ভোলার চরাঞ্চলের মানুষের জীবন বাঁচায় কমিউনিটি ক্লিনিক

375

ভোলা, ২৫ নভেম্বর, ২০১৮ (বাসস) : জেলার প্রমত্তা মেঘনা নদীর দুর্গম চরাঞ্চলে সাধারণ মানুষের জীবন বাচাঁয় কমিউনিটি ক্লিনিক। উপজেলা সদর, দৌলতখান, তজুমদ্দিন, মনপুরা ও চরফ্যাসন উপজেলার ১১টি বিচ্ছিন্ন চরে স্বাস্থ্য সেবার মান উন্নয়ন নিশ্চিত করছে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ এ উদ্যোগ। প্রত্যন্ত এসব এলাকার লাখো মানুষ আজ কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে সঠিক চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন। তাই ঘরের পাশে অসুখ-বিসুখের প্রতিকারমূলক চিকিৎসা সেবা পেয়ে আনন্দিত পিছিয়ে পড়া বিশাল এ জনগোষ্ঠী।
এতে করে দূর্যোগ ঝুঁকির মধ্যে থাকা চরাঞ্চলে কমে এসেছে শিশু ও মাতৃ মৃত্যুর হার। এছাড়া গর্ভকালীন, প্রসব পরবর্তী, নবজাতক শিশু, কিশোর-কিশোরী, রোগ প্রতিরোধে টিকা, পরিবার পরিকল্পনা সেবাসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সহায়তায় কমিউনিটি ক্লিনিকই এখন পরম ভরসাস্থল চরের মানুষের। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকা সংগ্রামী চরবাসীর কাছে আর্শিবাদ হয়ে দেখা দিয়েছে প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিক।
জেলা সিভিল সার্জন অফিস সূত্র জানায়, বিচ্ছিন্ন চরে কমিউনিটি ক্লিনিকের মধ্যে সদর উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের চরসুলতানী ও কাচিয়া ইউনিয়নের মাঝের চরে ১টি করে ২টি ক্লিনিক রয়েছে। দৌলতখানের মদনপুর ইউনিয়নের চরকালী ও চরমনসা চরে ২টি। চরফ্যাশনের মুজিবনগর ইউনিয়নের চরে ১টি ক্লিনিক, চর কুকরি-মুকরিতে ২টি, ঢালচরে ১টি ক্লিনিক রয়েছে। তজুমদ্দিনের সোণাপুর ও মংলাচরা ইউনিয়নের চরে ১টি করে ২টিসহ মনপুরারা উপজেলার চর কলাতুলিসহ মোট ১১ টি দুর্গম চরে কমিউনিটি কিøনিক স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দিচ্ছে মানুষের কাছে।
জেলার সর্ব দক্ষিণের উপজেলা বিচ্ছিন্ন মনপুরা। এ মনপুরা ইউনিয়নের দুর্গম এক চর কলাতুলি। স্থানীয় তুলাতুলী কাটা খাল এলাকা থেকে ট্রলারে মেঘনা পাড়ি দিয়ে কলাতুলিতে আসতে সময় লাগে দেড় থেকে সোয়া এক ঘন্টা। মনপুরা ইউনিয়নের ৪টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত চরটিতে প্রায় ২৫ হাজার জনসংখ্যা। ৩০ বছরের মত হলো কলাতুলিতে জনবসতি গড়ে উঠেছে। সরেজমিনে দ্বীপটিতে গিয়ে দেখা যায় স্থানীয়দের প্রধান পেশা মাছ ধরা ও কৃষিভিত্তিক। দ্বীপটিতে রয়েছে সাইক্লোন সেল্টার, আশ্রয়ণ প্রকল্প, কমিউনিটি ক্লিনিক, প্রাথমিক বিদ্যালয়, হাট বাজারসহ বিভিন্ন স্থাপনা।
স্থানীয় মনির বাজারের চর কলাতুলি কমিউনিটি ক্লিনিকে গিয়ে দেখা যায় রোগীদের ভিড় রয়েছে। একজন স্বাস্থ্য কর্মীর পক্ষে অনেক সময় হিমশিম খেতে হয় চিকিৎসা সেবা দিতে। ক্লিনিকের দায়িত্বে থাকা স্বাস্থ্য কর্মী মো. আজাদ বাসস’কে জানান, গত জানুয়ারি থেকে ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত এ ক্লিনিকে ১০ হাজার ২৩১ জন রোগীকে সেবা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সাধারন রোগী ৯ হাজার ১৩৫, মাতৃস্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনার ৬২৬ এবং নবজাতক ও শিশু রোগী রয়েছে ৪৭০ জন। একইসাথে চলতি মাসের ২৪ দিনে ১ হাজার জন রোগীকে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়েছে। ওষুধের পাশাপাশি রোগীদের বিভিন্ন রোগ নিয়ন্ত্রণে সচেতনতামূলক পরামর্শ সেবা দেওয়া হয় বলে জানান এ স্বাস্থ্য কর্মী।
কমিউনিটি ক্লিনিকে সেবা নিতে এসেছেন কাজল রেখা (৩২) তার মা বিরঙ্গ বালা দাস (৭৫) কে নিয়ে। কাজল বাসস’কে বলেন, তার মায়ের ঠান্ডায় জ্বর ও শ্বাস কষ্ট দেখা দিয়েছে। তাই ওষুধ নিতে এসেছেন। তিনি ও তাদের পরিবারের সকল সদস্য যে কোন সমস্যায় এখান থেকেই চিকিৎসা করান বলে জানান তিনি। মাইনুর বেগম (৪০), হোসনে আরা (৪৮) ও রাবেয়া বেগম (৫৪) জানান, কমিউনিটি ক্লিনিক আছে বলেই এখন শান্তিতে আছেন। সামাণ্য জ্বর হলেই সরকারিভাবে ওষুধ পাই। এজন্য সরকার প্রধানকে ধন্যবাদ জানান তারা।
এছাড়া ক্লিনিকে আসা আকিউল্লাহ মিয়া (৭২), আজিজুল ব্যাপারী (৬০), মোতাছিন বিল্লাহ (৭৫), হাসেম আলী (৩৫), মাকসুদ হাওলাদার (২৩), খোকন হোসেন (২৫) বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিক থাকাতে চরের মানুষের দুর্ভোগ অনেকটাই লাঘব হয়েছে। আগে যে কোন অসুস্থতায় মনপুরা যেতে হতো অথবা গ্রাম্য ডাক্তার দেখাতে হতো। এতে সময়, অর্থ ও স্বাস্থ্য সবটারই ক্ষতি হতো। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে সবচে বেশি সমস্যায় পড়তে হতো। এখন ১২ মাসই চরে স্থায়ী চিকিৎসা ব্যবস্থা। একইসাথে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য সেবারও উন্নতি ঘটছে বলে জানান তারা।
এখানকার মৎস্য ব্যবসায়ী মো. আলাউদ্দিন (৪২) বাসস’কে বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিক থাকাতে মানুষের জন্য জীবন যাপন অনেক সহজ হয়েছে। আগে কেউ অসুস্থ হলে উত্তাল মেঘনা পাড়ি দিয়ে উপজেলায় যেতে হতো, আর এখন ঘরের কাছেই বিনামূল্যে চিকিৎসা। চরের মানুষের কাছে যা একসময় ছিলো স্বপ্নের মতন। তিনি বলেন, এ চরে যে পরিমাণ বাসিন্দা তাতে একটি ক্লিনিক দিয়ে চিকিৎসা দেয়া কষ্টকর। আরো একটি ক্লিনিক নির্মাণের দাবি জানান।
উপজেলা সদরের রাজাপুর ইউনিয়নের রামদাসপুর চরের (সিএইচসিপি) দায়িত্বরত স্বাস্থ্য কর্মী মো. মোতালেব বাসস’কে বলেন, জ্বর, সর্দি, কাশি, নিউমনিয়া, সাধারন জখম ইত্যাদির প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়। চরের মানুষ পরিবার পরিকল্পনার ব্যাপারে পূর্ণ ধারণা এখান থেকেই পাচ্ছে। ফলে এখান্ওে এখন বহু পরিবার পরিকল্পিত পরিবারের দিকে ঝুঁকছেন। সরকারের ব্যাপক প্রচারণায় মানুষ কু-সংস্কার থেকে মুক্ত হচ্ছেন। দৈনিক তার এখানে ৪০ থেকে ৫০ জন রোগী সেবা গ্রহণ করে বলে জানান তিনি।
জেলা সিভিল সার্জন ডা. রথীন্দ্রনাথ মজুমদার বাসস’কে বলেন, খুব বড় ধরনের কোন সমস্যা না হলে চরের মানুষ এখন কমিউনিটি ক্লিনিকের চিকিৎসা সেবাতেই ভালো আছেন। স্থানীয়ভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধির উপর নির্ভর করে কমিউনিটি ক্লিনিক’র সংখ্যা। স্থানীয়ভাবে যদি কেউ জমি দানে আগ্রহ ও সংশ্লিষ্ট’র কাছে আবেদন করে তবে কর্তৃপক্ষ ক্লিনিক স্থাপনে কাজ করবে। নতুন ক্লিনিকগুলো হবে দু’তলা ও অত্যাধুনিক। সেখানে ডেলিভারী রুমসহ স্বাস্থ্য সেবার বিভিন্ন নতুন বিষয় যুক্ত থাকবে।
সিভিল সার্জন আরো বলেন, চরাঞ্চলের মানুষের কাছে ক্লিনিকের গুরুত্ব অনেক বেশি। কারণ বর্ষা মৌসুমে উত্তাল মেঘনা পাড়ি দেয়া অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। তখন কমিউনিটি ক্লিনিকই তাদের ভরসাস্থলে রূপ নেয়। এছাড়া দুর্গম চরের ক্লিনিকগুলো অচিরেই সংস্কার করা হবে বলে জানান জেলার স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান এ কর্মকর্তা।