বাজিস-১ : সুন্দরবনকে প্রধানমন্ত্রীর ‘দস্যুমুক্ত’ ঘোষণা : জেলেদের মনে স্বস্তি

186

বাজিস-১
বরগুনা-দস্যুমুক্ত ঘোষণা
সুন্দরবনকে প্রধানমন্ত্রীর ‘দস্যুমুক্ত’ ঘোষণা : জেলেদের মনে স্বস্তি
বরগুনা, ২ নভেম্বর, ২০১৮ (বাসস) : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবনকে ‘দস্যুমুক্ত’ ঘোষণা করেছেন। বৃহস্পতিবার ঢাকায় সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বাগেরহাটে জলদস্যুদের একটি আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে এ ঘোষণা দেন সরকার প্রধান। এ ঘটনায় মৎস্য শিকার ও বাণিজ্যের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও জেলেদের মনে সাহস ফিরে এসেছে।
গত কয়েক বছরে সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দস্যুবৃত্তি দমন ও দস্যুদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার উদ্যোগে উপকূলের জেলেদের মনে জলদস্যুদের নিয়ে ভয় এমনিতেই কমে গিয়েছিল। গভীর সাগর এবং উপকূলে জলদস্যু দমনে সরকারের আইন-শৃংখলা বাহিনীর বিশেষ প্রচেষ্টা এবং গত কয়েক বছরে জল ও বনদস্যুদের আত্মসমর্পণ এবং দস্যুবৃত্তি থেকে অনেক দস্যুর স্বাভাবিক জীবনে প্রত্যাবর্তন সাগর যাত্রাকে দিনে দিনে নিরাপদ করেছে।
বাংলাদেশে সুন্দরবনের প্রায় ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার বনাঞ্চলের পাশাপাশি দেশের উপকূলীয় এলাকাগুলো ঘিরে জলদস্যুতার ইতিহাস অনেক পুরনো। জেলেদের ট্রলার ছিনতাই করে মাঝিদের আটক রেখে মুক্তিপণ আদায়, বিভিন্ন পেশার বনজীবীদের অপহরণ ও ডাকাতির মাধ্যমে বিভিন্ন দস্যুদল উপকূলীয় জেলাগুলোয় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল।
উপকূলীয় এলাকায় দস্যুতা দমনে ২০১২ সালে র‌্যাব, পুলিশ, কোস্টগার্ড, বিজিবি ও বন বিভাগকে নিয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠন করে সরকার। এরপর র‌্যাবসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ২২৩টি অভিযানে অন্তত ১৩৫ জন সন্দেহভাজন জলদস্যু ও বনদস্যু নিহত হয়, গ্রেফতার হয় পাঁচ শতাধিক লোক। পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থাপনায় ২০১৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত ২৬টি দস্যু দলের ২৭৪ জন আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে।
র‌্যাব ৮ সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনের ছয়টি দস্যুবাহিনীর ৫৪ জন সদস্য স্বাভাবিক জীবনে ফেরার অঙ্গীকার করে (গতকাল) ১ নভেম্বর বৃহস্পতিবার, বাগেরহাটের শেখ হেলাল উদ্দিন স্টেডিয়ামে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করেন। এ নিয়ে সুন্দরবনের মোট ৩২ বাহিনীর ৩৩০ বনদস্যু আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এলো। আত্মসমর্পণকারী বাহিনীগুলোর মধ্যে আনোয়ারুল বাহিনীর আট সদস্য, তৈয়াবুর বাহিনীর পাঁচ, শরিফ বাহিনীর ১৭, ছাত্তার বাহিনীর ১২, সিদ্দিক বাহিনীর সাত ও আল আমিন বাহিনীর পাঁচ সদস্য রয়েছেন। তারা ৫৮টি অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ও তিন হাজার ৩৫১টি গোলাবারুদ জমা দেন।
বৃহ¯পতিবার আত্মসমর্পণ করা ৫৪ জনকে তাৎক্ষণিকভাবে অর্থ সহায়তা হিসেবে এক লাখ টাকা করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে তাদের পুনর্বাসনের জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। সরকারপ্রধান বলেন, ‘তারা যে যে কাজ করে খেতে চান নিজের গ্রামে বসে, সেই কাজ করার মতো উপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা আমরা করে দিচ্ছি। ফলে অনেকেই এখন সেই জঙ্গলের দস্যুবৃত্তি, ওই অস্বাভাবিক জীবন থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন, নিজের পরিবারের সঙ্গে বসবাস করছেন।’
অতীতের বছরগুলোর তুলনায় সাগরে জলদস্যুদের উৎপাত নেহায়েতই কম। এ কারণে জেলেরা নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। গত ৫ বছরে র‌্যাব সদস্যরা সুন্দরবনে জলদস্যুদের আস্তানায় হানা দিয়ে জলদস্যু নির্মূলে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। সাগর-নদীতে কোস্টগার্ডের জোরালো টহলে জলদস্যুদের বিচরণক্ষেত্র অনেকটাই গুটিয়ে গিয়েছে। আলাপকালে জানালেন, জেলা ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী।
ইলিশ মৌসুমে সাগরে জেলেদের মৎস্য আহরণ নিরাপদ করার জন্য বঙ্গোপসাগরের চরেও (মেহের আলী পয়েন্ট) র‌্যাব’র অস্থায়ী ক্যা¤প স্থাপন করা হয়েছে। সুন্দরবনের খালগুলোতে জোরদার টহল থাকে। জলদস্যু নির্মূলে আইন-শৃংখলা বাহিনীর এর অব্যাহত অভিযানে সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় দস্যু মাস্টার বাহিনী আগেই আত্মসমর্পণ করেছে। দস্যুদরা চাচ্ছে আত্মসমর্পণ করতে। জলদস্যু বাহিনীগুলো নিশ্চিহ্ন হচ্ছে। বিগত বছরগুলোর তুলনায় গভীর সাগর, উপকূলের তীরবর্তী এবং নদ-নদীর জেলে সংখ্যাও বেড়ে গেছে বলে জেলেরা আলাপ কালে জানিয়েছেন। নদী-সাগর হাতছানি দিয়ে ডাকে জেলেদের। সারা বছরের ধার-দেনা শোধ করাসহ জীবিকা নিশ্চিত করতে জেলেরা সাগরে যায় রূপালী ইলিশ শিকারে। ব্যস্ততা থাকে আড়তদার, ট্রলার মালিক এবং সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যেই। উপকূলীয় জেলেরা আগেই নৌকা-ট্রলার গড়া, মেরামত, জাল-দড়ি, রসদ সামগ্রী নিয়ে সমুদ্রে যাওয়ার প্রস্তুতি শেষ করেছিল। অনেকেই এখন নির্বিঘেœ ও নিরাপদে সাগরে যাওয়া আসা করছে। ব্যস্ততা বেড়েছে জেলে পল্লীগুলোতে। দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ বরগুনার পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে পাইকাররা আসছেন। চলছে বরফকলগুলোও। ভোজন বিলাসী বাঙালীর পাতে ইলিশ তুলে দেয়ার দায়িত্ব যে এ জেলেদেরই।
বরগুনা জেলা মৎস্য দপ্তরের তথ্যানুযায়ী, জেলার ৬ টি উপজেলায় মোট ২৯ হাজার ৫৪১টি জেলে পরিবার রয়েছে। বরগুনা সদরে ৭ হাজার, আমতলী উপজেলায় ৭ হাজার ২০০, পাথরঘাটায় ৯ হাজার ৭১ জন, বামনায় ১ হাজার ১০০ ও বেতাগী উপজেলায় ৪ হাজার ১৭০টি জেলে পরিবার বাস করে। তবে বেসরকারিভাবে জেলেদের সংখ্যা আরও বেশী। বংশ পর¤পরায় পেশাজীবী এসব জেলেদের জীবিকার প্রধান উৎস বঙ্গোপসাগর ও স্থানীয় নদ-নদী।
বরগুনার জেলে সমিতির সভাপতি আবদুল মান্নান জানিয়েছেন, গত কয়েক মৌসুমে ইলিশের আকাল, জলদস্যুদের হামলা ও অপহরণের শিকার হয়ে ঋণের দায় বেড়েছিল বেশ। সে অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। ইলিশ শিকারে ব্যর্থ হওয়া যাবে না। লাভের মুখ দেখতেই হবে।
বরগুনার পুলিশ বিভাগ জানিয়েছে, স্থলভাগে জলদস্যুদের সোর্সদের আটক করার জন্য পাথরঘাটা উপজেলার পদ্মা ¯¬ুইজ এলাকায় অস্থায়ী পুলিশ ক্যা¤প স্থাপন করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে এখানকার কমপক্ষে সাত জলদস্যু নিহত হয়েছে। অনেকে দস্যু কারাগারে রয়েছে। জলদস্যু নির্মূলে পুলিশের অভিযানও অব্যাহত রয়েছে।
দস্যুতা প্রতিরোধে রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত এক সময়ের ইউপি চেয়ারম্যান, পরবর্তীতে বরগুনার সাংসদ ও বর্তমান জেলা চেয়ারম্যান মো. দেলোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, ‘একটি সুখী সম্মৃদ্ধ দেশ গড়তে মাননীয় প্রধামমন্ত্রী শেখ হাসিনা অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক নিরাপত্তা দিতে তার উদ্যোগগুলো বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। সুন্দরবন ‘দস্যুমুক্ত’ ঘোষণায় উপকূলের মানুষের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সুদৃঢ় হলো।’
বাসস/সংবাদদাতা/১২৪৫/বেউ/-নূসী