বাসস দেশ-৪৭ : ‘তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ গড়তে সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগের ওপর গুরুত্বারোপ বিশেষজ্ঞদের

378

বাসস দেশ-৪৭
তামাক-আইন-জনসচেতনতা
‘তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ গড়তে সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগের ওপর গুরুত্বারোপ বিশেষজ্ঞদের
॥ সেলিনা শিউলি ॥
ঢাকা, ৩০ মে, ২০২১ (বাসস): ‘তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ গড়তে সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের প্রতিবন্ধক তামাক নামের এই বিষ নির্মূল করতে আইনের সংশোধন, বাস্তবায়ন, তামাক কর বৃদ্ধি এবং জনসতেনতার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে তারা বলেন, প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে তামাক গ্রহণ একটি পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের কাঠামো ব্যবস্থাকে দুর্বল করে দেয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, তামাকমুক্ত দেশ গড়তে বাজেটে তামাক কর বৃদ্ধি, তামাক কোম্পানীগুলোকে নিরুৎসাহিত করা এবং আইনের ব্যাপক চর্চার পাশাপাশি মানুষের মাঝে এর কুফল সম্পর্কে অধিক সচেতনতার প্রয়োজন। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন করা হলে দেশের রাজস্ব আয় যেমন বাড়বে, জনস্বাস্থ্য সুরক্ষাও নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। অন্যদিকে, তামাকজাত পণ্যের প্যাকেটে যে সচিত্র সতর্কবাণী বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, সেখানে তার আকার নিয়ে নির্দেশনা না থাকায় এ ধরনের সতর্কবার্তা ভোক্তার নজরে পরছে না। ফলে, সচেতনতার ক্ষেত্রে এটিও একটি প্রতিবন্ধকতা বলে মনে করছেন তারা।
গবেষণায় দেখা গেছে, পৃৃথিবীর সবচেয়ে বেশি তামাক ব্যবহারকারী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। এখানে সিগারেটের মূল্য তুলনামূলক কম এবং বিড়ি আরো সস্তা। একজন শিশু যদি তামাক গ্রহণের অভ্যাস তৈরি করে, তাহলে প্রায় পঞ্চাশ বছরের জন্য তার তামাক গ্রহণ মোটামুটি নিশ্চিত বলে ধরে নেয় তামাক কোম্পানীগুলো। আইনের কিছু ফাঁকফোকড় থাকায় বিক্রেতারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছাকাছি কোন দোকানে বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীর পাশে সিগারেট রেখে শিশু বা অপ্রাপ্তবয়স্কদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে থাকেন। কৌতুহলবশত তারা তামাকের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ধোঁয়াযুক্ত এবং ধোঁয়াবিহীন তামাকের সহজপ্রাপ্যতার কারণেও নানা বয়সী মানুষ তামাকের প্রতি দ্রুত আকৃষ্ট হচ্ছে।
জানা যায়, বিশ্বজুড়ে প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুর প্রধান আটটি কারণের মধ্যে ৬টি মৃত্যুর সাথে তামাক জড়িত। টোব্যাকো এটলাস-২০২০-এর তথ্যমতে, প্রতিবছর প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজারের বেশি মানুষ তামাক ব্যবহারের কারণে মৃত্যুবরণ করেন। গ্লোবাল এডাল্ট টোব্যাকো সার্ভের (গ্যাটস) প্রতিবেদনে জানা যায়, তামাক ব্যবহারকারীর প্রায় অর্ধেক মারা যান এর কারণে। তামাকজনিত অন্যান্য ক্যান্সার হবার ঝুঁকি ১০৯ শতাংশ বেশি। হৃদরোগ, স্ট্রোক, সিওপিডি বা ফুসফুসের ক্যান্সার হবার ঝুঁকি ৫৭ শতাংশ বেশি। দেশে প্রতিবছর ১ লাখ ৬১ হাজারেরও বেশি মানুষ তামাকজাত দ্রব্য ব্যাবহারের কারণে মৃত্যুবরণ করছে। প্রাপ্তবয়স্কদের প্রায় ৩৫ শতাংশ তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার করে থাকেন। যা প্রায় সাড়ে তিন কোটিরও বেশি। এদিকে, ১৩ থেকে ১৫ বছরের প্রায় ৬.৯ শতাংশ অপ্রাপ্ত বয়স্কও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার করছে।
তামাকের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে ২০০৩ সালে জাতিসংঘের অর্ন্তভূক্ত সব রাষ্ট্রের স্বাস্থ্যমন্ত্রীদের সমন্বয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)-র উদ্যোগে ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (এফসিটিসি) স্বাক্ষরিত হয়। একই বছর বাংলাদেশ এফসিটিসিতে স্বাক্ষর করে। প্রথম স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ২০০৫ সালে জাতীয় সংসদে ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০০৫’ পাশ করে। ২০১৩ সালের ২৯ এপ্রিল এই আইনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংশোধন আনা হয়। অন্যদিকে, এফসিটিসির শর্ত অনুসারে সিগারেটের প্যাকেটে তামাক গ্রহণের ভয়াবহতা সম্পর্কে এবং জনসচেতনতা সৃষ্টিতে ২০১৬ সালে ধূমপানের ফলে সৃষ্ট ক্যান্সার আক্রান্ত মুখগহ্বরের ছবি, গলার কাছে ক্ষত’র ছবি, গর্ভবতী নারীর পেটে মৃত বা অসুস্থ শিশুর ছবি, হৃদরোগের ছবি, ব্রেন স্ট্রোকের ছবি সিগারেটের প্যাকেটে সংযুক্ত করাসহ সতর্কবাণী বাস্তবায়ন করে। ধূমপানে নিরুৎসাহিত করতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও এই পদ্ধতি চালু রয়েছে। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনটি এফসিটিসির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হলেও কিছু কিছু জায়গায় ফাঁক রয়েছে। ই-সিগারেট এর মতো ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্ট নিষিদ্ধ করার বিষয়ে কোন উল্লেখ নেই এই আইনে।
ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ফলে তামাক নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশে অগ্রগতি হয়েছে। ২০০৯ ও ২০১৭ সালে পরিচালিত গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস) সূত্রমতে, ২০০৯ সালের তুলনায় তামাকের ব্যবহার বর্তমানে তুলনামূলকভাবে কমেছে (রিলেটিভ রিডাকশন), ধূমপানের ক্ষেত্রে শতকরা ২২ শতাংশ তুলনামূলক হ্রাস এবং ধোঁয়াবিহীন তামাকের ব্যবহার ২৪ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে, পাবলিক প্লেসে পরোক্ষ ধূমপানের হার, রেস্তোঁরায় ৩০ শতাংশ, কর্মক্ষেত্রে ১৯ শতাংশ, হাসপাতালে ১১ শতাংশ এবং গণপরিবহনে প্রায় ১০ শতাংশ কমেছে ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)এর উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ে ও বিপনণের জন্য বাংলাদেশে কোন সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। এমনকি তামাকজাত দ্রব্য বিক্রয়ের সাথে সম্পৃক্তদের নির্ধারিত কোন ট্রেড লাইসেন্স গ্রহনের ব্যবস্থা নাই। যে কারণে শিল্প প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন বিনোদন কেন্দ্রের আশেপাশের এলাকা, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, খাবারের দোকান, রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্নস্থানে অনিয়ন্ত্রিতভাবে তামাকজাত পণ্য বিক্রয় করা হচ্ছে। সহজলভ্যতা ও সহজপ্রাপ্যতার কারণে যত্রতত্র তামাকজাত পণ্যের বিপণন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। উৎকন্ঠার বিষয় এসব দোকানের সংখ্যা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে এর বিক্রয়ে লাইসেন্সিং ব্যবস্থা প্রনয়ণ করে এটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।’
ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস, বাংলাদেশের গ্রান্টস ম্যানেজার আবদুস সালাম মিয়া বাসসকে জানান, তামাক পণ্যের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে কাউকে মুক্তি দিচ্ছে না। অধূমপায়ীরাও সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে আইনের সংশোধন অনেক জরুরী।
তিনি বলেন, তামাক মুক্ত বাংলাদেশ গড়তে আইনের সংশোধন জরুরী। আইনের ফাঁকফোকর দিয়েই তামাক কোম্পানীগুলো বিভিন্নভাবে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনকে বা তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে ব্যাহত করছে। আগে তামাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বিজ্ঞাপন প্রচার করতো নাটকে, বিজ্ঞাপনে কিংবা প্রেক্ষাগৃহে-এখন তা হচ্ছে না । আবার, ব্যবসায়িক স্বার্থে তারা কৌশলে পণ্য প্রচারের আড়ালে বৃক্ষরোপণসহ সমাজ সচেতনতামূলক বিভিন্ন কাজে অংশগ্রহণ করছে। দেশের নীতি-নির্ধারকদের কাছে তাদের নানা কার্যক্রমকে ইতিবাচকভাবে তুলে ধরছে। এরকম কিছু জটিলতাও তামাক নিয়ন্ত্রণের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে। আইনের ফাঁকফোকর দিয়েই তামাক কোম্পানীগুলো বিভিন্নভাবে তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমকে ব্যাহত করছে।
মানস (মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা)-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ উপদেষ্টা কমিটি এবং জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ টাস্কফোর্সের অনারারি সিনিয়র কনসালটেন্ট অধ্যাপক ডা. অরূপ রতন চৌধুরী বাসসকে জানান, তামাক নির্মূলে জাতীয় সংসদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। জনপ্রতিনিধিরা এখানে শপথ পাঠের মাধ্যমে তাদের নিজ এলাকায় তামাক বিরোধী নানা কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে পারে। তামাক নির্মূলে নানামুখী জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে, সচেতনভাবে অনেকেই তামাকমুক্ত সমাজ গঠনে এগিয়ে আসছে। সম্প্রতি জনস্বাস্থ্য রক্ষায় তামাক কর বাড়ানোর জন্য মোট ১২১ জন চিকিৎসক বিবৃতি দিয়েছে। এখনই যদি সচেতনতা না বাড়ে তাহলে তামাক মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার যে প্রত্যয় প্রধানমন্ত্রী ব্যক্ত করেছেন সেই লক্ষ্যে পৌঁছানো দুস্কর হয়ে পড়বে। সুতরাং জনস্বাস্থ্য রক্ষায় আর ছাড় নয়, সবাইকে স্ব স্ব ক্ষেত্র থেকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সাবেক পরিচালক ও অপারেশন (গোয়েন্দা) এবং বর্তমান ঢাকা মেট্রোপলিটন (ডিএমপি)-র কমিশনার ড. এ এফ এম মাসুম রাব্বানী বলেন, তামাকের কুফল এবং এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে মানুষকে বিশেষ করে নতুন প্রজন্মকে পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সচেতন করতে হবে। তামাক ও মাদক যে ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ সে সম্পর্কে প্রচার-প্রচারণা বাড়াতে হবে।
বাসস/এসপিএল/এসএস/২১০৮/আরজি