে। কিন্তু অভাবের কারণে তেমন কেউ পড়তে যায় না সেখানে। ছোট ছোট ছেলেরা বাবার সাথে কাজ করে, আর মেয়েরা মায়েদের সাথে কাজ করে। এ অঞ্চলের মেয়েরা সাধারণত মাছ শুকানোর কাজেই বেশি সময় দেয়। ছোট ছোট মেয়েরা পোনা মাছ সংগ্রহের কাজ বেশি করে। স্যানিটেশন ব্যবস্থা তেমন ভালো না হলেও খুব শিগগিরই ‘হাসি’ নামক একটি সংস্থার মাধ্যমে কেয়ার বাংলাদেশ-এর অর্থায়নে ৩০০টি ঘর (স্যানিটারী পায়খানাসহ) তৈরি করে দেয়া হবে। এলাকায় বাল্যবিবাহের হার অত্যন্ত বেশি। মেয়েরা একটু বড় হলেই বাবা-মা তাদের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। নদী ভাঙ্গন, দারিদ্র্য এবং শিক্ষার অভাবকেই এর জন্য দায়ী করলেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আগামী দিনের নেতৃত্ব তাদের হাতেই ন্যস্ত হবে। তাই তাদের উন্নতি ও সমৃদ্ধির উপর দেশ তথা জাতি নির্ভরশীল। শিশুকালই হচ্ছে মানুষ গড়ার উপযুক্ত সময়। শিশুর মন কাদামাটির মতো। উপযুক্ত যতেœ সে হতে পারে ভেনাসের অপরূপ মূর্তিময় আর অবহেলায় সেই শিশু হতে পারে জাতির জন্য কলংক কিংবা বিপদজনক।
শিশুদের শিক্ষা বিস্তারের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। জানুয়ারি ২০১০ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ২৫৯ কোটি ৭৯ লাখ ২২ হাজার ৯০২টি পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। ২ কোটি ৫৬ লাখ ১ হাজার ১৯৩ জন শিক্ষার্থীকে ৫ হাজার ৬শ’ কোটি টাকা উপবৃত্তি ও মেধাবৃত্তি হিসেবে প্রদান করা হয়েছে। ১৭ হাজার ১৯৬টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মাণ ও মেরামত করা হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া হ্রাস (মাধ্যমিকে ২০০৮ সালে ঝরে পড়া হার ৬১.৩৮%, যা কমে ২০১৭ সালে ৩৭.৮১% এবং উচ্চ মাধ্যমিকে ২০০৮ সালে ঝরে পড়ার হার ৪৬.৮৬%, যা কমে ২০১৭ সালে ১৯.৮৯% হয়েছে। স্কুলে শিক্ষক সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। ২০০৮ সালে শিক্ষক সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৯৭ হাজার ২১১ জন, যা ২০১৭ সালে হয়েছে ৩ লাখ ৬৪ হাজার ৮১৮ জন। সরকারি স্কুল ও কলেজবিহীন প্রত্যেক উপজেলায় ১টি করে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ জাতীয়করণের কার্যক্রম চলছে। ইতোমধ্যে ৪৭টি বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং ৩৯টি কলেজ সরকারি করা হয়েছে। এছাড়াও আরো বিভিন্ন যুগান্তকারী পদক্ষেপ সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া হয়েছে।
সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে দেশের সুবিধাবঞ্চিত, স্কুল বহির্ভূত, ঝরে পড়া এবং শহরের কর্মজীবি দরিদ্র শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে সরকার বহুমুখী কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। এতে দেশের নির্বাচিত ৮৯টি উপজেলায় ৭.৫০ লাখ শিশু শিক্ষার সুযোগ পাবে। দেশের ৮টি বিভাগীয় শহরের কর্মজীবি শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের উন্নততর জীবন অনুসন্ধানে শিক্ষা, নিরাপত্তা ও উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য পর্যায়ক্রমে শিক্ষার্থীদের মৌলিক শিক্ষা প্রদানের কার্যক্রম চলছে। এ সবই সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ।
আন্তজার্তিক একটি জরিপে দেখা যায়, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রাথমিক শিক্ষার শেষ স্তরে শিশুদের টিকে থাকার হার ছিল ৯০ শতাংশের বেশি। আবার উন্নয়নশীল বিশ্বে শহরের তুলনায় গ্রামের মেয়েদের ক্ষেত্রে বাল্য বিবাহের হার দ্বিগুণ ছিল। আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ সামাজিক নিরাপত্তার অভাব এবং সংসারের অসচ্ছলতার কারণে তাদের কন্যা সন্তানকে অল্প বয়সে বিয়ে দেন। এজন্য একদিকে যেমন বাল্যবিবাহের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে মেয়ে শিশুদের একটি বিরাট অংশ লেখাপড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সংসারে অভাবের কারণেও বাবার সাথে কাজে যোগ দিতে হচ্ছে অনেক ছেলে শিশুকে। ফলে এখানেও লেখাপড়ার সুযোগ থেকে বাদ পড়ে যাচ্ছে শিশুরা।
মানব সম্পদ উন্নয়ন ও সরকারের দারিদ্র্য হ্রাসকরণের কৌশলের সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ক্ষেত্রে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। সরকার দেশে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণে আন্তর্জাতিকভাবে অঙ্গিকারাবদ্ধ। এ কারণেই সরকার এখাতে অধিক হারে বরাদ্দ দিয়ে আসছে। প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে আরো সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, ছাত্র-ছাত্রীদের ভর্তির হার বাড়ানো, ঝরে পড়া শিশুদের বিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ সৃষ্টি, শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা জোরদার করা হয়েছে। ফলে প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে বিরাট সাফল্য অর্জিত হয়েছে। আমাদের সকলের উচিত এই অর্জন ধরে রাখা।
বাসস/বাসস ইউনিসেফ ফিচার/মুখা/স্বব/০৯৪৫/আহো/এসএইচ