বাসস ক্রীড়া-১১ : উৎসবে মুখরিত বিপলুর আঙ্গিনা

166

বাসস ক্রীড়া-১১
ফুটবল-বঙ্গবন্ধু-বিপলু
উৎসবে মুখরিত বিপলুর আঙ্গিনা
সিলেট, ২ অক্টোবর ২০১৮ (বাসস) : পরস্পর পরস্পরকে জড়িয়ে ধরছে, মিষ্টিমুখ করাচ্ছে সেই সঙ্গে চলছে শুভেচ্ছা বিনিময়। এমনই দৃশ্যে মুখরিত সিলেটের লোকাল হিরো বিপলু আহমেদের বাড়ির আঙ্গিনা। কারণ বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ আন্তর্জাতিক ফুটবল টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী ম্যাচে এই বিপলুর গোলেই লাওসের বিপক্ষে অসাধারণ এক জয় পেয়েছে স্বাগতিক বাংলাদেশ। নিজেদের মাঠে অসাধারণ কীর্তি গড়ার কারণে স্থানীয়দের মধ্যে উৎসাহের মাত্রা যেন আরো একধাপ বেশি।
সকাল থেকেই বিভিন্ন এলাকা থেকে আসতে শুরু করেছেন আতœীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব আর এলাকাবাসী। সবাইকেই আপ্যায়ন করতে হচ্ছে। কেউ ফুল, কেউ বা আবার মিষ্টি নিয়ে আসছেন লাওস ম্যাচ জয়ের নায়ক বিপলু আহম্মেদের বনকলা এলাকার বাড়িতে। মানুষের এমন ভিড় সামলাতে কিছুটা বেগ পেতে হচ্ছে সত্তোরোর্ধ্ব বাবা-মা ও ভাই-বোনদের। তবে এতটুকু ক্লান্তি বা অসন্তুষ্টি নেই তাদের মধ্যে। সবাইকে সানন্দে অভর্থনা জানাচ্ছেন। বসতে দিচ্ছেন বৈঠক খানার ঘরে। বাড়ির বিশাল আঙ্গিনাতে করতে হয়েছে বসার ব্যবস্থা।
এ আনন্দ উৎসবটা শুরু হয়েছে বাংলাদেশ-লাওস ম্যাচের পর থেকেই। ম্যাচ শেষ হওয়ার পর সিলেট সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আশফাক আহম্মেদ নিজেই মিষ্টি নিয়ে চলে আসেন বিপলুদের বাড়িয়ে। রাতে বিশাল মিছিলও করেছেন এলাকাবাসী। একুশ বছর বয়সী বিপলু এখন সিলেটের নায়ক। এক ম্যাচেই বনে গেছেন ‘মহা তারকা।’
সাত ভাই দুই বোনের মধ্যে সবার ছোট বিপলুর এমন কীর্তিতে আনন্দে মাতোয়ারা বাবা-মা, ভাই-বোনরা। খুশীতে কেঁদেছেনও তারা। তবে এ অশ্রু আনন্দের। এ অশ্রু অনেক বড় সফলতার। যাকে ঘিরে এ উৎসব, সেই বিপলুও আজ ছুটি নিয়ে বাসায় ছুঁটে আসেন দুপুরে। ১টা ৩৫ মিনিটে বাড়িতে প্রবেশ করতেই ছুঁটে আসেন বড় বোন। কপালে এঁকে দেন চুমো। বা-মাকে বুকে জড়িয়ে নেন বিপলু নিজেই। তাদের সালাম করে ম্যান অব দ্যা ম্যাচের পুরস্কারটি তুলে দেন বাবার হাতে। ছেলের খেলা দেখতে কাল মাঠে যেতে পারেননি বাবা-মা। ঘরে বসেই খেলা দেখেছেন। ৬০ মিনিটে বিপলুর পা থেকে যখন জয় সূচক একমাত্র গোলটি আসে, তখন কিছুতেই বিশ^াস করতে পারছিলেন না বাবা রেহান মিয়া। মা হালিমা বেগম গোলের পরপরই খুশীতে কেঁদে ফেলেছেন। রাতে ছেলের সঙ্গে ভিডিও কলে কথাও বলেছেন। কিন্তু মোবাইলে কথা বলে কি আর মন ভরে। তাইতো বাসায় আসার জন্য অনুরোধ করেছিলেন আদরের ধনকে। মায়ের আবদার রাখতেই বিপলু দুপুরে চলে আসেন বাসায়। ছেলেকে নিজ হাতে খাইয়ে দেয়ার জন্য রান্নাও করে রেখেছিলেন মা হালিমা।
সাত ভাইয়ের মধ্যে ছয়জনই ফুটবল খেলে থাকেন। তবে বিপলু ও তার বড় ভাই শিপলু ছাড়া ঢাকার মাঠে আর কারো খেলার অভিজ্ঞতা নেই। কিন্তু জেলা পর্যায়ের শীর্ষ ক্লাবে খেলেছেন সবাই। পুরো সিলেটেই তারা ‘ফুটবল পরিবার’ হিসেবে পরিচিত। ফুটবল পরিবারে জন্ম নেয়া বিপলু মূলত আজকের এ অবস্থানে এসেছেন বড় ভাই বাবলু আহম্মেদের অনুপ্রেরনাতে। তার হাত ধরেই প্রথম ফুটবলে হাতেখড়ি জাতীয় দলের এ আক্রমনাত্মক মিডফিল্ডারের। ছোট ভাইয়ের এমন সফলতায় দারুন উচ্ছ্বসীত বাবলু বলেন,‘দল বেঁধে সবাই গিয়েছিলাম মাঠে খেলা দেখতে। সে যখন গোল করল তখন আমি আনন্দে দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম। ওকে নিয়ে আমার প্রত্যাশা অনেক। আমি চাই সে দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে ভারতের জনপ্রিয় টুর্নামেন্ট আইএসএলের মত টুর্নামেন্টে সে অংশগ্রহন করুক।’
পিতা মো. রেহান মিয়া ছেলের ছেলের এমন পারফর্মেন্সে বেজায় খুশী, ‘আমি খুবই আনন্দিত। সিলেটের জন্য এবং হযরত শাহজালাল (রা:) এর মান রেখেছে আমার ছেলে। আমার ৭ ছেলের সবাই কমবেশী খেলাধুলা করেছে। কাউকেই আমি খেলার জন্য কখনো নিষেধ করিনি। আজ আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে।’
মা হালিমা খাতুন নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে বারবার কেঁদে ফেলছিলেন, ‘টিভিতে যখন দেখলাম আমার বিপলু গোল করেছে, তখন খুশিতে আমার কান্না চলে এসেছিল। সকালেই প্রতিবারের মত আমাকে ফোন করে দোয়া করতে বলেছিল ও (বিপলু)।’
যার পা থেকে আসা একমাত্র গোলে বাংলাদেশ আজ স্বপ্ন দেখছে বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপের সেমি ফাইনালে খেলার। বিপলু বাসসকে বলেন , ‘হোম গ্রাউন্ডে খেলা ছিল, তাই টেনশনটাও ছিল বেশী। তবে বড় ভাই বাবলু সকালে টিম হোটেলে গিয়ে আমাকে চাপ না নিয়ে স্বাভাবিক খেলাটা খেলতে বলেছিলেন। ম্যাচের শুরু থেকেই আমার চেষ্টা ছিল গোল করার। কিন্তু হচ্ছিল না। যখন ঐ সুযোগটা পেয়েছি তখনি বলটা আউট সুইং করেছিলাম। আর সেটাই কাজে এসে যায়।’
৭ ভাই দুই বোনের মধ্যে বিপুল সবার ছোট। এদের মধ্যে ৬ ভাই’র সবাই স্থানীয় পর্যায়ে ফুটবল খেলেছে। বিপুলের বড় ভাই (৬ষ্ঠ) শিপলু ও সিলেটের জেলা পর্যায়ে বেশজন প্রিয়। নাম লিখিয়েছিলেন মোহামেডানেও। তবে অতি পরিশ্রমের কারণে ফিরে আসেন সিলেটে। খেলেন স্থানীয় জনপ্রিয় ক্লাব ইউনাইটেডে। তারও বড় ভাই (৫ম) বাবলু আহমেদও জেলা পর্যায়ের একজন শীর্ষ ও জনপ্রিয় ফুটবলার। ভাগিনা মিনহাজ আহমেদ শিমুল ঢাকা মোহামেডানের অনুর্ধ-১৮ দলের খেলোয়াড় ছিলেন। লন্ডন প্রবাসী ভাই (৩য়), কাবুল আহমেদ বলেন, ‘এই জয় গোটা জাতির। সেই সঙ্গে সিলেটবাসীর ও আমাদের পরিবারের। আমরা সব সময় তাকে উৎসাহিত করেছি। ইন্দোনেশিয়ায় এশিয়ান গেমেসে বাংলাদেশ দলের হয়ে তার পারফর্মেন্সে আমরা খুশি হয়েছি। সাফে বাংলাদেশ হেরে যাবার পর মন খারাপ হয়েছে। আমি এই বঙ্গবন্ধু গোল্ড কাপের খেলা দেখার জন্যই দেশে থেকে গেছি। আমরা সবাই তাকে সব সময় উৎসাহিত করি।’
র‌্যালি: বঙ্গবন্ধু টুর্নামেন্টকে ঘিরে আগেই নিজ পাড়ায় ছিল বাড়তি উন্মাদনা। লোকাল হিরো হিসেবে তাদের সন্তান আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলবে ঘরের মাঠে। সে জন্যই তারা পাড়ার মুখে বাংলাদেশ জাতীয় দল তথা বিপলুর সফলতা কামনা করে মহল্লার প্রবেশ মুখেই বানিয়েছে তোরন ও ব্যানার। জাতীয় দল সিলেটে পৌঁছানোর পর বিমান বন্দর থেকে দলকে অভ্যর্থনা জানিয়ে গার্ড অব অনার দিয়ে হোটেলে পৌঁছে দিয়েছে তাদের প্রায় শতাধিক মোটর সাইকেল।
এর বাইরেও বাংলাদেশ বিশেষ করে লোকাল হিরো বিপলুকে উৎসাহিত করার জন্য মহল্লার শতাধিক সমর্থক বিপলুর নাম লেখা একই রংয়ের টি শার্ট পড়ে মাঠে হাজির হয়েছিল। এক কথায় গোটা মহল্লাটিই এখন ফুটবল পাড়া বনে গেছে। তাদের সবার মুখেই বিপলুর বন্ধনা।
বাসস/এএসপি/এমএইচসি/১৯২০/স্বব