বাসস ইউনিসেফ ফিচার-১ : প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের সমাজের সম্পদে পরিণত করছে বিপিএফ

145

বাসস ইউনিসেফ ফিচার-১
প্রতিবন্ধী-শিক্ষা
প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের সমাজের সম্পদে পরিণত করছে বিপিএফ
ঢাকা, ২৭ নভেম্বর, ২০১৮ (বাসস) : বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ছোট্ট শিশু পারুল যখন বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন (বিপিএফ)-এর কল্যাণী স্কুলে ভর্তি হতে আসে তখন তার গরীব বাবা-মার সন্তানকে লেখাপড়া শেখানোর মত অর্থ বা সামর্থ কোনটাই ছিল না। কল্যাণী স্কুলে শিশুদের জন্য দুপুরের খাবার দেয়াসহ আরো কিছু সুযোগ সুবিধা দেখে ওর হতদরিদ্র বাবা-মা মেয়েকে স্কুলে দেয়।
স্কুল শুরু পর দেখা যায়, খেলাধূলা বিশেষ করে সাঁতারের প্রতি পাঁচ বছর বয়সী পারুলের ঝোঁক সবচেয়ে বেশি। সেটা দেখে স্কুল কর্তৃপক্ষ প্রথমে স্থানীয় একটি পুকুরে তার জন্য সাঁতার কাটার ব্যবস্থা করে, যাতে পারুল তার দক্ষতা বাড়াতে পারে। শিগগিরই সে জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করা শুরু করে এবং মেডেল অর্জন করে। পরে বিশ্বে বাংলাদেশকেও প্রতিনিধিত্ব করে পারুল, যা একেবারেই অবিশ্বাস্য। গত ২০১১ সালে গ্রীসে অনুষ্ঠিত বিশেষ অলিম্পিকে পারুল অর্জন করে একটি ব্রোঞ্জ মেডেল, ২০১৩ সালে অস্ট্রেলিয়ায় ২টি গোল্ড মেডেল এবং একটি ব্রোঞ্জ এবং ২০১৫ সালে আমেরিকায় একটি গোল্ড মেডেল অর্জন করে। পারুলের এই গৌরবময় সাফল্যে বিপিএফ-এর পক্ষ থেকে পারুলের পরিবারকেও নানা ভাবে সহযোগিতা করা হয়। তাদের ঘর মেরামত করে দেয়া হয় এবং যাতে তারা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারে সেজন্য পারুলের বাবাকে একটি রিকশা ভ্যান ক্রয় করে দেয়া হয়।
পারুলের মা বলেন, আগে আমি এলাকায় ‘পাগলীর মা’ হিসেবে পরিচিত ছিলাম। কিন্তু এখন আমাকে আর সে নামে কেউ ডাকে না। আমি এখন গোল্ড মেডেলিস্টের মা।
সামাজিক ও শারীরিক সব বাধা বিপত্তি উপক্ষো করে রুবায়েত, মুন এবং মামুনসহ আরো অনেক শিশু-কিশোর এখন শিক্ষা গ্রহণ করছে রাজধানীর মিরপুরে অবস্থিত কল্যাণী স্কুলে। প্রায় ৫ শতাধিক ছাত্র-ছাত্রী বর্তমানে এই স্কুলের শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ২৫০ জন ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে যারা কেউ বুদ্ধি প্রতিবন্ধী, কেউ বধির, কেউ অন্ধ আবার কেউ অটিস্টিক। বিপিএফ স্বাভাবিক শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি এই প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে যাতে তারাও একদিন সমাজের একজন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে । কারো বোঝা না হয়ে যেন হয়ে উঠতে পারে সমাজের সম্পদ।
মূলত ১৯৮৪ সালে কয়েকজন নিবেদিত প্রাণ ব্যক্তি এবং পিতা-মাতার অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়ে উঠে বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশন। পরে তারা এই স্কুল চালু করেন। লক্ষ্য ছিল একটাই যাতে সমাজে প্রতিবন্ধী শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
বিপিএফ-এর নির্বাহী পরিচালক ড. শামীম ফেরদৌস বলেন, আমাদের ইচ্ছা হচ্ছে সমাজের পিছিয়ে পড়া এই শিশুদের নিয়ে কাজ করা, যাতে করে তারাও মাথা উঁচু করে নিজেদের অধিকার নিয়ে বাঁচতে পারে এবং তারা যেন সমাজের মূল ধারায় মিশে যেতে পারে। এই ব্যাপারে তিনি তাদের পক্ষ থেকে সব ধরণের সহযোগিতা করার বিষয়ে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
কথা হলো একজন বুদ্ধি প্রতিবন্ধী সন্তানের মা রাবেয়া খাতুনের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমার মেয়ে শামীমা ইসলাম কিছুটা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। এখানে নার্সারীতে পড়ছে। সে নাচের ক্লাসের প্রতি খুবই আগ্রহী। এছাড়াও সে বিভিন্ন নাচের অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করে।
শামীমার মা বলেন, তাকে যখন প্রথম স্কুলে নিয়ে আসি তখন তার বয়স ছিল মাত্র তিন বছর ছয় মাস। এখানে তার অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন ক্লাসে তাকে স্পিচ থেরাপীসহ অন্যান্য শিক্ষা দেয়া হয় যার ফলে সে এখন কথা বলতে পারে এবং নিজের অনেক কাজ নিজেই করতে পারে। রাবেয়া বলেন, বর্তমানে নয় বছর বয়সী শামীমা বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের নাচের প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করছে।
আরেক মা শাহীন সুলতানা বলেন, আমার ছেলে জহির উদ্দিনের বয়স এখন বার বছর। ওর খুব অল্প বয়সেই আমরা বুঝতে পারি যে আমাদের সন্তান বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। আর ওর বয়স যখন মাত্র চার বছর তখন আমার স্বামী আমাকে ছেড়ে চলে যায়। এর ফলে আমি আরো দিশেহারা হয়ে পড়ি। এই ছেলেকে নিয়ে আমি কী করব? কোথায় যাব? এখনও যখনই এসব চিন্তা মাথায় আসে আমি খুব হতাশ হয়ে পড়ি। তবে ভরসা খুঁজে পাই যখন দেখি জহির কিছুটা উন্নতি করছে।
বিপিএফ-এর কাউন্সিলর নুসরাত জাহান জানান, ২০১৬ সালে ৩০৬ জন শিশুর পরিবারকে প্রতিষ্ঠান হতে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়।
স্কুলের শিক্ষক মেহফুজা ইসলাম বলেন, শিক্ষার্থীর সংখ্যা আরো বাড়ানোর লক্ষে স্কুলের পক্ষ থেকে প্রতিদিন শিক্ষার্থীদের দুপুরের একবেলা পুষ্টিকর খাবার দেয়া হয়। আর এই খাদ্য প্রদান কর্মসূচির ফলে অনেক গরীব পরিবার তাদের সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছে। তিনি বলেন, বিপিএফ শুধুমাত্র প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা প্রদান করে না, কল্যাণী গ্রাজুয়েটদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতেও সহযোগিতা করে।
বাসস/ইউনিসেফ ফিচার/কেটিকে/আরজি/১৪২৫/আহো/এসএইচ