রাজনীতির নামে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা পুনরাবৃত্তির বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন থাকার আহবান প্রধানমন্ত্রীর

636

ঢাকা, ২৪ অক্টোবর, ২০১৮ (বাসস) : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজনীতির নামে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মানুষ হত্যা পুনরাবৃত্তির বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন থাকার আহবান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘এ ধরনের জঘন্য অপকর্মের সঙ্গে যারা যুক্ত হবে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’
তাঁর সরকার আগুন সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রনে সম্ভাব্য সকল ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী আজ রাজধানীর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সংলগ্ন চানখারপুল এলাকায় ‘শেখ হাসিনা বার্ন এন্ড প্লাষ্টিক সার্জারি ইনষ্টিটিউট’-এর উদ্বোধনকালে একথা বলেন।
সরকার পতনের জন্য আন্দোলনের নামে ২০১৩-১৪ এবং ১৫ সালে বিএনপি-জামাতের পেট্রল বোমা হামলায় পথচারি, গাড়ি চালক-হেলপার, যাত্রীদের পুড়িয়ে হতাহত করার প্রেক্ষিতে অগ্নিদগ্ধদের চিকিৎসায় বর্তমান সরকার ২০১৬ সালে ৫২২ কোটি টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্পটি নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করে।
মোট ৫০০ শয্যা বিশিষ্ট ‘শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট’-এ বিশ্বের সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতিসহ উন্নততর চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকবে।
প্রধানমন্ত্রী এই বার্ন ইউনিটের নির্মাণ কাজে সম্পৃক্ত সেনবাহিনী ও এলাকাবাসীসহ সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, আমরা পর্যায়ক্রমে এখানে উন্নত যন্ত্রাংশ সংযোজন, বিশেষজ্ঞের অন্তর্ভূক্তিসহ অন্যান্য উন্নয়নের কাজ করে যাবো।
তিনি বলেন, এটি যাতে একটি উন্নত বিশ্বমানের ইনস্টিটিউট হিসেবে যাতে গড়ে ওঠে সেই ব্যবস্থা অবশ্যই আমরা করবো। যাতে আগুনে পুড়লের আমাদের কোন লোককে আর বিদেশে যেতে না হয়। দেশে বসেই যেন চিকিৎসাটা পায় এবং এজন্য নার্সদেরও বিদেশ থেকে প্রয়োজনে ট্রেনিং করিয়ে আনা হবে এবং নতুন যন্ত্রপাতি ব্যবহারে টেকনিশিয়ানদেরও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে।
সরকার প্রধান বলেন, আামাদের পরিকল্পনা রয়েছে, অনেকদূর আমাদের যেতে হবে। তবে, আমাদের ৫ বছর সময় প্রায় শেষ এবং সামনে নির্বাচন।
প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেন, নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ যদি নৌকা মার্কায় ভোট দেয় আমরা আবার আসবো (ক্ষমতায়) তখন এই কাজতে আরো দ্রুত এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে।
তিনি বলেন, আর যদি কোন পরিবর্তন (ক্ষমতার পালাবদল) হয় তাহলে ঐ বার্ন ইউনিটের মত এটাও যেন থমকে না যায় সেটাও সকলকে দেখতে হবে। কারণ, এটার সম্প্রসারণ ও আধুনিকায়নের কাজ অব্যাহত থাকুক সেটাই আমরা চাচ্ছি।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. জাহিদ মালেক, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ, শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের জাতীয় সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ইঞ্জিনিয়ারিং চিফ মেজর জেনারেল মো. সিদ্দিকুর রহমান সরকার বক্তব্য রাখেন । স্বাগত বক্তব্য রাখেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব সিরাজুল হক খান।
অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দুটি স্মারক উপহার দেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ও সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ।
বার্ন ইউনিট সূত্র জানায়, এই ইনস্টিটিউটে পোড়া রোগীরা যেমন উন্নততর সেবা পাবেন, তেমনি চিকিৎসক ও নার্সরা তাদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ পাবেন।
১২তলা বিশিষ্ট এই ইনস্টিটিউটে ৫৪ ইনসেনটিভ কেয়ার ইউনিট, ৬০ শয্যাবিশিষ্ট হাইডেফিসিয়েন্সি ইউনিট, ১২টি অপারেশন থিয়েটার এবং অত্যানুধিক পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ড। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জরুরি ভাবে রোগী নিয়ে আসার জন্য ভবনের ছাদে হেলিপ্যাড সুবিধা থাকছে। সোলার প্যানেল ও বৃষ্টির পানি সঞ্চয়েরও ব্যবস্থা থাকবে। পার্কিংয়ে একসঙ্গে ১৮০টি গাড়ি রাখা যাবে। ঢামেক হাসপাতালের পুরাতন ভবনের সঙ্গে একটি ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে ইনস্টিটিউট ভবনের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করা হবে।
এরই মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার চিকিৎসা সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম কেনার কাজ শুরু হয়েছে। বেশিরভাগ যন্ত্রপাতি জার্মানি থেকে আনা হয়েছে। এছাড়া ইংল্যান্ড, আমেরিকা ও কানাডা থেকে কিছু সরঞ্জাম আনা হবে। হাসপাতালটির জনবল নিয়োগের জন্য প্রায় ২ হাজার ২শ পদের অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালের ৬ এপ্রিল এটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আন্দোলনের নামে খালেদা জিয়া ২০১৩, ১৪ ও ১৫ সালে মানুষকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করেছিল। প্রায় ৪ হাজার মানুষ অগ্নিসন্ত্রাসের শিকার হয় যার মধ্যে প্রায় ৫শ মানুষ আগুলে পুড়ে মুত্যুবরণ করে। তারা সাড়ে ৩ হাজার গাড়ি ভাংচুর করে, যার মধ্যে বিআরটিসি’র জন্য সদ্য ক্রয়কৃত ডবল ডেকার বাসগুলোও ছিল।
এখনও সে সব আগুলে পোড়া রোগীদের অনেকে মানবেতর জীবন যাপন করছে এবং তাঁদের সাহায্যার্থে তাঁর সরকার সবরকম প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সে সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটের চিতিৎসরকরাও তাদের সীমিত সামর্থ নিয়েই পীড়িত মানুষের চিকিৎসার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন।
জনগণের জন্যই তাঁর রাজনীতি এবং মানুষ পুড়িয়ে হত্যা এটা কি ধরনের রাজনীতি প্রশ্ন উত্থাপন করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা কোন ভাবেই আর এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে চাই না।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সে সময় (প্রেটল বোমা হামলার ঘটনা) বাংলাদেশের মানুষই তাদের প্রতিরোধ করেছিল।’
প্রধানমন্ত্রী এ সময় দেশের জনগণ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সন্ত্রাস এবং জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় তাঁর সরকারের সাফল্যেরও উল্লেখ করেন।

একেবারে তৃণমূল পর্যায়ের মানুষ যেন তাঁদের মৌলিক চাহিদাগুলোসহ উন্নত জীবন পায় সেটা নিশ্চিত করাই তাঁর কাজ এবং সেটাই করে যাচ্ছেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেটা আমি করতে পেরেছি। কারণ, বাংলাদেশের জনগণ নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে তাঁদের সেবা করার সুযোগ দিয়েছিল।
তিনি প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন, আগামীতেও যদি নৌকায় ভোট দিয়ে জনগণ সেই সুযোগ দেন তাহলে অবশ্যই তাঁর সরকার এখন যে কাজগুলো শুরু করেছে সেগুলো সম্পন্ন করতে পারবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পুণরায় ক্ষমতায় আসলে দেশকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠাতো করবোই উপরন্তু ২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ দারিদ্র ও ক্ষুধামুক্ত দেশ হবে এবং ২০২১ সালে ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত দেশেই আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করবো এবং ২০৪১ সালে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হবে।’
তাঁর সরকার ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে কিভাবে গড়ে তুলতে চায় এজন্য শতবর্ষ মেয়াদি ‘ডেল্টা প্লান ২১০০’ প্রণয়ন করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আগামী প্রজন্মের জন্যই এই পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। জাতির পিতা বলে গিয়েছিলেন ‘বাংলাদেশকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবানা’, পারে নাই। শুধু মাঝে ২১টা বছর এবং ২০০১ পরবর্তী সময়ে আরো ৮টি বছর জাতির জীবন থেকে নষ্ট হয়েছে, বলেন প্রধানমন্ত্রী।
এই সময়গুলো নষ্ট না হলে বাংলাদেশ বহু আগেই এগিয়ে যেত উল্লেখ করে তিনি বলেন, চিকিৎসা সেবাকে আমরা মানুষের দোড়গোড়ায় পৌঁছে দিতে সমর্থ হয়েছি, অনলাইন চিকিৎসা সেবা চালু এবং কমিউনিটি ক্লিনিক এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মাধ্যমে ৩০ প্রকারের ওষুধ বিনামূল্যে প্রদান করা হচ্ছে।
মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে এবং তাঁর সরকার পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করারও পদক্ষেপ নিচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশকে আমরা পোলিও মুক্ত করতে আমরা সক্ষম হয়েছি।
স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণের পাশাপাশি তাঁর সরকার প্রত্যেক উপজেলায় ফায়ার সার্ভিস স্টেশন করছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যাতে আগুন লাগলে তাৎক্ষণিক ভাবে নেভানোর উদ্যোগসহ জনগণকে প্রয়োজনীয় সেবা দেওয়া সম্ভবপর হয়।
তিনি বলেন, এই ঢাকা শহরের উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম- প্রত্যেক এলাকাকে বিবেচনায় এনে ঢাকার সব মানুষ যাতে একটু চিকিৎসা সেবাটা পায় সেজন্যই আমরা হাসপাতালগুলো তৈরি করছি। একইসাথে জেলা হাসপাতালগুলোকে আমরা যেমন উন্নত করছি। সেখানেও বার্ন ইউনিট তৈরি করছি। যাতে সেখানে পোড়া রোগীরা চিকিৎসাটা নিতে পারে। পাশাপাশি প্রতিটি বিভাগে আমরা একটা করে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি।
চিকিৎসক সৃষ্টির জন্য তাঁর সরকার সরকারি এবং বেসরকারী খাতে সারাদেশে মেডিকেল কলেজ তৈরি করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেখানে একদিকে যেমন কর্মসংস্থান হচ্ছে অন্যদিকে পড়াশোনার সুযোগ হচেছ।
শেখ হাসিনা বলেন, হাতে মাত্র ১০ বছর সময় পেয়েছি এই ১০ বছরে যতটুকু সম্ভব আমরা কাজ করার চেষ্টা করেছি। আর স্বাস্থ্যসেবার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দিয়ে তা জনগণের দোড়গোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এই সময়ে ১৯ টি মেডিকেল কলেজ এবং ২৮টি ডেন্টাল কলেজ সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় পঙ্গু হাসপাতালে পঙ্গুত্ব লাঘবেও তাঁর সরকারের উদ্যোগ তুল ধরে বলেন, সেখানে এ হাজার শয্যা বিশিষ্ট নতুন ভবন তৈরী হয়ে গেছে এবং যা উদ্বোধনের অপেক্ষায় রয়েছে।
একইসঙ্গে গ্যাষ্টো অন্ট্রোলজিষ্ট হাসপাতাল, নিউরো, কিডনী, ক্যান্সার হাসপাতাল আধুনকায়ন এবং টেকনোলজিষ্ট তৈরির উদ্যোগ নেওয়ার কথাও বলেন তিনি।
‘আমার দেশের মানুষ সুস্বাস্থের অধিকারী হবে এবং প্রত্যেকটি গ্রাম শহরে রূপান্তরিত হবে, সেখানে নাগরিক জীবনের সকল সুযোগ-সুবিধা থাকবে, ’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট মহাকাশে উৎক্ষেপণ করেছি এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে অনেক দূর এগিয়ে গেছি। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে এগিয়ে যাবে।’