চা শিল্প পঞ্চগড়ের গ্রামাঞ্চলে এনেছে আাধুনিকতার ছোঁয়া

323

রংপুর, ৪ জুন, ২০২১ (বাসস) : চা চাষাবাদ সম্প্রসারণের পাশাপাশি দ্রুত বিকাশমান চা শিল্প দেশের সর্বোত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের গ্রামাঞ্চলে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে পরিবর্তন এবং আধুনিকতার ছোঁয়া এনেছে। সাথে সাথে সৃষ্টি হয়েছে টি ট্যুরিজমের ব্যাপক সম্ভাবনা।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে এবং পঞ্চগড় জেলা প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশ চা বোর্ডের আয়োজনে পঞ্চগড়ে ‘মুজিব বর্ষের অঙ্গীকার, চা শিল্পের প্রসার’ প্রতিপাদ্য নিয়ে দেশে প্রথমবারের মতো শুক্রবার জাতীয় চা দিবস পালন উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তারা একথা বলেন।
পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আজাদ জাহানের সভাপতিত্বে জেলা প্রসাশকের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক ড. সাবিনা ইয়াসমিন।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন পঞ্চগড়ের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ইউসুফ আলী, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও চা চাষী আনোয়ার সাদাত স¤্রাট, পঞ্চগড় এম আর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ও চা চাষী দেলওয়ার হোসেন প্রধান, ঠাকুরগাঁয়ের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক কামরুন নাহার, বাংলাদেশ স্মল টি গার্ডেন ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহসভাপতি অ্যাডভোকেট আবু বকর ছিদ্দিক, চা চাষী আনিসুজ্জামান নতুন এবং জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক শহীদুল ইসলাম শহীদ।
সভায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ চা বোর্ডের নর্দান বাংলাদেশ প্রকল্পের পরিচালক এবং উর্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা কৃষিবিদ ড. শামীম আল মামুন। সভাটি সঞ্চালনা করেন পঞ্চগড় চা বোর্ডের উন্নয়ন কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো: আমির হোসেন।
সভায় পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও ও লালমনিরহাট জেলার চা চাষী ও কারখানা মালিকগন উপস্থিত ছিলেন।
সভা শেষে রচনা প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের পুরস্কার ও সনদ বিতরণ করা হয়।
পরে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় চত্বরে আয়োজিত চা মেলার উদ্বোধন করেন জেলা প্রশাসক ড. সাবিনা ইয়াসমিন। মেলায় বিভিন্ন চা কারখানা কর্তৃপক্ষ তাদের উৎপাদিত চা নিয়ে ১৫ টি স্টল স্থাপন করেন।
এর আগে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ’ইতিহাস ও ঐতিহ্য গ্যালারী-২’ নামে সমতলের চা শীর্ষক এক গ্যালারীর উদ্বোধন করা হয়। গ্যালীরীতে বঙ্গবন্ধুর চা পান, চা বোর্ডের চেয়ারম্যান, চা চাষ, চা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যসহ সমতলের চা চাষের বিভিন্ন ছবি প্রর্দশন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ টি বোর্ডের নর্দান বাংলাদেশ চা প্রকল্পের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও প্রকল্প পরিচালক ড. মোহাম্মদ শামীম আল মামুন জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্ব, দুরদর্শিতা ও কৃষিক্ষেত্রে উন্নয়নের কারণেই বদলে গেছে পঞ্চগড়ের মানুষের জীবন যাত্রা।
মহামারী করোনা পরিস্থিতিতেও গতবছর চা উৎপাদনে সর্বোচ্চ রেকর্ড হয়েছে। ২০২০ সালে পঞ্চগড়সহ উত্তরবঙ্গের পাঁচ জেলায় সমতলের ১০টি চা-বাগান ও সাত সহস্রাধিক ক্ষুদ্রায়তন চা-চাষির চা-বাগান থেকে সংগৃহীত সবুজ পাতা কারখানায় প্রক্রিয়াজাত করে এক কোটি তিন লাখ বা ১০ দশমিক ৩০ মিলিয়ন কেজি প্রসেস চা-উৎপাদিত হয়েছে। গতবছর চায়ের জাতীয় উৎপাদন হয়েছে ৮৬.৩৯ মিলিয়ন কেজি। এর মধ্যে উত্তরাঞ্চলের সমতলের চা-বাগান থেকে ১১ দশমিক ৯২ শতাংশ জাতীয় পর্যায়ে উৎপাদন হয়।
ড. আল মামুন জানান, ১৯৫৭ সালের ৪ জুন প্রথম বাঙালি হিসেবে তৎকালীন চা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। চা শিল্পে তার অবদান চা বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে যোগদানের তারিখকে ন্সরণীয় করে রাখতে এবং দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে চা শিল্পর ভূমিকা বিবেচনায় সরকার ৪ জুনকে জাতীয় চা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।
তিনি বলেন, উত্তরাঞ্চলে চা শিল্পখ্যাত পঞ্চগড়ের অর্থনীতি ও আর্থসামাজি অবস্থা চা বদলে দিয়েছে। গত দুই দশকে চা শিল্পের অর্থনীতিতে নিরব বিপ্লব ঘটেছে দেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে। দ্বার উন্মোচন করেছে নতুন এক সম্ভাবনার। এটা সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুর্দশিতায় দেশের কৃষি খাতের উন্নয়নের কারণে। সুফল মিলেছে চাঙ্গা অর্থনীতির। এর ব্যাপকতা পেয়েছে উত্তরাঞ্চলের সীমান্তবর্তী বেশ কয়েকটি জেলার জনজীবনে।
১৯৯৬ সালে পঞ্চগড়ে সমস্যা ও সম্ভাবনা সরেজমিনে দেখতে রাষ্ট্রীয় এক সফরে আসেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তখন তার নির্দেশে চা বোর্ডের একটি টিম পঞ্চগড় পরির্দশন করে রিপোর্ট দেয়। তৎকালীন জেলা প্রশাসক সিলেট থেকে চায়ের চারা সংগ্রহ করে সার্কিট হাউজে লাগিয়ে দেখলেন চা চাষের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। সরকারের স্থানীয় কৃষকদের উদ্বুদ্ধকরণের মধ্য দিয়ে শুরু হয় সমতল ভূমিতে ক্ষ্রদ্র চা চাষ ।
ড. আল মামুন বলেন, ২০০০ সালে এ অঞ্চলে বানিজ্যিকভাবে শুরু হয় ক্ষুদ্র আকারে চা চাষ । এক সময়ের পতিত গো-চারণ ভূমি এখন ভরে গেছে চায়ের সবুজ পাতায়। বাড়ির আঙিনা হয়ে উঠেছে চা আবাদ। গ্রামীণ অর্থনীতিতে যুক্ত হয়েছে স্বস্থির নিশ্বাস। ক্ষুধা-দারিদ্রতা কাটিয়ে বদলে গেছে জীবন। গ্রাম হয়ে উঠছে শহরের আদলে। খড়ের ঘরের পরিবর্তন এখন গ্রামে গ্রামে। সেখানে গড়ে উঠেছে আধুনিকতার শোভায় সুসজ্জিত বাড়ি। উচ্চ শিক্ষিত হয়ে উঠছে ছেলেমেয়েরা। নতুন নতুন স্বপ্নে বিভোর এখানকার চা চাষীরা। বাড়ছে নতুন নতুন চাষী।
তেঁতুলিয়া উপজেলার ‘পেদিয়াগছ’ গ্রামের চা চাষি অ্যাড. রফিকুল ইসলাম বলেন, আমার বাবা ইশাহাক মন্ডলসহ স্থানীয় আরও কয়েকজন প্রথম পেদিয়াগছ গ্রামেই ক্ষুদ্র চা চাষ শুরু করেন। চা চাষের কারণে আর্থÑসামাজিক পরিবর্তনের সাথে সাথে জীবন-মানের অনেক উন্নতি হয়েছে। চা বাগানের মাঝখানে দেখা মিলছে বাড়িঘর। এতে করে সৃষ্টি হয়েছে মুগ্ধকর সৌন্দর্য। চা বাগানকে ঘিরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রচুর পর্যটকের সমাগম ঘটছে চায়ের গ্রাম দেখতে। এতে করে টি ট্যুরিজমের ব্যাপক সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
তিনি বলেন, স্থানীয়ভাবে চা কারখানা প্রতিষ্ঠার কারণে স্থানীয় বেকারদের ব্যাপক কর্মসংস্থানের সূযোগ হয়েছে।