প্রধানমন্ত্রীর দয়ায় এখন ভিটেবাড়ির মালিক হয়েছে

260

|| জিগারুল ইসলাম ||

চট্টগ্রাম, ১৭ জুন, ২০২১ (বাসস) : জোসনা আকতার (৫৮) এর স্বামী ফজল করিম ২৫ বছর আগে দুরারোগ্য রোগে মারা যান। স্বামীর কোনো ভিটেবাড়ি ছিলনা। ছোট্ট একটি কুঁড়ে ঘরে থাকতে হতো অন্যের আশ্রয়ে। দুই মেয়ে নিয়ে টানাপোড়নের সংসারে জায়গা নিয়ে ঘর করবে এমন সামর্থ্যও নেই বিধবা জোসনা আকতারের। অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাতে হতো তাঁকে। সেই জোসনার দুঃখ ঘুচতে যাচ্ছে। মুজিবশতবর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর আওতায় ২ শতক জমিসহ তিনি একটি পাকা ঘর পাবেন। শয়ন কক্ষের পাশাপাশি, থাকছে রান্নাঘর ও পয়:নিষ্কাশনের ব্যবস্থা।
জোসনা আকতারের বাড়ি চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া পৌরসভার দক্ষিণ ঘাটচেক গ্রামে। আজ সকালে উপজেলার বেতাগী ইউনিয়নের বহলপুর গ্রামে নতুন বরাদ্দ পাওয়া ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে জোসনা আকতার চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বলেন, ‘আগে ভিটেবাড়ি ন আছিল, প্রধানমন্ত্রীর দয়ায় এহন জায়গা ও ঘরর মালিক অই, খুউব খুশি লার” (আগে ভিটেবাড়ি ছিলনা , প্রধানমন্ত্রীর দয়ায় এখন জায়গাও ঘরের মালিক হয়েছি। খুব খুশি লাগছে।
জোসনা আকতারের মতো রাঙ্গুনিয়ায় নতুন করে ৫০ ভূমি ও গৃহহীন পরিবার পাচ্ছে আধা পাকা ঘর। মুজিব বর্ষের উপহার হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী রোববার সকালে ভিডিও কনফারেন্সে সংযুক্ত হয়ে ঘরগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করবেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম বিভাগের মধ্যে শুধু রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় যুক্ত হবেন প্রধানমন্ত্রী।
জোসনার পাশের ঘরে থাকবেন আইসক্রিম বিক্রেতা ইউসুফ সুমন (৪৭)। তাঁর বাড়ি রাঙ্গুনিয়া পৌরসভার উত্তর ঘাটচেক গ্রামে। ইউসুফ এক সময় দিনমজুরী করতো। কয়েক বছর হচ্ছে গ্রামে ঘুরে ঘুরে আইসক্রিম বিক্রি করে। করোনার কারণে এখন সেই ব্যবসাও চলেনা। স্ত্রী ও এক ছেলে সন্তান নিয়ে তাঁর সংসার। জানতে চাইলে ইউসুফ বলেন, জন্মের পর থেকে নানার বাড়িতে থাকতাম। নিজের কোনো জমিজমা ছিলনা। বিয়ের পর থেকে ভাড়া ঘরে থাকতে হতো। প্রধানমন্ত্রীর কল্যাণে এখন তাঁর নিজস্ব ঘর হয়েছে।
সারাদিন কায়িক পরিশ্রম শেষে এখন আর ফুটপাত বা অন্যের ঘরে ফিরতে হবে না ভূমিহীন ও গৃহহীন হতদরিদ্র আবু তাহেরকে। এখন প্রতিদিন ফিরতে পারবেন নিজ ঘরে। শুধু ঘরই নয়, থাকছে নিজ নামে দুই শতক জমি, স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট, সুন্দর বারান্দাসহ বসবাসের নিরাপদ সুবিধা। রাঙ্গুনিয়া পৌরসভার ইছাখালি এলাকার ভূমিহীন আবু তাহেরের চোখে ডেকেছে আনন্দ অশ্রুর বান। ঘর পেয়ে কেমন লাগছে, জিজ্ঞেস করায় বলেন, ‘আমি ছেলে, নাতি ও বোনকে নিয়ে মানুষের জায়গায় কুঁড়েঘর তুলে থাকি। স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনি যে, আমি জমিসহ ইটের একখানা নতুন ঘর পাবো। শেখ হাসিনার সরকার আমাকে ইটের ঘর দিবেন। এই বয়সে ইটের ঘরে থাকতে পারবো। আমি ভীষণ খুশি হয়েছি ঘর পেয়ে। দোয়া করি শেখ মুজিবের মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য।’
রাঙ্গুনিয়া পৌরসভার ইছামতি পাড়ের মনজিল খাতুনের ঘরটা এমনিতেই নড়বড়ে ছিল। ঝড়-তুফানের সময় ভয়ে থাকতেন। এর মধ্যে একদিন ঝড়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনের একটি খুঁটি ভেঙে পড়ে বসতঘর দুমড়েুমুচড়ে যায়। অল্পের জন্য রক্ষা পান বসতঘরের বাসিন্দারা। চোখের সামনে যখন প্রবল অন্ধকার, তখন আলো হয়ে পাশে দাঁড়ায় স্থানীয় সংসদ সদস্য তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। কয়েক মাসের মধ্যে আধা পাকা নতুন ঘর পেয়ে অনেক খুশি তিনি।
মনজিল খাতুন জানান, মাথা গোঁজার ঠাঁই হারিয়ে ছেলে, ছেলের বউ ও নাতি-নাতনিদের নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ি। দিনমজুর ছেলের উপার্জনে কোনো রকমে সংসার চলে। এর মধ্যে নতুন ঘর কীভাবে বানাবেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েন তিনি। একদিন উপজেলা সদরে তথ্যমন্ত্রী আসছেন খবর পেয়ে গিয়ে মানুষের ভিড় ঠেলে দুঃখের কথাটি জানান। পরেরদিন ইউএনও মাসুদুর রহমান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এখন আমার মাথা গোঁজার স্থায়ী ব্যবস্থাটা হলো।
এ উপজেলার বেতাগী ইউনিয়নের বহলপুর আশ্রয়ণ প্রকল্পে জমি ও ঘর পেয়েছে এধরণের ৩০টি পরিবার। উপজেলার অন্যান্য ইউনিয়নে আরো ২০টি পরিবার পাকা ঘর পাচ্ছেন এবার। সরেজমিনে বেতাগী ইউনিয়নের বহলপুর গিয়ে আরও অনেকের অজানা গল্পগুলো জানা গেল। ভূমিহীন পরিচয়টি দিতে খুব কষ্ট হতো ৪০ বছর বয়সী আরিফুল হককে। তিনি আটোরিক্সা চালান। ১ ছেলে সন্তান নিয়ে নতুন ঘরে কাটাবেন খুশি লাগছে তাঁর। তিনি এখন আর ভূমিহীন নয়, তাঁর মনে এখন আর কোনো কষ্ট নেই। এছাড়া নদীভাঙ্গা ছিন্নমূল অসহায় মানুষদের মধ্যে ঘর পাচ্ছেন রাশেদা বেগম, আনোয়ারা বেগম, ঝর্ণা আকতার, রিনা দাশ, সবিতা দাশসহ অনেকেই। তাঁরাও জানিয়েছেন অনেক অজানা কষ্টের কথা।
রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মাসুদুর রহমান বলেন, ‘মুজিববর্ষে কেউ গৃহ ও ভূমিহীন থাকবে না’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই ঘোষণা বাস্তবায়নে মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে রাঙ্গুনিয়ার ভূমি ও গৃহহীন ৬০৬টি পরিবারের তালিকা করা হয়েছিল। রাঙ্গুনিয়ায় প্রথম পর্যায়ে আগে দুই শতাংশ জমির সঙ্গে ঘর পেয়েছেন ১১৫টি পরিবার। আশ্রয়ণ প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে এবার ৫০ পরিবারকে জমির সঙ্গে ঘর দেওয়া হবে। তিনি জানান, প্রথম পর্যায়ে প্রতিটি ঘরের জন্য পরিবহন খরচসহ ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা ধরা হয়েছিল। এবার তা বাড়িয়ে ১ লাখ ৯৫ হাজার টাকা থেকে ১ লাখ ৯৭ হাজার টাকা করা হয়েছে।
“মুজিবশতবর্ষে একজন লোকও গৃহহীন থাকবে না” প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশনা বাস্তবায়নে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের জমি ও ঘর হস্তান্তর উপলক্ষে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. মমিনুর রহমান বৃহস্পতিবার দুপুরে নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে জানান, গত ২৩ জানুয়ারি ১ম পর্যায়ে সারাদেশের ন্যায় চট্টগ্রাম জেলায় ১৪৪৪টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে ০২ শতাংশ জমিসহ সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে ঘর প্রদান করা হয়েছে। এরেই ধারাবাহিকতায় আগামী রোববার ২য় পর্যায়ে চট্টগ্রাম জেলার ১৩ টি উপজেলার ৬৪৯ টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে ২ শতক জমিসহ ঘর প্রদান করা হবে। প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্স এর মাধ্যমে এ কার্যক্রম উদ্বোধন করবেন। চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ২নং বেতাগী ইউনিয়নের বহলপুর গ্রামে ভিডিও কনফারেন্সে সংযুক্ত হবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বহলপুর গ্রামে একসাথে ৩০টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হচ্ছে।
জেলা প্রশাসক জানান, ২০ জুন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রাঙ্গুনিয়া প্রান্তে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদসহ চট্টগ্রামের মন্ত্রীবর্গ, সংসদ সদস্য, বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ, বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকবৃন্দসহ বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষ যুক্ত থাকবেন।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, দ্বিতীয় পর্যায়ে চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় ৫০টি, পটিয়া উপজেলায় ৩০টি, চন্দনাইশ উপজেলায় ২৭টি, সাতকানিয়া উপজেলায় ১০টি, লোহাগাড়া উপজেলায় ১৫০টি, বাঁশখালী উপজেলায় ১৪টি, কনর্ফুলী উপজেলায় ৫টি, বোয়ালখালী উপজেলায় ২০ টি, রাউজান উপজেলায় ২৪৮টি, হাটহাজারী উপজেলায় ১০টি, আনোয়ারা উপজেলায় ৫০টি, মীরসরাই উপজেলায় ২৫টি, সীতাকুন্ড উপজেলায় ১০টি সহ সর্বমোট ৬৪৯ টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে গৃহ প্রদান করা হবে।