বরগুনায় বসবাসরত রাখাইনদের রয়েছে নিজস্ব ধর্ম, সংস্কৃতি, কৃষ্টি

2592

বরগুনা, ২০ মে, ২০২১ (বাসস) : উপকূলীয় জেলা বরগুনায় বসবাস করেছে রাখাইন জনগোষ্ঠীর একটি অংশ। নিজস্ব ঐতিহ্য, ধর্ম, শিল্প, সংস্কৃতি নিয়ে বসবাসরত সকল রাখাইনই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। চেহারা ও জাতিতে মঙ্গোলিয়ন গোত্রের।
১৭৮৪ খৃষ্টাব্দ, বাংলা ১১৯১ সালে আরকানের মেঘাবতী এলাকা থেকে ৫০টি নৌকা নিয়ে বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে দেড় শ’ রাখাইন উদ্বাস্তু পরিবার বাংলাদেশে আসে। বিক্ষুব্ধ সাগর পাড়ি দিয়ে প্রথমে রামু ও কক্সবাজার ও পরে একটা অংশ পটুয়াখালী জেলার উপকূলীয় রাঙ্গাবালী দ্বীপে আশ্রয় নেয় তারা। আরাকানের ম্রাউ রাজবংশের শেষ সম্রাট থামাদা’র শাসনামলে (১৭৮২-১৭৮৪) বর্মী শাসক বোধপায়া (শাসনামল ১৭৮২-১৮১৯) এ ক্ষুদ্র রাজ্যটিকে প্রায় ৩০ হাজার সৈন্য নিয়ে আক্রমণ করে। সম্রাট থামাদা বর্মীদের হাতে বন্দী হয়ে ১৭৮৫ প্রাণ হারান। বর্মী সেনাবাহিনীর নৃশংস অত্যাচার ও দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে বাঁচার জন্য ১৮১৬ সালের দিকে ১শ ৫০টি পরিবার বাংলাদেশের উপকূলের দ্বীপে আশ্রয় নেয়। তখনকার দিনে ওই সকল দ্বীপ ছিল বন জঙ্গলে ঘেরা জন মানবহীন বনভূমি। বন্য মহিষ, বন্য গরু, হিংস্র বাঘ অর্থাৎ পশুরাই ছিল সেখানকার বাসী। নদী খালে ছিল অসংখ্য কুমীর। রাখাইনরা সঙ্গে আনা ধারালো অস্ত্র যেমন দা, ছেনা, বল্লম, লেজা ইত্যাদি দিয়ে বনজঙ্গল পরিস্কার করে এদেশে স্বপরিবারে থাকার টং ঘর তৈরি করে বসতি, ও কৃষি ভূমি তৈরি করে। দেশ থেকে সাথে নিয়ে আসা ধান ও অন্যান্য ফলমূলের বীজ বপণ শুরু করে। তৈরি করা আবাদি জমি তৎকালীন সরকারের কাছ থেকে পত্তন নিয়েছিল তারা। রাখাইনদের ইতিহাস থেকে জানা গেছে, সেসময়ে রাখাইনদের জন্য সুপেয় পানীয় জলের বড় সমস্যা ছিল। সাগরের লবনাক্ত পানি খেয়ে তাদের পেটের পীড়া দেখা দিতে থাকে। এ পরিস্থিতিতে একজন ইউরোপিয়ান নেভাল অফিসার ভাগ্যক্রমে রাখাইনদের অবস্থান খুঁজে পান। রাখাইনদের সমস্যার কথা শুনে ওই অফিসার প্রথমে তাদের জরুরী ওষুধপত্র, অস্ত্র, প্রয়োজনীয় কাপড় চোপড়, পানীয় জলের ব্যবস্থা করেন। রাখাইনরা রামু কক্সবাজার রাঙ্গাবালির ওই দ্বীপগুলো ছেড়ে একটু পশ্চিমে পটুয়াখালী জেলার বড়বাইজদিয়া নামক এলাকায় এসে পুনরায় বসতি স্থাপন করে। বাংলাদেশে যে রাখাইনরা এসেছিল সবাই ছিল কৃষিজীবী। জঙ্গল আবাদ করা, জঙ্গলের জন্তু জানোয়ারের সঙ্গে লড়াই করা, মাছ ধরার নিয়ম-পদ্ধতি এ সবই তাদের আয়ত্বে ছিল। এ রাখাইন জনগোষ্ঠী পটুয়াখালী এলাকায় আসার প্রায় ৫০ বছর যেতে না যেতেই ১৮৩৪-১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দেরদের পর থেকে পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা ও কলাপাড়া উপজেলার কালাচানপাড়া, গোড়াআমখোলাপাড়া, দিয়ারআমখোলাপাড়া, নয়াপাড়া, নাইউরী পাড়া, মংথয়পাড়া, থঞ্জুপাড়া, মিশ্রিপাড়া, লক্ষ্মীপাড়া, বৌলতলীপাড়া, পক্ষীয়াপাড়া, কেরানীপাড়া এবং বরগুনা জেলার তালতলী উপজেলার তালতলীপাড়া, ছাতনপাড়া, গোড়াঠাকুরপাড়া, আগাঠাকুরপাড়া, মনুসেপাড়া, অংকোজানপাড়া, তাতেপাড়া, লাউপাড়া, নামেসেপাড়া, কবিরাজপাড়া, সওদাগাড়পাড়া ও তালুকদারপাড়ায় বসতি বাড়িয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরু করে।
জায়গা-জমি, ধনদৌলতে খুবই স্বনির্ভর ও সমৃদ্ধ ছিল রাখাইনরা। তারা গড়ে তুলেছিলেন বড় বড় বৌদ্ধ বিহার (প্যাগোডা), শ্মশান (চে-শেই) ও শান বাঁধানো পুকুর। পালিত হতো ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানসহ বৈশাখী পূর্ণিমা, চৈত্র সংক্রান্তি বা সাংগ্রান, নববর্ষ উৎযাপনে জলকেলী উৎসবসহ নানা অনুষ্ঠান। নিজস্ব রীতিতে শ্রমণ, বিয়ে অনুষ্ঠান, শ্রাদ্ধ্য, বৌদ্ধ বিহারাধ্যক্ষের মৃত্যু পরবর্তী শ্রাদ্ধ্য আড়ম্বর পরিবেশে উদযাপিত হতো।
স্থানীয় মং এ্যা খ্যাং মং মং জানান, বরগুনার তালতলীর রাখাইন মন্দিরে ধর্মীয় ঔতিহ্য ও সৌন্দর্য্যরে প্রতিক বুদ্ধ মূর্তিগুলো রয়েছে।তালতলী উপজেলার ৫৬ টি রাখাইন পাড়াতে প্রতিটি মন্দিরে পিতলসহ বিভিন্ন ধাতু, কষ্টি পাথর, শ্বেত পাথরের একাধিক প্রাচীন মূর্তি ছিল। কালের আবর্তে রাখাইন মন্দিরে প্রচীন ঐতিহ্যের চিহ্নবাহী মূর্তির আধিক্য কমে গেছে। এখন ঠাকুরপাড়ায় সাধারন পাথর ও শ্বেত পাথরের প্রচীন মূর্তি সমগ্র রাখাইনদের মূল আরাধ্যো। জানা গেছে, ১৭ শ সালের শেষের দিকে মায়ানমার থেকে আসা রাখাইনরা তাদের ধর্মীয় উপাসনার জন্য আরাকানের মেঘাবতীর সান্ধ্যে জিলার ছেং ডোয়ে, রেমেত্রে, মেং অং অঞ্চলসমূহ হতে নিয়ে আসেন বিভিন্ন পাথরের একাধিক মুল্যবান মূর্তি। স্থানীয় রাখাইনরা জানিয়েছেন, সব কটি রাখাইন প্যাগোডায় ঐতিহ্যর ধারক হিসেবে শ্বেত, কষ্টি পাথরসহ ধাতুর তৈরী মূল্যবান প্রাচীন মূর্তি ছিল। চুরি ও পাচারের কারণে প্রাচীন মূর্তির সংখ্যা কমে গেছে।
রাখাইনদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা ও বর্ণমালা। তালতলীর রাখাইন কমিউনিটি লীডার মং তেন জানান, তালতলী শহরে রাখাইন ডেভেলপমেন্ট সেন্টারে ভাষা শেখার বিদ্যালয় চালু আছে। এখানে প্রতিদিন দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি শিখছে।
তাঁতে কাপড় বোনা রাখাইন নারীদের পারিবারিক ঐতিহ্য। রাখাইনদের মধ্যে এমন প্রচলন আছে, পরিবারের যে মেয়েরা হস্তচালিত তাঁত চালাতে জানেনা তাদের ভালো বিয়ে হয়না। বারো মাসেই তাঁতের খটখট শব্দে মুখরিত রাখাইন পল্লীগুলো জানান দেয় রাখাইন হস্তশিল্পের জনপ্রিয়তা ও ঐতিহ্যকে।
মায়ানমার (বার্মা) থেকে আমদানীকরা সুতা দিয়ে শীতের চাদর, শার্ট পিস, ব্যাগ, লুঙ্গী, ও গামছা বুনে রাখাইন নারী তাঁতীরা তাদের হস্তচালিত তাঁত বস্ত্রের উৎপাদন বৃদ্ধিতে নিরলস ভাবে পরিশ্রম করে। রাখাইন তাঁতীদের হস্তচালিত তাঁতে উৎপাদিত বিভিন্ন রংয়ের সুতা দিয়ে তৈরী লতা পাতা ফুল ও বিভিন্ন কারুকাজে তৈরি সকল বস্ত্রের কদর দক্ষিণাঞ্চলসহ দেশের সর্বত্রই রয়েছে। বিশেষ করে শীতকালে স্থানীয় বাজারগুলোতে চাদর, শার্ট পিস, লুঙ্গী এ কাপড় খুব বিক্রি হয় বলে ব্যবসায়ীদের সাথে আলাপকালে জানা গেছে। এ সকল কাপড় যেমন ভালো ওম দেয় তেমনি তার আকর্ষণও রয়েছে।
চল্লিশ দশকের শেষভাগে দক্ষিণাঞ্চলে সর্বমোট ২৪২টি রাখাইন পাড়া বা পল্লী ছিল। প্রবীন রাখাইনরা জানান, সে সময়ে বরগুনা ও পটুয়াখালী জেলায় ৬০ হাজারের বেশী রাখাইন বসবাস করত। বর্তমানে রাখাইন জনসংখ্যা ১০ হাজারের নিচে নেমে এসেছে। বহু রাখাইন পাড়া বিলুপ্ত হয়ে গেছে। শ্রী মঙ্গল বৌদ্ধ বিহার সভাপতি মংচুমিন তালুকদার জানান, নিজ ভাষাসহ সাধারণ শিক্ষায় রাখাইনরা অনগ্রসর ও পশ্চাপদ।
প্রবীণ রাখানইন সমাজপতি বাবু মংনান্ট তালুকদার এর লেখা থেকে জানা যায়, রাখাইন সম্প্রদায়ের অনেকেই বিশ্বাস করে তাদের বসবাসের আশেপাশের বাঁধ বা বেড়ি নির্মাণ ও নদীগুলো ভরাট হলে এবং আরাকান ভূখন্ড হতে এ অঞ্চলে আগমণের মেয়াদ দু শত বছর (১৭৮৪-১৯৮৪) অতিবাহিত হবে তখন আর এ অঞ্চলে তাদের বসবাস করা উচিত নয়। এরপরও কেউ বসবাস করলে তাদের ওপর নেমে আসবে নানা রকম দুর্যোগ ও বিপদ। এমন বিশ্বাস রাখাইনদের পূর্ব পুরুষ থেকে চলে আসছে।
রাখাইন সমাজকল্যান সমিতির সভাপতি উসুয়ে বাবু জানান, এ অঞ্চলে বসবাসরত রাখাইন সম্প্রদায়ের লোক সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে পরবর্তী প্রজন্ম শুধু কাগজপত্রেই এ অঞ্চলের রাখাইন সম্প্রদায় স¤পর্কে জানতে পারবে। তবে সরকার আমাদের প্রতি আন্তরিক হলে আমরা আমাদের ঐতিহ্য ও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারব।