বরগুনার পর্যটন স্পটগুলোকে ঘিরে দক্ষিণাঞ্চলে এক্সক্লুসিভ ট্যুরিস্ট জোন গড়ে উঠতে পারে

661

বরগুনা, ২৬ অক্টোবর, ২০১৮ (বাসস) : বঙ্গোপসাগরের তীরঘেঁষা বরগুনা জেলাটি ভৌগলিকভাবে দক্ষিণ বাংলার পর্যটন কেন্দ্রগুলোর মধ্যস্থলে অবস্থিত। বরগুনার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যভরা স্থানগুলোর সঙ্গে পটুয়াখালীর কলাপাড়ার কুয়াকাটা, গলাচিপার সোনার চর ও সুন্দরবন মিলে গড়ে উঠতে পারে একটি এক্সক্লুসিভ ট্যুরিস্ট জোন।
বরগুনা জেলার পর্যটন স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো সদর উপজেলার গোড়াপদ্মা, ছোনবুনিয়া, বাইনচটকির চর, খাকদোন নদীর মোহনা, তালতলীর রাখাইন পল্লী, আশারচরের সমুদ্র সৈকত, শুঁটকি পল্লী, সোনাকাটা, পাথরঘাটার লালদিয়ার চর। এছাড়া সুন্দরবনের কটকা, কচিখালী, ডিমের চর এবং দুবলার চর, কুয়াকাটা, সোনারচরসহ আরও কিছু স্থান বরগুনার একেবারে কাছে।
কুয়াকাটা পটুয়াখালীর কলাপড়া উপজেলাতে অবস্থিত হলেও ভৌগোলিকভাবে ১৯৬৯ সালেও বরগুনা জেলার অন্তর্ভূক্ত ছিল। স্বাধীনতার পর কলাপাড়াকে পটুয়াখালীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু সড়ক পথে বরগুনা থেকে কুয়াকাটার দুরত্ব পটুয়াখালীর তুলনায় কম। ফলে পর্যটকরা বরগুনা ভ্রমণের মধ্যে কুয়াকাটাকেও রাখতে পারেন।
বরগুনার তালতলী উপজেলার সোনাকাটায় রয়েছে ইকোপার্ক। এখানে ছোট-বড় ১২টি কিল্লা, ৭টি পুকুর রয়েছে। হরিণ বেষ্টনী, কুমির প্রজনন কেন্দ্র ও শুকর বেষ্টনীসহ একটি পিকনিক স্পট রয়েছে। ফকিরহাট বাজারের কাছাকাছি একটি ব্রিজের মাধ্যমে সোনাকাটা জঙ্গলে যাওয়া যায়। এটাই পর্যটকদের প্রবেশদ্বার। যোগাযোগ এবং থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা উন্নত হলে এটি হবে পর্যটনের চমৎকার স্থান। সোনাকাটার পূর্বে কুয়াকাটা, পশ্চিমে সুন্দরবন ও হরিণবাড়িয়া, উত্তরে রাখাইন পল্লী এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। সোনাকাটা থেকেও উপভোগ করা যায় সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত।
বরগুনার স্থানীয় সাংবাদিক ও স্কাউট লিডার আ. মান্নান জানান, ১৯৯৫ সালে প্রশান্ত মহাসাগরীয় কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট ক্যা¤েপ অংশগ্রহণকারী ২৩টি দেশের প্রায় আড়াই হাজার স্কাউট সোনাকাটা পরিদর্শন করে মুগ্ধ হয়েছে।
টেংরাগিরীতেও রয়েছে ছোট্ট একটি ইকোপার্ক। এখানে ছোট্ট একটি বাংলো, কয়েকটি বেঞ্চ ও শেড রয়েছে। কুয়াকাটা থেকে ট্রলারযোগে টেংরাগিরীতে আসতে ২০ মিনিট সময় লাগে। অনেক পর্যটকরা কষ্ট সয়ে এখানে আসেন। তাই পর্যটক বাড়াতে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন প্রয়োজন। সোনাকাটা বন বিভাগের বিট অফিসার কাজী আলতাফ হোসেন জানান, ভ্রমণের জন্য অত্যন্ত চমৎকার একটি স্পট সোনাকাটা, কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত না হওয়ায় পর্যটকদের আনাগোনা খুবই কম।
তালতলীর ঐতিহ্য দুইশ বছরের রাখাইন পল্লী। রাখাইন পল্লীতে দেখবেন তাঁতশিল্প, বৌদ্ধ মন্দির, বিভিন্ন ধরনের মূর্তি ও রাখাইন সংস্কৃতির নিদর্শন। এখানে পাবেন রাখাইনদের তাঁতের তৈরি লুঙ্গি, শার্ট, থ্রি-পিস, থামী ও শালসহ বিভিন্ন ধরনের বস্ত্র। বরগুনা জেলা সদর থেকে লঞ্চ, ট্রলার অথবা গাড়ি নিয়ে খুব সকালে যাত্রা করুন। সঙ্গে খাবার নিয়ে যেতে পারেন অথবা তালতলীর গ্রামীণ পরিবেশে কোনো হোটেলেও খেয়ে নিতে পারবেন। প্রথমেই যাবেন তালতলীর রাখাইন পল্লীতে। সেখানে ঘুরে দেখার পর আবার যাত্রা শুরু করবেন সোনাকাটা ও আশারচরের উদ্দেশে। সবকিছু দেখতে দেখতে বিকেলটা কেটে যাবে। ফাঁকে ফাঁকে ক্যামেরা বন্দী করতে পারেন অসাধারণ সব দৃশ্য। সূর্যাস্ত দেখে ফিরতি পথে আসুন বরগুনায়।
পাথরঘাটা উপজেলার সর্ব দক্ষিণে হরিণঘাটা চর। এ চরে রয়েছে হরিণ ও বন্য শুকর। রয়েছে দীর্ঘ সৈকত। সৈকতে দাড়িয়ে সূর্যাস্ত উপভোগ করা যায়। হরিণঘাটার গহীন ঝাউবনের নিচে বসে শুনতে পাবেন বাতাসের শো শো শব্দ। সমুদ্র দেখলে মনে হবে স্বপ্নের মাঝে রয়েছেন। রাতের আঁধারে হরিণের পাল এসে ঝাউবনের নিচে আশ্রয় নেয়। তাও দেখার মতো দৃশ্য।
বরগুনার বেতাগী উপজেলায় রয়েছে মুঘল আমলের ঐতিহ্যবাহী বিবিচিনি শাহী মসজিদ। মূল ভূমি থেকে ৩০ ফুট উচ্চতায় স্থাপিত এক গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটি নির্মাণ করেছেন আধ্যাত্মিক সাধক হযরত শাহ নেয়ামতুল্লাহ (র.)। ১৬৫৯ সালে পারস্য থেকে ইসলাম প্রচারের জন্য তিনি এ অঞ্চলে আসেন। সপ্তদশ শতাব্দীতে নির্মিত মসজিদটি দৈর্ঘ্যে ৩৩ ফুট ও প্রস্থে ৩৩ ফুট। দেয়াল ৬ ফুট চওড়া।
সুন্দরবনের সব স্পটে যেতে হলে পুরো দিনটাই লঞ্চে ভ্রমণ করতে হবে। বরগুনা থেকে সুন্দরবন ভ্রমণ খুবই সহজ। সকালে গিয়ে বিকেলে বরগুনায় ফিরে আসা যায়। অথবা ২-৩ দিনের খাবার নিয়ে লঞ্চেও থাকা যায়। সুন্দরবনের কটকাসহ আশপাশের স্পটগুলো হলো কচিখালী, ডিমের চর ও দুবলার চর। ঝাঁক বাঁধা হরিণ ও বানরসহ ভাগ্য প্রসন্ন হলে দেখা যাবে রয়েল বেঙ্গল টাইগার। রাতে কটকার অভয়ারণ্যে ভিড় করে হরিণের পাল।
কুয়াকাটাকে নতুন করে কাউকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দুটোই উপভোগ করা যায় এর সৈকতে। দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত, রাখাইন ঐতিহ্য, শুঁটকি পল্লী, ঝাউবন ও ইকোপার্কসহ নানা কারণেই কুয়াকাটা দেশের অন্যতম বৃহত্তম পর্যটন কেন্দ্র। কুয়াকাটা থেকে বরগুনার দূরত্ব অন্যান্য জেলার চেয়ে খুবই কম। তাই কুয়াকাটা ও বরগুনা মিলে একটি সমন্বিত পর্যটন এলাকা গড়ে উঠতে পারে।
এছাড়াও বরগুনা সদর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে ভ্রমণ স্পট। গোড়াপদ্মায় গড়ে উঠেছে ছোট আকারের পর্যটন কেন্দ্র। বিকেলের অসংখ্য মানুষ এ সব স্থানে ভিড় করেন। বরগুনা শহর থেকে ৬ কিলোমিটার পশ্চিমে রয়েছে প্রাকৃতিক জঙ্গল। চারদিকে নদীবেষ্টিত ওই জঙ্গলে রয়েছে হরিণ। পিকনিকে জন্য এটি অপূর্ব সুন্দর স্পট। এ ছাড়া লবণগোলা, ছনবুনিয়া, কুমিরমারা ও বড়ইতলাসহ বিভিন্ন জায়গায় গড়ে উঠা ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট পর্যটনের জন্য আকর্ষণীয় স্থান।
বরগুনার জেলা চেয়ারম্যান ও সাবেক সাংসদ মো. দেলোয়ার হোসেন জানান, একসঙ্গে অনেক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে বরগুনা একটি অসাধারণ জায়গা। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ করা গেলে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে অন্যান্য জায়গার তুলনায় বরগুনা কোনো অংশেই কম হবে না।এমন কি এই জেলাকে ঘিরে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে গড়ে উঠতে পারে একটি এক্সক্লুসিভ ট্যুরিস্ট জোন।