বাসস ইউনিসেফ ফিচার-১ : শিল্পাঞ্চলে জন্মগ্রহণকারী শিশুর স্বাস্থ্য ঝুঁকি অনেক বেশি

299

বাসস ইউনিসেফ ফিচার-১
শিল্প কারখান-শিশু
শিল্পাঞ্চলে জন্মগ্রহণকারী শিশুর স্বাস্থ্য ঝুঁকি অনেক বেশি
ঢাকা, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ (বাসস) : একটি দেশের উন্নয়নে শিল্প একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুসর্গ। অনেক সময় একটা দেশের উন্নয়নের ব্যারোমিটার হয়ে দাঁড়ায় শিল্পায়ন। আবার আজকের শিশুরাই একটা দেশের ভবিষ্যত। সুতরাং দেশের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য সুস্থ সবল এবং নি:রোগ শিশু দরকার। শিশু এবং শিল্পায়ন দু’টিই দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য দরকার। তবে এ ক্ষেত্রে একটা দেশের সুন্দর ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার শিশু সুস্বাস্থ্য। তবে বিভিন্ন কারণে শিশুর সুরক্ষা বিঘিœত হলেও সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ে শিল্পাঞ্চলে বিশেষ করে কল-কারখান অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করা শিশুরা। যেমন গাজীপুরের শিল্পাঞ্চলে জন্মগ্রহণ করা শিশু রাহেলা। বয়স মাত্র সাড়ে তিন বছর। গত ২৭ আগস্ট রাত থেকে হঠাৎ করেই তার খুব কাশি। পরদিন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় রাহেলার বাবা মাসুদ। বিভিন্ন পরীক্ষার পর ধরা পড়ে রাহেলা হাঁপানি রোগে ভুগছে।
মাসুদের সাথে বিভিন্ন আলাপের পর ডাক্তার জানতে পারে গাজীপুরে তারা যেখানে থাকে তার আশপাশে রয়েছে বেশ কয়েকটি কল-কারখানা। আর তারপরই ডাক্তার বুঝে নিল এত অল্প বয়সে রাহেলার হাঁপানির রোগ হওয়ার কারণ।
অন্য দিকে নারায়ণগঞ্জের পাঁচ বছর বয়সী খোকন কয়েকদিন ধরে খুব অসুস্থ। যে ছেলে সারাদিন দৌঁড় ঝাপের ওপর থাকে সে আজ শুয়ে আছে মেডিকেলের বিছানায়। তারও শ্বাস কষ্ট। প্রতিদিন চার থেকে পাঁচ বার করে নেবুলাইজ করতে হচ্ছে তাকে।
এক গবেষণায় দেখা যায়, শিল্প এলাকাগুলোয়, বিশেষ করে কল-কারখানা বেশি আছে এমন এলাকায় জন্ম নেওয়া শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকি অনেক বেশি। এসব এলাকায় জন্ম নেয়া শিশুদের হাঁপানিসহ বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি থাকে। এমনকি এসব শিশুরা অকালে মারাও যেতে পারে।
অকাল মৃত্যু এবং হাঁপানি ছাড়াও কল-কারখানা প্রধান এলাকার এসব শিশুরা আরো বিভিন্ন ধরনের সমস্যা যেমন এডিএইচডি, পরীক্ষায় কম নম্বর পাওয়া, অপুষ্টি এবং শারিরীক দূর্বলতায় ভুগতে পারে।
গবেষকেরা দেখতে পেয়েছেন কল-কারখানা-প্রধান এলাকার ০.৮ কিলোমিটারের মধ্যে জন্ম নেওয়া শিশুদের কম ওজন নিয়ে জন্ম নেবার আশঙ্কা অন্য এলাকায় শিশুদের চেয়ে ২৫ শতাংশ বেশি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের রেজিটার্ড ডা. সাইদুর ইসলাম সোহাগ বলেন, এসব শিল্প প্রধান এলাকায় বসবাসরত গর্ভবতী মায়েদের ওপরও এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। যার ফলে তাদের জন্ম নেয়া শিশুরাও এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারে না।
তিনি বলেন, এসব এলাকার শিশুরা মূলত হাঁপানি রোগেই বেশি আক্রান্ত হয়। কিন্তু অনেক বাবা-মা’ই তাদের সন্তানদের এই নিরব ঘাতক সম্পর্কে শুরুতে কিছুই জানতে পারেন না। অধিকাংশ সময় একেবারে শেষ সময়ে তারা তাদের বাচ্চাদের হাসপাতালে নিয়ে আসেন। তখন আসলে হাজার চেষ্টা করেও বাচ্চাকে বাঁচানো যায় না।
তিনি বলেন, এজন্য দরকার আমাদের সচেতনতা এবং সঠিক পরিকল্পনা। কল-কারখানা প্রধান এলাকায় আবাসিক বাসা-বাড়ি গড়ে তোলা কোনভাবেই উচিত নয়। এছাড়াও বাংলাদেশের অধিকাংশ কল-কারখানা এখনো কোন ধরনের নিয়ম মানে না। তাদের নিজস্ব কোন বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও নেই। যার ফলে বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক রোগ ওইসব এলাকার সাধারন মানুষ বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
মানবাধিকার কর্মী তাসলিমা সুলতানা বলেন, আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে আমরা সব ধরনের কাজের জন্য সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে বসে থাকি। আমাদের অনেকের ধারণা যে সব কিছুই সরকারের দায়িত্ব। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে বাংলাদেশ আয়তনের দিক থেকে ছোট একটি দেশ হলেও এর জনসংখ্যা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। আর তাই আমাদের নিজেদেরও সচেতন হতে হবে।
তিনি বলেন, সরকার কল-কারখানা মালিকদের তাদের কারখানা স্থাপনের জন্য নির্দিষ্ট নীতিমালা করে দিলেও তারা তা না মেনে যত্রতত্র প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে। এছাড়াও এসব কল-কারখানায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ অন্য যেসব পরিবেশবান্ধব নীতিমালা রয়েছে তার কোন তোয়াক্কাই করে না। যার প্রভাব পড়ছে আমাদের শিশুদের উপর। তাদের পাশাপাশি বড়রাও কিন্তু শারিরীকভাবে কম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না।
তিনি বলেন, এ জন্য দরকার আমাদের সচেতনতা। এছাড়াও তিনি শিল্প-প্রধান এলাকায় বাসা-বাড়ি স্থাপন এবং আবাসিক এলাকায় কল-কারখানা স্থাপনের অনুমোদন না দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি জোর আহ্বান জানান।
সুতরাং একটা বিষয় স্পষ্ট যে, একটা দেশের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য শিল্পায়ন এবং জাতির ভবিষ্যত নি:রোগ শিশু উভয়ই দরকার। তবে কিছু বিষয়ে খেয়াল রাখলে দু’টি বিষয়কেই সুন্দরভাবে এগিয়ে নেয়া যায়। ঘনবসতি এলাকায় কল-কারখানা প্রতিষ্ঠা না করা, সরকার কল-কারখানা প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের গৃহীত নীতিমালা সঠিকভাবে প্রয়োগ করলে শিশু স্বাস্থ্য সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এক কথায় বলতে গেলে আমরা সবাই আইন মানলে এবং সচেতন হলে দেশ এগিয়ে যাবে, দূর হবে শিশুর স্বাস্থ্য সমস্যা। দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
বাসস/ইউনিসেফ ফিচার/সুঘো/স্বব/০৯৩০/আহো/ওজি