শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কঠোর হুঁশিয়ারি

1024

ঢাকা, ১১ মে, ২০১৮ (বাসস) : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে কোন প্রকার নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেছেন, তাঁর সরকার এ ধরনের অপরাধ কোনভাবেই বরদাশত করবে না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি আমাদের ছাত্রদের বলবো কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোন ধরনের ভাংচুর করা চলবে না। ছাত্ররা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভাংচুর করবে এটা আমি বরদাশত করবো না।
তিনি বলেন, ‘কারণ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্বায়ত্তশাসন থাকলেও সেগুলো চালাতে সকল খরচ সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘যদি কেউ ভাংচুর করে, সেখানে আমার কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর প্রতি নির্দেশ রয়েছে- সে দলের হোক, আর যেই হোক কাউকে ছাড়া হবে না, তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিকেলে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ২৯ তম জাতীয় সম্মেলন উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।
ছাত্রলীগ সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, ছাত্রলীগের সহ সভাপতি এবং নতুন কমিটি নির্বাচনে গঠিত নির্বাচন কমিশনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার আরিফুর রহমান লিমন, সম্মেলন আয়োজক উপকমিটির আহবায়ক ছাত্রলীগ সহসভাপতি কাজী এনায়েত হোসেন, অভ্যর্থনা উপকমিটির আহবায়ক ইমতিয়াজ বুলবুল বাপ্পি অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন।
সংঠনের সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসেন অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন এবং সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্ট উপস্থাপন করেন। দপ্তর সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন শাহজাদা অনুষ্ঠানে শোক প্রস্তাব পাঠ করেন।
এরআগে প্রধানমন্ত্রী জাতীয় পতাকা উত্তোলন এবং পায়রা ও বেলুন উড়িয়ে সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। ছাত্রলীগের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক এ সময় দলীয় পতাকা ওড়ান।

প্রধানমন্ত্রী তাঁর এদিনের ভাষণে সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের বাসভবন ভাংচুরের সমালোচনা করে রাজনীতির নামে শিক্ষকদের দলাদলী পরিহার এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধ করার জন্যও শিক্ষার্থীদের প্রতি আহবান জানান।
তিনি সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে তাঁর সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির পুনরোল্লেখ করে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ এবং মাদক থেকে শিক্ষার্থীদের দূরে থাকার আহবান জানান।
প্রধানমন্ত্রী সবাইকে রাস্তায় চলাচলের জন্য ট্রাফিক আইন মেনে চলা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সহ সর্বত্র পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার জন্যও সকলকে পরামর্শ দেন।
কোটা সংস্কারের দাবিতে ঢাবির ভিসির বাংলোতে হামলা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বাড়িতে আক্রমণ করা হলো- আমরাওতো আন্দোলন করেছি, সেই ’৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলন। স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিলে চলে এসেছি। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়েছি আন্দোলনে ছিলাম। ভিসির বাড়ি ভিতরে ঢুকে তার রুমে লুটপাট করা, রুম ভাঙ্গা, তাঁকে ধাক্কা দেওয়া এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনা কোন ইতিহাসে ঘটে নাই।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তদন্ত চলছে, ইতোমধ্যে অনেকে ধরা পড়েছে এবং আরো ধরা পড়বে। এরসঙ্গে যারাই জড়িত আর ঐ লুটপাট যারাই করেছে তাদের বিরুদ্ধেও যথাযথ ব্যবস্থা নিতে আমি নির্দেশ দিয়েছি।
তিনি বলেন, আর কথায় কথায় দাবি করলেতো হবে না। একটা দেশের কল্যাণ কিভাবে করতে হয়, উন্নয়ন কিভাবে করতে হয়, কিভাবে শিক্ষার মান উন্নত করতে হয়, শিক্ষার পরিবেশ কিভাবে রক্ষা করতে হয়, কিভাবে শিক্ষিত জাতি গড়ে তুলতে হয়, আমরা তা ভালই জানি। আর জানি বলেই আজকে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি ধন্যবাদ জানাবো আজকে ছাত্রলীগসহ অন্যান্য সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের, যে অন্তত শিক্ষার পরিবেশটা তারা বজায় রাখতে পেরেছে।
তিনি বলেন, এই নয় বছরে দু’একটা ঘটনা ছাড়া এমন কোন ঘটনা ঘটে নাই এবং ভিসির বাড়িতে আক্রমণ, শিক্ষকদের অপমান করা- এ ধরনের কোন ঘটনা আমি আর চাই না এখানে ঘটুক।
প্রধানমন্ত্রী শিক্ষকদের উদ্দেশে বলেন, শিক্ষকদেকেও আমি বলবো- শিক্ষকরা শিক্ষকদের বিরুদ্ধে লাগবে আর তারা দ্বন্দ্ব করবে আর তার ফল ছাত্ররা ভোগ করবে, সেটাও আমি চাই না। শিক্ষকরা যদি শিক্ষকদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়ায় তাহলে ছাত্ররা শিখবেটা কি?
তিনি আরো বলেন, কারো যদি কিছু বলার থাকে বলবেন, আমরাতো দেখবো।
তিনি দিনে ৫/৬ ঘন্টা ছাড়া সমস্ত দিন দেশের কাজে ব্যয় করেন এবং যে কেউ যেকোন সমস্যা নিয়ে তার কাছে গেলে এর প্রতিকারে সবরকম ব্যবস্থা গ্রহণ করেন উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, তবে, কোন কিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি করা আমরা কিন্তু বরদাশত করবো না।
ডিজিটাল প্রযুক্তি ধ্বংসাত্মক কাজে ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকার আহবান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ করেছি। আমাদের ছেলে-মেয়েরা যেন এ থেকে শিক্ষা-দীক্ষা গ্রহণ করে তার জন্য। এটাকে অপব্যবহার করার জন্য নয়। সেই কারণে ছাত্রলীগের ছেলে-মেয়ে সকলের ওপরে যেমন আমার নির্দেশ, সেই সাথে সাথে সকল ছাত্র সমাজ-জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, মাদকাসক্তি থেকে দূরে থাকতে হবে। এ ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপের সঙ্গে কেউ যেন সম্পৃক্ত না হয়।
তিনি বলেন, যদি কেউ হাতেনাতে ধরা পড়ে তাহলে তাকে যেমন বহিষ্কার করা হবে, সাথে সাথে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
‘ইতোমধ্যে আমি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী থেকে শুরু করে র‌্যাব- সকলকে নির্দেশ দিয়েছি, যেখানেই মাদক এবং যেখানেই সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার,’বলেন প্রধানমন্ত্রী।

কাউন্সিলে সমঝোতার ভিত্তিতে নতুন নেতৃত্ব বেছে নেয়ার আহবান জানিয়ে শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের নেতা হওয়ার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বয়সসীমা ২৭ বছর থেকে বাড়িয়ে ২৮ বছর করে দেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগামীকাল (শনিবার) সেন্ট্রাল কমিটি বসবে। আমি চাই, সমঝোতার মাধ্যমে তোমাদের নেতৃত্ব নিয়ে আস।
তিনি বলেন, ‘তোমরা নিজেরা বসে সমঝোতার ভিত্তিতে নেতৃত্ব নিয়ে আস। মনে রেখ, সেক্রিফাইস করাটা শিখতে হবে। সেক্রিফাইস না করলে অর্জন করা যায় না। অর্জন তখনই করতে পারবা, যখন কিছু দিতে পারবা। কাজেই তোমরা সমঝোতার মাধ্যমে কর সেটাই আমরা চাই।’
নেতৃত্ব নির্বাচনে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘তোমরা এমন নেতৃত্ব খুঁজবে, যারা তোমাদের সঠিক নেতৃত্ব দিয়ে সংগঠনকে আরও শক্তিশালী করতে পারে। জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা হিসেবে আগামী দিনে যেন তোমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পার।’
সততার সঙ্গে রাজনীতি করার আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, ‘রাজনীতিতে সততা, নিষ্ঠা, একাগ্রতা থাকতে হবে। লেখাপড়ায় মনযোগী হতে হবে। ছাত্রলীগের যে মূলমন্ত্র, শিক্ষা, শান্তি, প্রগতি, সেই শিক্ষার মশাল জ্বেলে, শান্তির বাণী নিয়ে প্রগতির পথে তোমাদের এগিয়ে যেতে হবে, দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। সেটাই আমরা চাই।’
সম্মেলনে ছাত্রলীগের গৌরবময় অতীত তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ, এমনকি এখন পর্যন্ত যত আন্দোলন সংগ্রাম অর্থাৎ বাঙালির প্রতিটি অর্জনেই ছাত্রলীগের অবদান রয়েছে। ছাত্রলীগ একটি ঐতিহ্যবাহী সংগঠন। জাতির পিতার গড়া এই সংগঠনের প্রত্যেকটি সদস্যকে মানুষের কল্যাণে কাজ করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ছাত্রলীগ গঠন করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয় তৎকালীন পাকিস্তান সরকার। ছয় দফাতেও ছাত্রলীগের ভূমিকা রয়েছে।
তিনি বলেন, সত্তরের নির্বাচনে ঘরে ঘরে গিয়ে ছাত্রলীগ ভোট চেয়েছে। আমিও ছাত্রলীগের একজন কর্মী ছিলাম। বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে অংশ নিয়েছি। আমাদের বহু সহকর্মী জীবন দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে। যারা মার্শাল ল’ জারি করেছিল তাদের বিরুদ্ধেও সংগ্রাম করেছে ছাত্রলীগ।
জিয়াউর রহমানের সময়ে ছাত্র সমাজের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া হয়েছিল অভিযোগ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৯৬ সালে খালেদা জিয়া নির্বাচনের নামে প্রহসন করেছিলেন। এককভাবে মানুষের ভোট কেড়ে নিয়ে যায় তারা। নিজেকে নির্বাচিত ঘোষণা করেন খালেদা জিয়া। আন্দোলনের এক পর্যায়ে ওই বছরের ২৩ মার্চ বিদায় নেন খালেদা জিয়া। এরপর সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আমরা জয়ী হই। তখন যে আন্দোলন হয়েছিল তাতেও ছাত্রলীগের অবদান ছিল।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০১ সালে সবাইকে অত্যাচার করেছে বিএনপি-জামায়াত জোট। তারা বাংলা ভাই সৃষ্টি করে, দেশজুড়ে সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছে। এমনকি পরে তাঁকেও গ্রেফতার করা হয় (পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়)। ওই সময়ও ছাত্রলীগ আন্দোলন ও প্রতিবাদ করেছে।
তিনি বলেন, এক এগারোর সময় তাঁকে যখন গ্রেফতার করা হয়েছিল, তখন ছাত্রলীগ ও দলের অন্যান্য অঙ্গসংগঠন এর প্রতিবাদ করেছিল। মাত্র ১৫ দিনে ২৫ লাখ গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করেছিল ছাত্রলীগ। তাঁর দেশে আসার সময়ও ছাত্রলীগ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে বলে তিনি ছাত্রলীগকে ধন্যবাদ দেন।
আওয়ামী সরকারের দুই আমলে নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমি কথা দিয়েছিলাম য্দ্ধুাপরাধের বিচার করবো, সেটা করছি। এই যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে খালেদা জিয়া লাখো শহীদের রক্তে রঞ্জিত পতাকা তুলে দিয়েছিল। আমরা সেই যুদ্ধাপরাপধীদের বিচার করে দেশকে কলঙ্কমুক্ত করেছি।
বাংলাদেশ এখন একটি উন্নয়নশীল দেশ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিয়েছি। সবার দোরগোড়ায় শিক্ষা পৌঁছে গেছে। জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে। এই দেশে কেউ গৃহহীন থাকবে না। বেসরকারি খাত উন্মুক্ত করে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছি। পাশাপাশি তারা যাতে সুন্দরভাবে বাঁচতে পারে সেজন্যও চেষ্টা চলছে।’
তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উন্নয়নের মডেল। বিশ্ববাসী এ উন্নতিতে বিস্মিত। কিন্তু আমাদের কাছে এখন তা বাস্তব।
প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের শান্তিপূর্ণ প্রত্যাবাসনে তাঁর সরকারের উদ্যোগ তুলে ধরে বলেন,‘যুদ্ধ নয় শান্তিপূর্ণভাবে তাদের ফেরত পাঠাবার জন্য আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।’
এ বিষয়ে মিয়ানমারের সিমান্তবর্তী দেশ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মাধ্যমেও বাংলাদেশ মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করছে বলে প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভো করেন। তিনি ‘স্মৃতির পাতায় ছাত্রলীগ ২০১৫-২০১৮ ’শীর্ষক একটি বইয়ের মোড়কও উন্মোচন করেন।