জীবন যুদ্ধে জয়ী ও বক্সিংয়ে স্বর্ণপদক বিজয়ী কায়েমার গল্প

2439

ঢাকা, ১৪ জুন, ২০২১ (বাসস) : “হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান। /তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীষ্টের সম্মান/ কন্টক-মুকুট শোভা।-দিয়াছ, তাপস,/ অসঙ্কোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস;/ উদ্ধত উলঙ্গ দৃষ্টি, বাণী ক্ষুরধার,/ বীণা মোর শাপে তব হ’ল তরবার!/”
জাতীয় কবি কাজি নজরুল ইসলামের এই কবিতার আলোয় যেনো আলপথ থেকে রাজপথে হেঁটে চলা এক তরুণীর নাম কায়েমা…। আসুন তাহলে শুণি- জীবন যুদ্ধে ও বক্সিংয়ে স্বর্ণপদক জয়ী একজন কায়েমার গল্প:
পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ আছেন যাদের জন্মের পর থেকেই জীবন যুদ্ধে লড়াই করতে হয়। তবে জীবন যুদ্ধে ঠিকই তারা জয়ী হন, হয়ে উঠেন মহান। আর এ জয়ের পেছনে থাকে তাদের একাগ্রতা ও নিষ্ঠা। তাদেরই একজন এ্যাথলেট কায়েমা খাতুন। বক্সিংয়ে সোনার পদক জিতে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন চাপাইনবাগঞ্জের মেয়ে কায়েমা খাতুন। অথচ জন্মের পর থেকেই তাকে লড়াই করতে হয়েছে জীবন যুদ্ধে। কায়েমার জীবনের গল্পটায় পরতে-পরতে রয়েছে, ক্ষোভ, অভিমান আর কষ্ট। যারা তাকে জানেন তাদের সবার মনেই একটা প্রশ্ন কায়েমার হাতে এত শক্তি কোত্থেকে আসে? হয়তো জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত থেকেই তা পেয়েছেন তিনি। জীবনের সংগ্রাম, অভাব-অনটন তাকে শিখিয়েছে টিকে থাকার সংগ্রামে কিভাবে জয় ছিনিয়ে আনতে হয়। বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশন (বিওএ) আয়োজিত গত মাসে শেষ হওয়া বঙ্গবন্ধু ৯ম বাংলাদেশ গেমস্-২০২০-এ মেয়েদের ৪ কেজি ফ্লাইওয়েট শ্রেণীতে স্বর্ণপদক জিতেছেন চাপাইনবাবগঞ্জের বালিগ্রামের মেয়ে কায়েমা। তবে তার সোনার হাসির গল্পটা অন্য দশজন স্বর্ণপদক জয়ীর মতো নয়। বর্তমানে ১৮ বছর বয়সী কায়েমার জীবন যুদ্ধের লড়াইটা সেই শিশুকাল থেকেই। ছোট বেলা থেকেই জীবনের বাঁকে-বাঁকে দেখা পেয়েছেন অদৃশ্য প্রতিপক্ষের। মুষ্টি পাকিয়ে জিততে-জিততে এসেছেন আজকের বিজয় মঞ্চে। রিংয়ে নামলে যেন তার ভয়-ডর কিছু থাকেনা। এবার স্বর্ণ জয়ের পথে টানা চার ম্যাচ জিতেছেন। তিনটিতেই প্রতিপক্ষকে করেছেন নক আউট।
মাত্র তিন বছর বয়সে বাবাকে হারান কায়েমা। দাদীর সঙ্গে অভিমান করে আত্মহত্যা করেছিলেন কয়েমার বাবা। বাবার মৃত্যুর পর কায়েমার মা সুমি বেগম পুনরায় বিয়ে করেন। সৎ বাবার ঘরে ঠাঁই হয়নি তার। বড় হয়েছেন নানী নুরজাহান বেগমের সংসারে। এই নানীই এখন তার বাবা-মা, পৃথিবী। অথচ নানীর সংসারের আর্থিক অবস্থাও ভাল নয়। নানী গৃহকর্মীর কাজ করেন, মামা নির্মাণ শ্রমিক। মা যেনো থেকেও নেই। আর্থিক অনটন আর বুকের ভেতর জমে থাকা ক্ষোভ, অভিমান নিয়েই বড় কয়েছেন কায়েমা। আনন্দ খুঁজে পেতেন শুধুমাত্র খেলায়। বর্তমানে চাপাইনবাবগঞ্জের শাহ নেয়ামত উল্লাহ কলেজের এইচএসসি প্রথম বর্ষের ছাত্রী। ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময় খেলাধুলায় হাতে খড়ি কায়েমার। নবাবগঞ্জ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার সময় বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় দৌঁড়, লাফে প্রথম হতেন। স্কুলের ক্রীড়া শিক্ষক নুর আলম আর কুমকুম বেগমের অনুপ্রেরণায় কায়েমার খেলাধুলায় আসা।
শিক্ষকদের কাছে কৃতজ্ঞতার শেষ নেই কায়েমার,‘ কুমকুম ম্যাডামকে আমি মা বলে ডাকি। নুর স্যার আর ম্যাডামই আমাকে খেলার জগৎ চিনিয়েছেন।’ জেলা ও বিভাগীয় আন্ত:স্কুল বার্ষিক ক্রীড়ায় কায়েমাকে নিয়মিত খেলাতেন এই দুই শিক্ষক। বক্সিংয়ের হাতে খড়িও নুরনবী স্যারের মাধ্যমে। কায়েমা বলছিলেন,‘স্কুল থেকে একবার বক্সিংয়ের জন্য খেলোয়াড় বাছাই করা হয়। নুর স্যার বললেন , তুই যেহেতু এ্যাথলেটিকসে ভাল, বক্সিংয়েও ভাল করবি।’ কিন্তু নানী অনুমতি দিচ্ছিলেন না। আমার আগ্রহ দেখে স্যার নানীকে বুঝালেন।’
কায়েমা চাপাইনবাবগঞ্জ বক্সিং একাডেমির খেলোয়াড়। কিন্তু স্থানীয় বক্সিং রিংটি ভাঙ্গাচোরা, ব্যবহারের উপযোগী নয়। তাকে অনুশীলন করতে হয় স্থানীয় কলেজ মাঠে। প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি অবশ্য সেখানেও নেই। হাতে প্যাড পরে কোচ রাজু আহমেদ দাঁড়িয়ে থাকেন সামনে, তার হাতের ওপরই ঘুষি মেরে যান কায়েমা। আক্ষেপ করে কায়েমা বলেন,‘ অনেক কষ্ট করে অনুশীলন করতে হয়। রাজু স্যারও অনেক সময় নানা কাজে ব্যস্ত থাকেন, নিজের আগ্রহে যতটুকু পারি করি।’
যে বয়সে বাবাকে হারিয়েছেন তার চেহারা কায়েমার মনে থাকার কথা নয়। দাদীর কাছে বাবার ছবি চেয়েও পাননি কখনো। অন্য মেয়েরা যখন বাবার কাছ থেকে উপহার পায়, কায়েমা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। তবে বাবাকে দেয়ার মত উপহার এখন আছে তার হাতেই। প্রয়াত বাবাকেই যে উৎসর্গ করেছেন স্বর্ণ পদকটি,‘বাবার চেহারা মনে নেই। তার অভাব খুব অনুভব করি। স্বর্ণ জয়ের পর রিংয়ে তার জন্যই কেঁদেছিলাম। বাবা থাকলে নিশ্চই অনেক খুশি হতেন।’
বাংলাদেশ গেমসের সাফল্য বদলে দিয়েছে কায়েমার স্বপ্নের রঙ। পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি এসএ গেমসেও স্বর্ণ পদক জিততে চান তিনি। তবে সে জন্য দরকার অনুশীলনের ভাল সুযোগ-সুবিধা। সাফল্যের বাকি রসদটাতো ওর জীবন থেকেই পাওয়া। কায়েমা বলছিলেন,‘ রিংয়ে উঠলে শুধু মনে হয়, সামনে যে আছে তাকে মারতে হবে। আমাকে জিততে হবে।’
বাংলাদেশ গেমসে স্বর্ণ পদক জয় করে বাড়ি ফেরার পর কায়েমাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন নানী নুরজাহান বেগম। অবশ্য এ কান্নাটা আনন্দের। তিনি বলছিলেন,‘ অনেক কষ্টে বড় হয়েছে আমার নাতনিটা। কোনদিন স্বপ্নেও ভাবিনি ঢাকা গিয়ে ও এত বড় পদক জিতবে। আজ ওর বাবা থাকলে হয়তোবা অনেক খুশি হতো। নাতনির কোন চাওয়া আমরা পুরণ করতে পারিনি। তবে ওর মনের ভিতর সব সময় এটা জিদ কাজ করতো। তারই ফসল আজকের এই পদক। আজ গ্রামের সবাই ওকে দেখতে আসছে, প্রসংশা করছে, আমার খুব আনন্দ হচ্ছে।’