ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার গ্রামীণ জীবনে এনেছে নাগরিক স্বস্তি

2074

॥ দেবদুলাল ভৌমিক ॥
চট্টগ্রাম, ১১ জুন ২০২১ (বাসস) : বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী সাহেরখালী গ্রামের দরিদ্র গৃহবধূ রোকসানা সরকারের মাতৃত্বকালীন ভাতার তালিকাভুক্ত। কিন্তু করোনাকালে প্রায় ১২ কিলেমিটার দূরবর্তী উপজেলা সদরে গিয়ে লাইন ধরে ভাতা নেয়াটা তার জন্য একদিকে যেমন স্বাস্থ্যঝুঁকিপূর্ণ, তেমনি সময়সাপেক্ষ। কিন্তু এই দুর্যোগে টাকার খুবই প্রয়োজন। তাই বাড়ির পাশের সাহেরখালী ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে গিয়ে পরামর্শ চাইলেন।
সেন্টারের উদ্যোক্তা সাইদুল ইসলাম খুব সহজেই এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ৬ মাসের ৩০ হাজার টাকা মাতৃত্বকালীন ভাতা তুলে দিলেন। রোকসানা ভাবতে পারেননি এত সহজেই তিনি ভাতা পেয়ে যাবেন।
সাইদুল জানান, রোকসানার মতো একই ইউনিয়নের আরো ৮৪ জন মাতৃত্বকালীন ভাতাভোগীর বেশির ভাগই এসময় এজেন্ট ব্যাংকিয়ের মাধ্যমে সরকারি সহায়তা পেয়েছেন।
মিঠানালার শেখ খায়রুল ইসলাম একদিন রাতে জানতে পারলেন পরদিন সকালেই ঢাকায় তার ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষা। তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। রাতের বাসেই না হয় ঢাকা যাবেন। কিন্তু ইন্টারভিউ কার্ড তো প্রিন্ট করা নেই। ১০ কিলোমিটার দূরের উপজেলা সদরে এত রাতে দোকানও খোলা থাকার কথা নয়। প্রস্তুতি ভালো ছিল বলে কষ্টটা একটু বেশি পাচ্ছিলেন। হতাশা নিয়ে ব্যাগ গোছাতে গোছাতে ফোন দিলেন বাড়ির পাশের মিঠানালা ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা মিনহাজ উদ্দিনকে। গুরুত্ব বুঝে সাথে সাথে বাড়ি থেকে গিয়ে সেন্টার খুললেন মিনহাজ। ইন্টারভিউ কার্ড ডাউনলোড করে প্রিন্ট করে দিলেন। ওই কার্ড নিয়ে মধ্যরাতের বাস ধরে পরদিন সিটি ব্যাংকের অফিসার পদে ইন্টারভিউ দিলেন খায়রুল। সেই ইন্টারভিউ দিয়েই চাকুরি পেয়ে খায়রুল এখন স্বাবলম্বী।
ব্যাংক কর্মকর্তা খায়রুল ইসলাম বাসসকে বলেনন, ‘সত্যি বলতে কি, ওইদিন রাতে যদি ডিজিটাল সেন্টার থেকে ইন্টারভিউ কার্ড পিন্ট করতে না পারতাম তাহলে হয়তো আমি এখনও বেকারই থাকতাম। প্রতিযোগিতামূলক বাজারে এমন সুযোগ পাওয়াও কঠিন। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ডিজিটাল সেন্টার স্থাপনের উদ্যোগের কারণেই আমি আজ স্বাবলম্বী। তথ্য প্রযুক্তিকে গ্রামীণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ায় সরকারকে ধন্যবাদ জানাই।’
মিঠানালা ইউনিয়ন পরিষদের ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, একটি ডেস্কটপ, একটি ল্যাপটপ, ইন্টারনেট সংযোগ, প্রিন্টার, ডিজিটাল ক্যামেরা, ফটোকপিয়ার মেশিন, স্ক্যানার, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, লেমিনেটিং মেশিনসহ আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র নিয়ে এই সেন্টার। করোনাকালেও বিভিন্ন সেবা পাওয়ার আশায় নারী-পুরুষেরা ভিড় করেছে।
তাদেরই একজন রোকেয়া বেগম জানালেন, ‘আমার স্বামী বিদেশ থেকে কিছু টাকা পাঠানোর কথা। আর বিদ্যুৎ বিলও দিতে হবে। আগে উপজেলায় যেতে হতো। এখন বাড়ির পাশে ডিজিটাল সেন্টার হওয়ায় এত দূর যেতে হয় না, খরচও কম।’
এই সেন্টারের উদ্যোক্তা মিনহাজ উদ্দিন জানালেন, ‘প্রথম প্রথম লোকজন জানতো না, কম আসতো। এখন জানাজানি হওয়ায় সবাই আসে। যতদূর সম্ভব গ্রামের মানুষদের সহায়তার চেষ্টা করি। গত দুই মাসে অনেককে করোনা টিকার রেজিস্ট্রেশন করে দিয়েছেন বলেও জানান মিনহাজ। এছাড়া বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, আবেদন ফরম পূরণ, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন, ই-মেইলসহ প্রতিদিন গড়ে ৩০ জন এ সেন্টার থেকে সেবা নিয়ে থাকেন।’
সাহেরখালী ডিজিটাল সেন্টারে গিয়ে কথা হয় উদ্যোক্তা সাইদুল ইসলামের সাথে। তিনি বলেন, ‘ভিজিডি (ভালনারেবল গ্রুপ ডেভেলপমেন্ট) ভাতাভোগী মহিলাদের জন্য বরাদ্দ প্রতিমাসে ৩০ কেজি চাল। এ সময় তাদের ২শ টাকা করে জমা দিতে হয়। দুই বছর পর ওই টাকা তারা সুদসহ ফেরৎ পান। এ কাজটা সেন্টার থেকে সহজেই করে দিচ্ছি। এ সেবা পেয়ে বয়স্ক মহিলারাও খুব খুশি।’ প্রতিদিন ৩৫-৪০ জনকে বিভিন্ন সেবা নেন বলে জানান তিনি।
চট্টগ্রাম জেলার সাগর উপকূলবর্তী মিরসরাই উপজেলার সাহেরখালী ও মিঠানালা ইউনিয়নের মত সারাদেশের ৪ হাজার ৫৭১ টি ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারসহ মোট ৭৬০২ টি ডিজিটাল সেন্টার থেকে লাখ লাখ মানুষ সেবা পাচ্ছেন। আর এর মাধ্যমে কর্মসংস্থান হয়েছে ১৫ হাজার ২শ চার জন উদ্যোক্তার, যার অর্ধেকই নারী। এসব উদ্যোক্তারা মাসে এলাকাভেদে ১০ হাজার টাকা থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করেন। নারী উদ্যোক্তাদের অনেকে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থার উন্নয়ন ঘটিয়েছেন।
মিঠানালা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কাশেম বলেন, ‘জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা ডিজিটাল সেন্টারের সব কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করেন। আমরাও উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেই এবং কোনো সমস্যা হলে সমাধানে পরামর্শ ও সহায়তা করি। ইউনিয়ন পরিষদের সচিবরাও বিভিন্ন সময়ে তাদের সাহায্য করে। ইউনিয়ন পরিষদের তথ্যপ্রযুক্তি সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনায়ও এই ডিজিটাল সেন্টার সহযোগী ভূমিকা পালন করছে।’
তিনি বলেন, ‘ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তারা বেতনভোগী না হওয়ায় তারা জনসাধারণকে সরকারি-বেসরকারি সেবাদানের মাধ্যমে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ উপার্জন করেন। সেন্টারের দৈনন্দিন খরচ – যেমন ইউটিলিটি চার্জ, ইন্টারনেট বিল, কম্পিউটার রক্ষণাবেক্ষণ খরচ ইত্যাদি উদ্যোক্তাকে বহন করতে হয়। ডিজিটাল সেন্টারের উপকরণ রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের দায়িত্বও উদ্যোক্তার। প্রয়োজন অনুযায়ী উপকরণ বাড়াতে উদ্যোক্তা নিজে বিনিয়োগ করেন। ডিজিটাল সেন্টারকে সচল রাখা, আয় বৃদ্ধি ও টেকসইকরণের ক্ষেত্রে চেয়ারম্যান ও সচিবের সঙ্গে সমন্বয় করে এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসারের পরামর্শে উদ্যোক্তা সব প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারেন।’
চেয়ারম্যান আবুল কাশেম ডিজিটাল সেন্টারকে বর্তমান সরকারের যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলে অভিহিত করেন।
ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা ও এ্যাসপায়ায়ার টু ইনোভেট (এটুআই)-এর চট্টগ্রাম বিভাগীয় ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তা জাহেদ হোসেন বলেন, “আমি মনে করি ডিজিটাল সেন্টার অজ পাড়াগাঁয়ের মানুষদের জন্য বর্তমান সরকারের অনন্য উপহার। শুধু গ্রামে থাকার কারণে এখন দেশের মানুষ কোনো সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন না। এর মাধ্যমে ১৫ হাজারের বেশি তরুণ-তরুণীর কর্মসংস্থান হয়েছে। উদ্যোক্তারা একটু পরিশ্রম করলে গ্রামে বসেই মাসে ১০-১৫ হাজার টাকা বা আরও বেশি আয় করতে পারছেন। এছাড়া গ্রামের সাধারণ পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোর উপকার করতে পেরে আমাদের আত্মতৃপ্তিও কম নয়।”
তিনি বলেন, ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে তৃণমূলের কৃষকদের কৃষিঋণ দেয়ার যে প্রাথমিক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তা বাস্তবায়িত হলে কৃষকরা উপকৃত হবেন। বর্তমানে কৃষিঋণ নিতে যে দীর্ঘসূত্রিতা হয় তা থেকে রেহাই পাবেন কৃষকরা।
ডিজিটাল সেন্টার প্রজেক্ট ইমপ্লিমিন্টেশনের ন্যাশনাল কনসালটেন্ট কামাল হোসাইন সৈকত বাসসকে জানান, ‘এক্সেস টু সার্ভিস, এক্সেস টু স্কিল এবং এক্সেস টু ফাইনান্স’ এই তিন কার্যক্রম বাস্তবায়নে কাজ করছে ডিজিটাল সেন্টার। ভবিষ্যতে জনগণ এ সেন্টার থেকে ১৫ শ ধরনের সেবা পাবেন। এছাড়া প্রতি মাসে এক কোটি মানুষকে সেবা দেয়ার টার্গেট নিয়ে কাজ করছে ডিজিটাল সেন্টার। এই টার্গেট পূরণে প্রতিটি ইউনিয়নের পাশাপাশি দেশের প্রতিটি বাজারে একটি করে ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন করা হবে। তিনটি লক্ষ্য অর্জনে আমরা কাজ করছি, শহরের সুবিধা গ্রামে, গ্রামের সুবিধা শহরে, আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি ও নারীর ক্ষমতায়ন।’
কর্মসংস্থানের পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে উল্লেখ করে সৈকত বলেন, ‘আমি দেখেছি, চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ, নওগাঁ, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন স্থানে ডিজিটাল সেন্টারের নারী উদ্যোক্তারা অন্যকে সেবা দিতে গিয়ে নিজেদের দক্ষতা ও জনপ্রিয়তাও বড়িয়েছেন। অনেক স্থানে উপজেলা ভাইস-চেয়ারম্যান, পৌর কাউন্সিলর, চেয়ারম্যান-মেম্বার নির্বাচিত হচ্ছেন। এটিও ডিজিটাল সেন্টারের একটি বড় সুফল।’
‘জনগণের দোরগোড়ায় সেবা’ এ স্লোগান নিয়ে পরিচালিত ডিজিটাল সেন্টারে প্রায় ২৯৪ টি সেবা কার্যক্রম চালু রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ, অনলাইন ব্যাংকিং, বিদেশে চাকরির আবেদন, টিকা নিবন্ধন, ইন্টারভিউকার্ড ডাউনলোড ও প্রিন্ট, পাবলিক পরীক্ষার ফল, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, পাসপোর্টের আবেদন, ভিসা ভেরিফিকেশন ও ট্র্যাকিং, অনলাইনে ড্রাইভিং লাইসেন্সের আবেদন ও নবায়ন, শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসর ভাতার আবেদন, টেলি মেডিসিনের মাধ্যমে স্বাস্থ্য পরামর্শ, কৃষি পরামর্শ, আইনি সহায়তা, মোবাইল রিচার্জ, সিম বিক্রয়, কম্পিউটার এবং কারিগরি প্রশিক্ষণ, ই-মেইল, কম্পোজ-প্রিন্ট, সরকারি প্রজ্ঞাপন ও বিজ্ঞপ্তি ইত্যাদি। আগামীতে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে কৃষিঋণ দেয়ারও পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে প্রতি মাসে এসব ডিজিটাল সেন্টার থেকে সারাদেশের প্রায় ৬০ লাখ মানুষ সেবা পাচ্ছে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জনগণের দোরগোড়ায় সহজে, দ্রুত ও স্বল্প ব্যয়ে সরকারি সেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে ২০১০ সালের ১১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দেশের ৪ হাজার ৫০১টি ইউনিয়নে একযোগে ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্র উদ্বোধন করেন, যা বর্তমানে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার (ইউডিসি) নামে পরিচিত। ২০১৩ সালে দেশের সকল পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনে ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন করা হয়। বর্তমানে ৩২৮টি পৌর ডিজিটাল সেন্টার (পিডিসি) এবং ৪৬৫ টি নগর ডিজিটাল সেন্টার (সিডিসি) রয়েছে। ২০১৮ সালে গাজীপুরে গার্মেন্টস কর্মীদের জন্য ৫টি ও খুলনার রূপসায় মৎস্যজীবীদের জন্য একটিসহ মোট ৬ টি স্পেশালাইজড ডিজিটাল সেন্টার চালু করা হয়।