চট্টগ্রামে বদলি জেল খাটা মিনুকে মুক্তির নির্দেশ দিয়ে হাইকোর্টের আদেশ

429

ঢাকা, ৭ জুন, ২০২১ (বাসস): চট্টগ্রামে হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদন্ডপ্রাপ্ত আসামি কুলসুম আক্তারের হয়ে জেল খাটা মিনুকে মুক্তির নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি মহি উদ্দিন শামীম সমন্বয়ে গঠিত একটি ভার্চ্যুয়াল হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চ আজ এ আদেশ দেয়।
বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে আনা আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বাসসকে আজ এ কথা জানান।
তিনি বলেন, প্রকৃত আসামি কুলসুম আক্তার কুলসুমীকে দ্রুত গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। এছাড়া কুলসুমীর স্বাক্ষর জালিয়াতি করে যারা হাইকোর্টে জামিন আবেদন করেছে সেই আইনজীবী ও তদবিরকারীদের তলব করা হয়েছে । আগামী ২৮ জুন হাইকোর্টে তাদেরকে হাজির হয়ে এ বিষয়ে উপযুক্ত ব্যাখ্যাসহ জবাব দিতে বলা হয়েছে।
অর্থের বিনিময়েই হোক আর অন্য কোনো কৌশলেই হোক প্রকৃত অপরাধীর পরিবর্তে নিরাপরাধ লোককে কারাগারে আটক রাখা দুর্ভাগ্যজনক। হত্যা মামলায় নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি কুলসুমীর পরিবর্তে কারাবন্দি নিরীহ মিনুর মুক্তির আবেদনের শুনানিতে আদালত এ মন্তব্য করে।
আদালতে মিনুর পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি এটর্নি জেনারেল ড. মো. বশির উল্লাহ।
মিনুর বিষয়টি ৩১ মার্চ এ ঘটনা হাইকোর্টের নজরে আনেন আইনজীবী শিশির মনির। ঘটনার বিবরণী হলো-মোবাইল ফোন নিয়ে শত্রুতার জেরে ২০০৬ সালের ৯ জুলাই চট্রগ্রাম নগরীর রহমতগঞ্জ এলাকায় পোশাক কারখানার কর্মী কোহিনুর বেগম খুন হন। ওই ঘটনায় হওয়া মামলায় ২০০৭ সালের ২৬ অক্টোবর চট্রগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার গৌরস্থান মাঝেরপাড়া গ্রামের আনু মিয়ার মেয়ে কুলসুমীকে গ্রেফতার করা হয়। ২০০৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি চট্রগ্রাম আদালত থেকে জামিন পেয়ে কারাগার থেকে মুক্তি পান কুলসুমী। পরবর্তীতে এ মামলায় বিচার শেষে ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর চট্রগ্রামের চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত এক রায়ে কুলসুমীকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদন্ড দেন। রায়ের দিন কুলসুমী আদালতে অনুপস্থিত থাকায় তাকে পলাতক দেখিয়ে রায় ঘোষণা করা হয়।
এরপর মর্জিনা নামে একজনের মাধ্যমে ভাসমান বস্তিতে মিনুকে পান কুলসুমী। মিনুর স্বামী ঠেলাগাড়ি চালক বাবুল সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর তিন সন্তান নিয়ে চট্রাগ্রামে ভাসমান বস্তিতে থাকতেন।
মিনুর দুই ছেলে ও এক মেয়ে। এ পরিস্থিতিতে মিনু ও তার সন্তানদের ভরণপোষণ দেয়ার প্রস্তাব দেন কুলসুমী। বিনিময়ে একদিন আদালতে হাজির হতে হবে বলে জানানো হয় মিনুকে। আদালতে হাজির হলে তার জামিনও করিয়ে আনবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। মিনু কুলসুমীর কথায় রাজি হয়ে কুলসুমী সেজে ২০১৮ সালের ১২ জুন আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। এরপর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। সেই থেকে মিনু কারাবন্দি। এরপর নিম্ন আদালতের সাজার বিরুদ্ধে ২০১৯ সালে হাইকোর্টে আপিল করেন কুলসুমী। একারণে ওই বছরের ১২ জুন মামলার নথি হাইকোর্টে পাঠানো হয়। ওই মামলাটি হাইকোর্টে বিচারাধীন।
জানা গেছে, মিনু কারাগারে যাওয়ার পর প্রথম প্রথম কয়েকমাস মিনুর সন্তানদের ভরণপোষণ দিলেও কয়েক মাস যেতে না যেতেই মিনুর পরিবারের খোঁজ নেয়া বন্ধ করে দেন কুলসুমী। ওদিকে মিনুর দীর্ঘ হতে থাকে কারা জীবন। মিনুর আর খোঁজ নেননি কুলসুমী। এ অবস্থায় মিনু পুরো ঘটনা কারা কর্তৃপক্ষের কাছে ফাঁস করে দেন। প্রথম প্রথম কেউ তার কথা না শুনলেও গত ১৮ মার্চ কুলসুমীর পরিবর্তে মিনুর কারাভোগের বিষয়টি চট্রগ্রাম কারাগারের জ্যেষ্ঠ জেল সুপার মো. শফিকুল ইসলাম খানের নজরে আসে। এরপর তিনি বিষয়টি নিজে অনুসন্ধান করেন। কারাগারে থাকা নথিতে কুলসুমীর ছবির সঙ্গে মিনুর ছবির মিল খুঁজে পায় না কারা কর্তৃপক্ষ। গত ২১ মার্চ সিনিয়র জেল সুপার মো. শফিকুল ইসলাম খান রায় প্রদানকারী আদালতের নজরে আনেন বিষয়টি। এরপর মিনুকে আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেয়া হলে পরদিন ২২ মার্চ কারাগার থেকে মিনুকে আদালতে হাজির করা হয়। মিনু হাজির হয়ে আদালতকে বলেন, তিন বছর আগে মর্জিনা নামের একজন মহিলা ডাল-চাল দেবেন বলে ডেকে নিয়ে কুলসুমীর সাথে পরিচয় কওে দেয়। আমি তখন ভাসমান বস্তিতে নিজের ঘরে ছিলাম।
আদালত মিনুর ঘটনা লিপিবদ্ধ করে প্রয়োজনীয় আদেশের জন্য একটি নথি গত ২৩ মার্চ হাইকোর্টে পাঠায়। পরদিন ২৪ মার্চ নথি হাইকোর্টে পৌঁছে যায়। এ অবস্থায় গত ৩১ মার্চ বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে আনেন আইনজীবী শিশির মনির।
জেলে থাকা মিনুর ভাই মো. রুবেল গনমাধ্যমকে জানিয়েছেন, গত ২০১৮ সালের রমজান মাসে যাকাতের টাকা ও খাদ্যসামগ্রী দেবে বলে মিনুকে ডেকে নিয়ে যায় পাশের বাসার মর্জিনা আক্তার নামে এক নারী। এরপর থেকে মিনু আক্তার নিখোঁজ। অনেক খোঁজাখুজি করেও তার কোনো সন্ধান পাননি বলেও জানান তিনি।