বাসস ইউনিসেফ ফিচার-১ : শিশুর কৈশরকালীন যত্ন

115

বাসস ইউনিসেফ ফিচার-১
শিশু-যত্ন
শিশুর কৈশরকালীন যত্ন
ঢাকা, ৫ জুন, ২০২১ (বাসস) : মাহি আবরারের (১৪) খাবারে অরুচি। ছোটবেলা থেকে সে দুধ-ডিম ও মাছ-মাংস খেতে পছন্দ করতোনা। নানা ধরনের ফাস্টফুড ও কোকাকোলাই ছিল তার পছন্দের খাবার। তার মা বলেন, “বয়স অনুযায়ী তার উচ্চতা কম এবং সে পড়ালেখায় ভীষণ অমনোযোগী। চিকিৎসক বলেছে, ঠিকভাবে খাবার না খাওয়ার জন্য এ ধরনের সমস্যা হয়। তবে এখনো সময় আছে। তার অভ্যাস পাল্টাতে হবে।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের কৈশরকালীন সময়ে শারিরীক ও মানসিক যত্ন প্রয়োজন। নইলে তারা ঠিকভাবে গড়ে উঠতে পারবেনা। দেশের মোট জনসংখ্যার এক পঞ্চমাংশের বেশি অর্থাৎ ৩৪ মিলিয়ন কিশোর-কিশোরি। তাদের বয়স ১০-১৯ বছর। বাংলাদেশ জনতাত্ত্বিক ও স্বাস্থ্য জরিপ- ২০১৪ অনুযায়ী, শহর ও গ্রামের ১৫-১৯ বছর বয়সী কিশোরির পুষ্টি ও স্বাস্থ্যগত অবস্থা আশঙ্কাজনক। বিশেষ করে কিশোরিদের খর্বাকৃতির হার শহর ও গ্রামাঞ্চলে যথাক্রমে ৩৯.৯ এবং ৩৪.৫ শতাংশ এবং রক্তস্বল্পতার হার ৪০ ও ৩৬শতাংশ।
এ বয়সেই শিশুরা শারিরীক ও মানসিকভাবে বেড়ে ওঠে। এ বিষয়ে বারডেমের প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান শামসুন্নাহার মহুয়া বলেন, “সাধারণত মেয়েদের উচ্চতা ১৬ বছর এবং ছেলেদের উচ্চতা ১৭ বছর বয়সের পর আর বাড়েনা। সেজন্য কৈশোরকালীন সময়ে তাদের বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত ক্যালরী সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। তাদের আইকিউ বা স্মৃতিশক্তির জন্য প্রোটিন, ভিটামিন বিশেষ করে ভিটামিন বি, ভিটামিন ১২, আয়রন ও মিনারেলস বেশি প্রয়োজন। তাদের শক্তির জন্য কার্বহাইট্রেড প্রয়োজন। অবশ্যই তাদের হাড়ের গঠণ ও হাড় মজবুত করার জন্য ক্যালসিয়াম যুক্ত খাবার খেতে হবে।”
এ সময় চারপাশের অনেক কিছুর সাথে তারা পরিচিত হয়। নানা বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ তাদেরকে খানিকটা বদলে দেয়। এই বদলে দেয়াকে বাবা-মার ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করা উচিত এবং তাদেরকে পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর বিষয়টি শেখানো প্রয়োজন। এজন্য তাদের মানসিক গঠণকে গুরুত্ব দেয়ার কথা বলছেন মনোরোগবিদরা। এ বিষয়ে তাদের সাথে কথা বলা এবং সুবিধা অসুবিধা জানা প্রয়োজন। অনেক সময় এ বয়সে কোনো শিশু সহিংসতার শিকার হতে পারে। সেক্ষেত্রে তার সমস্যা থেকে তাকে বের করে আনতে হবে। প্রয়োজনে মনোরোগবিদের সাহায্য নিতে হবে।
আর্মড ফোর্স মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতালের সাবেক অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ডা. আজিজুল ইসলাম বলেন, “এ সময় তাদের স্বকীয়তা ও পরিচয় গড়ে ওঠে এবং তাদের নৈতিকতা ডেভলপ করে। তারা সমবয়সীদের কথা বেশি শোনে। এজন্য বাবা-মাকে সতর্ক হতে হবে তারা যেনো কোনো ভুল না করে। তাদেরকে শেখানো প্রয়োজন কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ। যদি তাদের সাথে বন্ধন অটুট থাকে তাহলে তারা কথা শুনবে, নইলে শুনবেনা। এজন্য অবশ্যই তাদেরকে রাগ করে নয়, ভালোবাসা-আদর দিয়ে বোঝাতে হবে।”
তিনি আরো বলেন, “এক্ষেত্রে স্কুলের বড় ভূমিকা রয়েছে। শিক্ষকরাও তাদেরকে নীতি-নৈতিকতা-মূল্যবোধ সম্পর্কে জানাবেন। এ সময় তাদেরকে গান-বাজনা ও খেলাধূলায় ব্যস্ত রাখলে তাদের সুকুমার বৃত্তির বিকাশ ঘটবে এবং বেড়ে ওঠায় এসব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এক্ষেত্রে সমাজ ও রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব আছে। এজন্য সাইবার জগতের অবাধ ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।”
শিশুর কৈশরকালীন যতœ ও সুরক্ষার বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে বলে উল্লেখ করেছেন ইউনিসেফের পুষ্টি বিষয়ক কর্মকর্তা ডা. আইরিন আখতার চৌধুরি। তিনি বলেন, “এসময় অনেক শিশু অপুষ্টিতে ভোগে। তারা ঠিকভাবে পুষ্টিকর খাবার না খেলে শারিরীক এবং মানসিকভাবে অনেক ঘাটতি থেকে যায়। এমনকি এজন্য তারা বিষন্নতায় ভুগতে পারে। এ সময় কিশোরিদের মাসিকচক্র শুরু হয় এবং এ বিষয়ে তাদেরকে প্রয়োজনীয় পরিচ্ছন্নতা এবং বিশেষ যতœ নেয়া শেখানো প্রয়োজন। অনেক পরিবার এ সময় তাদেরকে প্রোটিন জাতীয় খাবার দিতে চায়না। অথচ মাসিকের জন্য তাদের শরীরে যে ঘাটতি হয় সেটা প্রোটিন জাতীয় খাবার দিয়ে পূরণ করতে হয়। এতে যে আয়রন ভিটামিন ও মিনারেলস থাকে তা তার ঘাটতি পূরণে সাহায্য করে। নইলে ধীরে ধীরে তার রক্তশূণ্যতা হতে পারে।” তিনি আরো বলেন, “মাসিকের সময় তারা কিভাবে নিজের যতœ নেবে তা তাদেরকে জানানো ও শেখানো প্রয়োজন। স্কুলগুলোতে মেয়েদের জন্য আলাদা টয়লেট প্রয়োজন। এমনকি স্কুলে কোনোও কিশোরির হঠাৎ মাসিক হলে সে যেনো ঐ মুহুর্তে স্কুল থেকে স্যানিটারি ন্যাপকিন পায় তার ব্যবস্থাও করা প্রয়োজন। এসব বিষয় নিয়ে ইউনিসেফ সরকারের সাথে কাজ করছে।”
এ বিষয়ে এমিরেটস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরি বলেন, “১০-১৪ বছরের শিশুদের পরিবর্তনটা বেশি হয়। এ সময় অনেকে বড়দের মতো আচরন করে। ভালোমন্দ বুঝতে পারেনা। তারা ভুল পথে চলে যায়। সেজন্য তাদেরকে ভালো আচরণ শেখানো প্রয়োজন এবং গাইড ও মনিটর করা উচিত। তাদেরকে পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার নিয়ম-কানুনগুলো শেখাতে হবে। তাদের আনন্দ বিনোদনের বিষয়েও যতœবান হওয়া প্রয়োজন। তাদেরকে ভালো বই পড়তে দেয়া, ভালো সিনেমা দেখানো, আতœীয়-বন্ধুদের সাথে মিশতে দেয়া, মাঝে মধ্যে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া, নতুন কিছু করতে উৎসাহিত করাও প্রয়োজন।”
কৈশরকালীন যতœ ও শিক্ষা এমন হওয়া প্রয়োজন যা তাদের সমগ্র জীবনকে সুন্দরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং জীবনকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করতে পারে এমনই বলছেন অভিজ্ঞজনেরা।
বাসস/ইউনিসেফ ফিচার/মহ/০৯১০/এবিএইচ