বাসস ইউনিসেফ ফিচার-২ : ‘আলোয়’ উদ্ভাসিত কুড়িগ্রামের বিধবা নারীরা

133

বাসস ইউনিসেফ ফিচার-২
বিধবা-স্বাবলম্বী
‘আলোয়’ উদ্ভাসিত কুড়িগ্রামের বিধবা নারীরা
ঢাকা, ২৪ নভেম্বর, ২০১৮ (বাসস) : মাত্র ১৪ বছর বয়সে সাধনা রানীর বিয়ে হয়েছিল কুড়িগ্রামের দীননাথের সঙ্গে। তাদের ঘর আলোকিত করে পর পর জন্ম নেয় দুটি ছেলে সন্তান। কিন্তু সুখ বেশি দিন স্থায়ী হয়নি কাঠ মিস্ত্রির সংসারে। শরীরে টিউমার বাসা বাঁধে তার। দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর দীননাথ মারা যায় ২০১৩ সালে। স্বামীকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে গিয়ে সাধনা রানীকে সর্বশান্ত হতে হয়। বিধবা হয়ে তিনি আরও অসহায় পড়েন। পাশে এসে কেউ দাঁড়ায়নি। অষ্টম ও তৃতীয় শ্রেণীতে পড়–য়া দুই সন্তানের মা ঝিয়ের কাজ নিতে বাধ্য হন। এছাড়া অন্য উপায় ছিল না।
উদ্যম ও চেষ্টা তার বিফল হয়নি। তিনিই এখন ওই সংসারের অভিভাবক। স্থানীয় সরকার ও একটি এনজিও থেকে ব্যবসার প্রশিক্ষণ নেন সাধনা রানী। একটি এনজিও থেকে ২০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে জীবন সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। ঋণের টাকায় ছয় শতক জমি বন্ধক নিয়ে চাষাবাদ শুরু করেন। নিজের টাকায় একটি বকনা গরু ও ছাগল কিনে লালন পালন করছেন। সচল রেখেছেন সন্তানদের লেখাপড়াও। স্বাবলম্বী হওয়ার মন্ত্র ও কাজ করার প্রাথমিক পুঁজি পেয়েছেন ‘ইসলামিক রিলিফ বাংলাদেশ’ নামের একটি এনজিও থেকে। এরপর সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় কাজ করে তিনি সফলভাবে সংসার চালাতে পারছেন। সাধনা রানীর মত ৭৯০ জন বিধবা নারী এখন যার যার সংসারের অভিভাবক।
দেশের সীমান্তবর্তী জেলা কুড়িগ্রাম। ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তাসহ ১৬টি নদ-নদীর অববাহিকা বিশিষ্ট এই জেলার অধিকাংশ এলাকা দীর্ঘ সময় বন্যায় তলিয়ে থাকে। এক সময় বন্যায় ডুবে ব্যাপক ফসলহানি, আবার আরেক সময় খরার ছোবলে ছিন্নভিন্ন হয়। প্রাকৃতিক কারণেই এ অঞ্চলের মানুষ চরম দারিদ্র্যপীড়িত। সংসার চালানোর জন্য অনেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কাজের খোঁজে দূর দূরান্তে চলে যান। এ অঞ্চলের প্রতি বাড়িতে সব মানুষের শরীরেই অপুষ্টি ও দারিদ্র্যের ছাপ দৃশ্যমান। যে মহিলার স্বামী নেই, যে সন্তানের পিতা নেইÑ তাদের জীবন কীভাবে কাটে, তা সহজেই অনুমেয়। তাদের দুর্বিষহ জীবনের কিছুটা শান্তির প্রলেপ দিতে পেরেছে ইসলামিক রিলিফের ‘আলো’।
ত্রাণ ও উন্নয়নমূলক কর্মকা-ে নিবেদিত যুক্তরাজ্য ভিত্তিক সংস্থা ইসলামিক রিলিফ ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশে তাদের যাত্রা শুরু ১৯৯১ সালে। এতিমদের জীবন মান উন্নয়নে ইসলামিক রিলিফ বাংলাদেশের ‘অলটারনেটিভ অরফান ফ্যামিলি স্পন্সরশীপ প্রোগ্রাম থ্রু সাসটেইনেবল লাইভলিহুডস’ সংক্ষেপে ‘আলো’ চালু হয় ২০১৪ সালে। ৭৯০টি এতিম পরিবারকে ৪৮ মাস ব্যাপী সেবা প্রদান করার কর্মসূচি এটি। কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলোর বুড়াবুড়ী, দুর্গাপুর, পান্ডুল, হাতিয়া, ধরনীবাড়ী ও দলদলিয়া ইউনিয়নের মোট ৭৯০টি পরিবার এই ‘আলো’য় আলোকিত।
প্রথম দিকে ইসলামিক রিলিফ এনজিওর কারণে তাদের জীবনের বাঁক নিতে শুরু করে। হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরে পান তারা। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের শিকার এসব বঞ্চিত মানুষ ক্রমে ক্রমে সংগঠিত হতে থাকেন। তাদের অধিকাংশই নিজ নিজ অধিকার সম্পর্কে সচেতন ও আত্মপ্রত্যয়ী হয়েছেন। ফলে আলোর সহযোগিতায় সরকারের অন্যান্য সুবিধাগুলোও সঠিকভাবে বুঝে নিতে পারছেন তারা। এখন তারা সরকারি বিধাব ভাতা, কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ, দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে স্থানীয় সরকারের বিশেষ প্রকল্পে কাজের সুযোগ, সরকারের ক্ষুদ্র ঋণ সহায়তা পাচ্ছেন।
এভাবে বদলে গেছে অসহায়দের মানবেতর জীবন। সহযোগিতার টাকা নিয়ে জমি বন্ধক রাখা, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগী পালন, কৃষি কাজ, মুদি দোকান, ছোট-খাট ব্যবসা বাণিজ্য করছেন সুবিধাভোগীরা। পাশাপাশি বৃত্তি নিয়ে সন্তানদের লেখাপড়াও চালিয়ে নিতে পারছেন তারা।
বঞ্চিত বিধবারা এখন ফেলনা নন। তারা সংগঠিত শক্তি। ওই এনজিওর সেবা মডেল অনুসারে গঠন করা হয়েছে স্বাবলম্বন দল। যার মধ্যে রয়েছে ৫৪টি স্বনির্ভর দল, ৬টি নারী ফোরাম । এদের একটি মুন্সিপাড়া স্বাবলম্বন দল। ১১ সদস্য বিশিষ্ট দলে রয়েছে প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ পূর্ণাঙ্গ কমিটি। এ দলের সভাপতি জানান, স্বামী মরে যাওয়ার পর অনিশ্চয়তার অন্ধকারে পড়ে হাবুডুবু খেতে হচ্ছিল। সেই দুঃসময়ে মহা সংকটের কোনো কূলকিনারা করতে পারিনি। ‘আলো’য় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর জীবন ধীরে ধীরে বদলে গেছে। এখন সরকারি অনুদান ও বিভিন্ন প্রকল্পে আমরা দল বেঁধে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা অফিস থেকে সুবিধাগুলো জানতে পারি এবং তা ভোগ করতে পারছি। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে স্বনির্ভর হতে পেরেছি আমরা। এই অসহায় এতিম নারীরাই যাতে স্থায়ীভাবে স্বচ্ছল থাকতে পারে, সেই লক্ষ্যে ইউনিয়ন নারী ফোরাম, শিশু ক্লাব, শিশু শিক্ষা ইত্যাদি গঠন করা হয়েছে। নিজস্ব উদ্যোগে এতিমরাই এগুলোর কার্যক্রম সচল রেখেছে।
উলিপুরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ শফিকুল ইসলাম এই প্রতিবেদককে বলেন, দারিদ্র্যপীড়িত উলিপুরের বড় সমস্যা বাল্য বিবাহ। এখানে শিক্ষার হারও কম। সরকারি ও বেসরকারি প্রচেষ্টায় এই অবস্থার উন্নতি ঘটছে। দারিদ্র্য বিমোচনে ইসলামিক রিলিফের বিভিন্ন কর্মকা- এক্ষেত্রে রোল মডেলের ভূমিকা পালন করছে।
আলো প্রকল্পের প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর খবিরুল হক কামাল বলেন, এতিমদের সহায়তা করার জন্য এতিমখানা রয়েছে। কিন্তু সেখানে তাদের বন্দী জীবন যাপন করতে হয়। সমাজের মধ্যে তাদেরকে গড়ে তোলার জন্য আলো কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। স্বনির্ভর দলগুলো এতিম পরিবারগুলোর জন্য সক্রিয় প্লাটফর্মে পরিণত হয়েছে। তাদের সক্রিয়তায় এতিমরা সমাজে তাদের মর্যাদা পুনরুদ্ধার করছে।
বাসস/ইউনিসেফ ফিচার/কেটিকে/হাহা/১৩১৫/আহো/এসএইচ