তারকার মতই দ্যুতি ছড়াচ্ছেন নাটোরের সোহানী হোসেন

1905

নাটোর, ১ জুন, ২০২১ (বাসস) : সোহানী হোসেন, একাধারে দেশের খ্যাতনামা শিল্প প্রতিষ্ঠান ইউনিভার্সাল ফুডের কর্ণধার, উত্তর বঙ্গের ফাইভ স্টার রিসোর্ট ব্যবসায়ের পথিকৃৎ, অন্যদিকে লেখক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, সমাজসেবক এবং একজন আদর্শ মা।
নব্বইয়ের দশকে স্বামী মোবারক হোসেন রতœ’র হাতে গোড়াপত্তন হয়েছিল ইউনিভার্সাল ফুডের। শুরুতেই তাদের উদ্ভাবিত দেশের প্রথম টেস্টি স্যালাইন দেশজুড়ে জনপ্রিয় হয়েছিল। ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করে এই গুণী উদ্যোক্তা হার মানলে ২০০৭ সালে ইউনিভার্সাল ফুডের হাল ধরেন তার সহধর্মিনী সোহানী হোসেন। নতুন উদ্যমে আর নতুন নতুন উদ্ভাবনে অনন্য হয়ে ওঠে এই শিল্প প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে দেশের একমাত্র রেডি লাচ্চা সেমাইসহ ইউনিভার্সাল ফুডের পণ্য ৪০টি। বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মসংস্থান হয়েছে ২ হাজারের বেশি মানুষের। করোনাকালে ব্যবসায়ের সংকটে এই শিল্পের কোন কর্মীকে কর্ম হারাতে হয়নি, হারাতে হয়নি কোন আর্থিক সুবিধা।
ইউনিভার্সাল ফুড ইন্ডাস্ট্রিকে সবসময় সচল রাখতে এই কারখানার সাথেই চলছে একটি ওয়ার্কশপ। আর উৎপাদিত পণ্যের মোড়ক সরবরাহের জন্যে গড়ে তোলা হয়েছে তরঙ্গ প্যাকেজিং-যেখানে কাজ করেন অবহেলিত হিজড়া সম্প্রদায়ের লোকজন। স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার প্রত্যয়ে এই পথচলা।
উদ্ভাবনে অনন্য সোহানী হোসেন ২০১৬ সালে পাবনার জালালাবাদে উত্তরবঙ্গের প্রথম তিন তারকা রিসোর্ট ‘রতœদ্বীপ’ প্রতিষ্ঠা করেন-যার মান পাঁচ তারকার। আট একর জমির উপরে প্রায় ৫০টি কক্ষে সজ্জিত এই রিসোর্ট হয়ে উঠেছে পর্যটকদের প্রিয় আঙিনা। কাজ চলছে আরো ৭২টি কক্ষের। সফলতার পথ পরিক্রমায় ২০১৮ সালে পাবনার বাংলাবাজারে তৈরী করেন ‘রুপকথা ইকো রিসোর্ট’। দু’টি সম্মেলন কেন্দ্র, সাতটি কটেজ আর অসংখ্য কক্ষে সুসজ্জিত এই রিসোর্টটি পাঁচ তারকা মানের। পাবনা শহরে চলছে ‘রূপকথার কাব্য’ নামে একটি কফিশপ-যেখানে রয়েছে দেশী-বিদেশী বইয়ে সমৃদ্ধ লাইব্রেরি। এখানে বই পড়তে পড়তে চলে কফি আড্ডা। শপটির ব্যস্থপনার দায়িত্ব দেয়া আছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির কন্যাদের উপরে। বর্তমানে নাটোরে উত্তরা গণভবনের কাছাকাছি একটি গেস্ট হাউজ তৈরীর কাজ এগিয়ে চলেছে। সোহানী হোসেনের পরিকল্পনায় তার প্রিয় নাটোরে একটি আন্তর্জাতিক মানের ফাস্ট ফুড শপ গড়ে তোলার কথাও জানা গেল।
সফল ব্যবসায়ী কিংবা শিল্পপতি পরিচয়ের বাইরেও সোহানী হোসেনের সিনেমা ও সংস্কৃতি জগতে রয়েছে তারকা খ্যাতি। আশির দশকে জন্মভূমি নাটোরে স্কুল-কলেজ জীবনে তিনি ছিলেন সকলের প্রিয় মুখ। পড়াশুনার পাশাপাশি লিখতেন কবিতা, গাইতেন গান, আঁকতেন ছবি, আবৃত্তি করতেন আর ছিলেন তার্কিক। এখন শখের বশে মাঝে মাঝে গান করলেও কবিতা লেখার নেশা ছাড়তে পারেননি। এ পর্যন্ত তার বেরিয়েছে ১৫টি কবিতার বই আর ‘মা’ নামে একটি উপন্যাস। কবিতা লিখতে লিখতে ঝুঁকে পড়েন চলচ্চিত্রে। নিজের লেখা ‘মা’ উপন্যাস অবলম্বনে তৈরী করেছেন পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘সত্তা’। ঢাকার শাকিব খান ও কলকাতার পাওলী দাম অভিনীত তার প্রযোজিত এই চলচ্চিত্রটি অর্জন করেছে অসংখ্য দেশী-বিদেশী পুরষ্কার। আগামী ঈদে মুক্তির প্রত্যাশায় বর্তমানে নাটোর ও পাবনাতে শ্যুটিং চলছে ঢাকার শাকিব খান আর কলকাতার দর্শনা বনিক অভিনীত সোহানী হোসেনের পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘অন্তরাতœা’র। নিরন্তর বৈচিত্রময় পথচলায় সফলতার স্বীকৃতিও তিনি পেয়েছেন একাধিক। পেয়েছেন মুম্বাই থেকে দাদা সাহেব ফালকে ফাউন্ডেশন পুরষ্কার, কলকাতা থেকে মাদার তেরেসা আন্তর্জাতিক পুরষ্কার, দুবাই থেকে পারসন অব দ্যা ইয়ার এওয়ার্ড এবং গ্লোবাল মিউজিক এওয়ার্ড, দিল্লী থেকে উইমেন এচিভার এওয়ার্ড, ঢাকা থেকে বাচসাস পুরষ্কারসহ মোট ২০টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। দক্ষিণ ভারতের গ্লোবাল হিউম্যান পিস ইউনিভার্সিটি থেকে অর্জন করেছেন ডক্টর অব সোসাল ওয়ার্কস।
মানবতার কল্যাণে নিবেদিত সোহানী হোসেন ‘রোটারী ক্লাব অব রূপকথা’র চার্টার প্রেসিডেন্ট।
মেধা, সততা আর অদম্য সাহস সোহানীর সাফল্যের সোপন হলেও অতীতে এর নেপথ্যে ছিল তার মা লুৎফুন নাহার কল্পনার অনুপ্রেরণা। এই রতœগর্ভা মা তার ছেলে-মেয়েদের আলোকিত মানুষ করে গড়ে তুলতে নাটোর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকুরিটাও ছেড়ে দেন।
সোহানীর নতুন নতুন উদ্যোগে সমৃদ্ধ হচ্ছে জনপদ, উপকৃত হচ্ছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি, হিজড়া, দলিত শ্রেণীসহ সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষ।
স্বামীর মত তার শরীরে ক্যান্সার বাসা বাধলেও তাকে হার মানাতে পারেনি। যদিও চিকিৎসার জন্যে তাকে প্রায়শই ছুটে যেতে হয় আমেরিকায়।
হাজারো মানুষের ভালবাসা আর পাঁচ কন্যার আকুতি সোহানী হোসেনকে বাঁচিয়ে রাখে। তিনি হয়ে ওঠেন জীবনী শক্তিতে ভরপুর আর একজন আদর্শ মা। কন্যাদের মধ্যে বড় মেয়ে সেমন্তী নেদারল্যান্ডে এমফিল শেষ করে বর্তমানে ক্যান্সার বিষয়ে পিএইচডি করছেন, মেজো মেয়ে রুপন্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্থাপত্যে এমফিল করছেন, সেজো মেয়ে অন্বেষা আইনে উচ্চ শিক্ষা শেষ করেছেন, চতুর্থ মেয়ে অরলা বার-এট-ল পড়তে এখন লন্ডনে আর সবার ছোট আনহা মায়ের কাছে পাবনাতে থেকে মাধ্যমিক শ্রেণীতে পড়ছে।
সত্য ও সুন্দরকে সাথে নিয়ে মানুষের কল্যাণে কাজ করে যেতে আমি কখনো ক্লান্ত হব না বলে জানালেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ সোহানী হোসেন।
সোহানী হোসেন সম্পর্কে নাটোর দিঘাপতিয়া অনার্স কলেজের অধ্যক্ষ ও দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি নাটোর জেলা শাখার সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আমি ইতিহাস খ্যাত নাটোরের রাণী ভবানীকে দেখিনি, তবে, মানবদরদী সোহানী হোসেনকে দেখেছি। মানুষের কল্যাণে নিরন্তরভাবে পথ চলাতেই নাটোরের সোহানী হোসেন সফলতা পেয়েছেন। তার এই সফলতা আকাশ ছোঁয়া।