গার্মেন্টসে নারীর যৌনহয়রানি বন্ধে দরকার ব্যবস্থাপনায় নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি ও সচেতনতা

2647

ঢাকা, ১ জুন, ২০২১(বাসস): তেইশ বছর বয়সী জোবেদা আক্তার (ছদ্মনাম) সবে নতুন একটি গার্মেন্ট ফ্যাক্টরীতে যোগ দিয়েছে। আগের কারখানায় বেতন অনিয়মিত ছিল। তাই নতুন কারখানায় কাজ নেওয়া। বেতনও একটু বেশী। প্রথম কয়েকদিন ভালোই চলছিল। কিন্তু কিছুদিন পর থেকে ফ্লোর সুপারভাইজার বিরক্ত করা শুরু করে। কাজে-অকাজে প্রায় সময়ই ডাক দেয়। আবার কোন ছুঁতোয় হাত ধরে ফেলে। শুরুতে বিষয়টি না ভাবালেও পরে কেমন জানি অস্বস্তি লাগে। বিষয়টি নিয়ে একই ফ্লোরের কয়েকজন সহকর্মীর সাথে আলোচনাও করে জোবেদা। তারাও বিষয়টি দেখেছেন। কিন্তু ফ্লোর সুপারভাইজার বলে তেমন প্রতিবাদ করতে পারছেনা। কেনননা ফ্লোর সুপারভাইজার অনেক বড় ক্ষমতাবান। তার কথায় চাকরি চলে যেতে পারে । তবে কারখানার ম্যানেজমেন্ট ভাল হলে আবার উল্টো ফলও হতে পারে।
বেশ কিছ দিন এভাবে চলার পর বিরক্ত হয়ে একদিন জোবেদা সরাসরি চলে যান কারখানার ম্যানেজারের কাছে। ম্যানেজারকে অভিযোগ দিলে তিনি বিষয়টি দেখবেন বলে আশ্বাষ দেন। ঠিক কয়েকদিন পরেই চাকরি হারায় ওই ফ্লোর সুপারভাহজার।
এক গবেষণার প্রতিবেদন মতে তৈরি পোশাক কারখানায় কমর্রত নারী শ্রমিকদের প্রতি চার জনের একজন যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এছাড়াও শতকরা ৩৫ দশমিক ৩ ভাগ নারী কর্মী কর্মক্ষেত্রে নারী শ্রমিকদের প্রতি যৌন হয়রানির ঘটনা শুনেছেন বা দেখেছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) এর ওই প্রতিবেদনে।
ঢাকার মিরপুর এবং চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ ও বায়েজিদ বোস্তামি এলাকায় অবস্থিত ২২টি পোশাক কারখানায় গবেষণাটি পরিচালিত হয়। এতে বলা হয়, পোশাক কারখানাগুলোতে শতকরা ২২ দশমিক ৪ ভাগ নারী শ্রমিক যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
কর্মক্ষেত্রে নারী শ্রমিকদের যে ধরনের যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়, এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে কামনার দৃষ্টিতে তাকানো, যার হার ৪২ দশমিক ৩৩ ভাগ। এরপর সংবেদনশীল অঙ্গে কোনো কিছু নিক্ষেপ করা, যার হার ৩৪ দশমিক ৯২ ভাগ। তারপর সংবেদনশীল অঙ্গের প্রতি লোলুপ দৃষ্টিতে তাকানো, যার পরিমাণ শতকরা ৩৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ। কাজ বোঝানো বা কথা বলার সময় হাত বা শরীরের কোনো অংশে স্পর্শ করার হার শতকরা ২৮ দশমিক ৫৭ ভাগ। এছাড়াও আছে বাজে গালি দেওয়া, চাকরিচ্যুতির হুমকি, অশোভন অঙ্গভঙ্গি, পদন্নোতির কথা বলে যৌন সম্পর্কের প্রস্তাব ইত্যাদি।
নারীদের যৌন হয়রানির প্রতি সমাজের উদাসীনতা রয়েছে উল্লেখ করে গণস্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সদস্য শিরিন আক্তার বলেন, ‘বৈদেশিক মুদ্রার ৮০ শতাংশ আসে পোশাক শিল্প থেকে এবং এখানে কমর্রতদের মধ্যে শতকরা ৭০ ভাগ নারী। কর্মজীবী এসব নারীদের কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির শিকার হওয়া একটি স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হচ্ছে।’
সমাজের উদাসীন আচরণ ও পুরুষ শাসিত সমাজ ব্যবস্থায় নারীরা তাদের প্রতি হওয়া যৌন হয়রানির ঘটনা প্রকাশের ভয় মুলত যৌন হয়রানির অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন এই সংসদ সদস্য। তিনি বলেন, ‘এসব (যৌন হয়রানি) ক্ষেত্রে নারীর পোশাক ও আচরণ নিয়েই উল্টো অপমানজনক কথা বলা হয়। তাছাড়া যৌন হয়রানির সমাধান সময়সাপেক্ষ। নারীদের সংসারের ও কাজের চাপের পর হয়রানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়াটা অনেকক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না।’
এছাড়াও যৌন হয়রানির বিষয়ে শ্রমিকদের পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাব রয়েছে উল্লেখ করে শিরিন আক্তার আরও বলেন, ‘যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে হাইকোর্টের যে নির্দেশনা রয়েছে সে সম্পর্কে শ্রমিকদের পর্যাপ্ত জ্ঞান নেই। আর যারা জানেন, তাদের ধারণাও খুব একটা স্পষ্ট নয়। গবেষণায় দেখা গেছে, শতকরা ৭৯ দশমিক ৯ শতাংশ নারী ও শতকরা ৭৯ শতাংশ পুরুষ এ সম্পর্কে জানেই না।’
কর্মজীবি নারী সংগঠনের সভাপতি ডা. প্রতীমা পাল মজুমদার যৌন হয়রানির কারণ ও এর প্রতিকার বিষয়ে বলেন, ‘যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষের কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করা, অপরাধীদের কোনো ধরনের শাস্তি না হওয়া, কারখানার পক্ষ থেকে যৌন হয়রানিকে অপরাধ মনে না করা, মধ্যরাত পর্যন্ত ওভারটাইম করানো- এগুলো যৌন হয়রানির অন্যতম কারণ।’
তিনি আরও বলেন, ‘কঠোর আইন প্রণয়ন, নারী শ্রমিকদের সচেতনতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণ, কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির ওপর সরকার ও ক্রেতাদের নজরদারি বাড়ানো, বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ’র মনিটরিং সেল বসানো, ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে নারীর সংখ্যা বাড়ানো এসব পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে কর্মক্ষেত্রে নারীদের প্রতি যৌন হয়রানি কমানো সম্ভব।’