পায়রা বন্দরের উন্নয়নের পাশাপাশি মানুষের কর্মক্ষেত্র বাড়ছে

261

বরগুনা, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ (বাসস) : অবহেলিত জনপদটি রাতে ঘুটঘুটে অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকতো। সন্ধ্যা নামলেই শিয়াল ও ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক। রাতে তো দূরের কথা দিনেও মানুষের পদচারণা ছিল না। মাত্র পাঁচ বছর আগেও এ রকমটি ছিল। নাম না জানা সেই নদী পাড়ের বনজঙ্গলে ঘেরা জনপদটি এখন ফ্ল্যাড লাইটের আলোয় আলোকিত। যেখানে চায়ের দোকান পর্যন্ত ছিলো না, সেখানে এখন কফির তেষ্টা মেটায় মানুষ। নিত্য পদচারণা দেশি-বিদেশী বিনিয়োগকারী ও পর্যটকদের।
পায়রা বন্দর চালু হওয়ায় এখানকার মৌসুমী কৃষি শ্রমিকসহ জেলে পরিবারের অদক্ষ শ্রমিকরা কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছেন। কেউ হয়েছেন গাড়ি চালক কেউ পেয়েছেন নিরাপত্তারক্ষীর চাকরি। বন্দরের ভেতরে ও বাইরে উন্নয়ন কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছেন উপকূলের বিভিন্ন অঞ্চলের নানা পেশার শ্রমিক আর কারিগররা। নিত্য নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ছে।
২০১৩ সালের ১৯ নভেম্বরে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুভ উদ্বোধন করেন দেশের তৃতীয় সমুদ্র বন্দর পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলায় টিয়াখালী এলাকায় অবস্থিত পায়রা বন্দরের। আনুষ্ঠানিকভাবে পায়রা বন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু হয় ২০১৬ সালের ১৩ আগস্ট। পায়রা’য় অপারেশনালসহ চলমান কার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে ১১ কোটি এক লাখ ৮২ হাজার ২০৯ টাকা ব্যয়ে এ বছরের ১০ আগস্ট পাঁচ তলা প্রশাসনিক ভবনের উদ্বোধন করা হয়েছে। তিন হাজার ৯৮২ কোটি টাকা ব্যয়ে পায়রা বন্দরের মূল চ্যানেল রাবনাবাদ পাড়ের চারিপাড়ায় নির্মাণ করা হচ্ছে ৬০০ মিটার দীর্ঘ টার্মিনাল। টার্মিনালে সরাসরি দুইটি মাদার ভেসেল একই সময় ভিড়তে পারবে। টার্মিনাল নির্মিত হলে ২০১৯ সালের মধ্যে নির্মাণ সামগ্রী ও অন্যান্য বাল্ক পণ্যবাহী জাহাজ থেকে পণ্য খালাশের প্রক্রিয়া শুরু হবে।
প্রাথমিকভাবে ১৬ একর জমিতে পায়রা বন্দর প্রকল্প এলাকা নির্মাণ করা হয়। সেখানে ইতোমধ্যে নির্মিত হয়েছে পানি শোধনাগার। স্থাপিত হয়েছে লাইটার জাহাজ থেকে পণ্য খালাশের টার্মিনাল। বেইলিব্রিজসহ সংযোগ সড়ক নির্মিত হয়েছে। সোলার বাতিসহ বিদ্যুত সরবরাহ চালু করা হয়েছে। সাবমেরিন কেবল লাইন টানা হয়েছে। সাগর মোহনা থেকে মূল চ্যানেলের নেভিগেশনাল বয়া স্থাপন করা হয়েছে। সীগনাল বাতি স্থাপিত হয়েছে । সাগর থেকে চ্যানেলের ইনার সাইটে ২৮টি বয়াবাতি সেট করা হয়েছে। রামনাবাদ থেকে তেতুলিয়া নদীতে বরিশাল হয়ে ঢাকার মেঘনা নদীর হিজলা পর্যন্ত ৭০ মাইল নদী খনন করা হয়েছে। যেখানে পাঁচ মিটার নাব্যতা বজায় রাখা হয়েছে। এ চ্যানেলেও ৪৬টি বয়াবাতি স্থাপন করা হয়েছে। গোটা চ্যানেলটিতে ১০ মিটার নাব্যতা নিশ্চিতের লক্ষ্যে খননের কাজ চলমান রয়েছে। চলমান রয়েছে ৪২ হাজার বর্গফুট কয়েল হাউস এর নির্মাণ কাজ। দ্রুত চলছে ২৫৪ কোটি ৫১ লাখ টাকা ব্যয়ে পায়রা বন্দরের সঙ্গে মহাসড়কের সরাসরি যোগাযোগে পাঁচ দশমিক ৬০ কিমি দীর্ঘ ফোরলেন সড়কের নির্মাণ কাজ। বন্দর সংলগ্ন ট্রাক স্ট্যান্ডের কাজ চলছে। সংক্ষিপ্ত পরিসরে চলছে সিএন্ডএফ এজেন্ট ক্লিয়ারেন্স এবং ইমিগ্রশনের কাজ। পুর্ণাঙ্গ গভীর বন্দরে উন্নীতের লক্ষ্যে পায়রা বন্দরের এ কর্মযজ্ঞের ধারা চলবে ২০২৩ সাল পর্যন্ত। ২০ কোটি ৯৭ লাখ ৮৯ হাজার ৭১৩ টাকা ব্যয় পায়রা বন্দরে ওয়ার হাউস নির্মাণ করা হয়েছে। নির্মিত ওয়ার হাউসের দৈর্ঘ ৪০০ ফুট, প্রস্থ ২৫০ ফুট, উচ্চতা ২০ ফুট। ২১ কোটি ৩৮ লাখ ৮৫ হাজার ব্যয়ে সার্ভিস জেটির নির্মাণ কাজ চলছে। ম্যাক ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে একটি পন্টুন জেটি থাকলেও পন্য খালাশের সুবিধার্থে এই সার্ভিস জেটি নির্মাণ করা হচ্ছে।
পায়রা বন্দর নির্মাণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে পুনর্বাসনের অংশ হিসেবে কর্মদক্ষতা বৃদ্ধিতে বিভিন্ন কোর্সের প্রশিক্ষণ কার্যক্রমও উদ্বোধন করেছেন নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান। পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের মেম্বার (প্রশাসন ও অর্থ) কমান্ডার এম রাফিউল হাসান জানান, অপারেশনাল কার্যক্রমে গতি আনতে প্রশাসনিক কর্মকান্ডের পাশাপাশি মূলত জমি অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে আর্থিক ক্ষতিপূরণে কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষে প্রথম পর্যায়ে দেড়শ পরিবারকে তিনটি কোর্সে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে ছিলো নির্মাণ শ্রমিক, ড্রাইভিং ও কম্পিউটারের বেসিক কোর্সের প্রশিক্ষণ। দুই বছরে ৪২০০ মানুষকে তিন মাস ব্যাপী ২৯টি কোর্সে এ প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। প্রয়োজনে কোর্সের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি হবে বলে। যুব উন্নয়ন অধিদফতরসহ সরকারের বিভিন্ন দফতর এসব কাজে সহায়তা করবে।
সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও স্থানীয় সংসদ সদস্য আলহাজ মাহবুবুর রহমান জানিয়েছেন, প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পায়রা বন্দর নির্মাণ এবং এখানকার মানুষের পূনর্বাসনসহ কর্মসংস্থানের বিষয়টিতে গুরুত্বারোপ করেছেন।
বরগুনার সাবেক সাংসদ ও বর্তমান জেলা চেয়ারম্যান, মো. দেলোয়ার হোসেন জানান, সরকার এ উপকূলীয় এলাকায় সমুদ্র বন্দর স্থাপন করে অবহেলিত জনপদকে রাতারাতি অর্থনৈতিক জোনে পরিণত করেছে। পায়রা বন্দর, বরগুনা-পটুয়াখালীর তাপ বিদ্যুত কেন্দ্রগুলো মানুষের কর্মসংস্থানসহ সমগ্র অঞ্চলটিকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।