সরকারি ডিজিটাল সেবার মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের কৃষি

469

॥ মনসুর আহম্মেদ ॥
রাঙ্গামাটি, ১৪ এপ্রিল, ২০২১ (বাসস) : সরকারি ডিজিটাল সেবার মাধ্যমে কৃষিবিভাগের প্রশিক্ষণ নিয়ে রাঙ্গামাটির দূর্গম পাহাড়ী এলাকায় ভার্মি কম্পোজ বা কেচো সার উৎপাদন করে তা নিজস্ব জমিতে ব্যবহারের পাশাপাশি উৎপাদিত এসব সার অনলাইনের মাধ্যমে বিক্রি করে স্বাবলম্বী হয়েছে মানিকছড়ির সাপছড়ি পাড়ার শিক্ষিত বেকার যুবক ও কৃষক। ওখানে ভার্মি কম্পোজ সারের পাশাপাশি অন্যান্য ফসল ও বিক্রি হচ্ছে অনলাইনের মাধ্যমে।
গ্রামের কৃষক ফসলী জমিতে ক্ষতিকারক রাসায়নিক সারের পরিবর্তে এখন এখানকার প্রশিক্ষিত যুবকদের উৎপাদিত এ ভার্মি কম্পোজ বা কেচো সার ব্যবহার করছে বলে জানিয়েছেন রাঙ্গামাটি উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. হারুনুর রশীদ ভুইয়া। পাহাড়ে উৎপাদিত এ ভার্মি কম্পোজ সার এখন ক্রমেই কৃষকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
রাঙ্গামাটি শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দুরে মানিকছড়ি এলাকার সাপছড়ি পাড়ায় কৃষি বিভাগের পরামর্শে ও মামার কেচো সারের প্রজেক্ট দেখে প্রথম উদ্বুদ্ধ হন শিক্ষিত বেকার যুবক টিটু চাকমা।
লেখাপড়া শেষ করে বিগত ৪ বছর আগে তিনি পাহাড়ের প্রত্যন্ত গ্রামে শুরু করেন ভার্মি কম্পোজ বা কেচো সার তৈরীর প্রজেক্ট। এই সার উৎপাদনের কয়েক বছরেই টিটু চাকমাকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। বর্তমানে তার উৎপাদিত কেচো সার গ্রামের কৃষকরা কিনে নিয়ে ব্যবহার করেন এবং তার নিজের জমিতে ও এ সার ব্যবহার করেন।
টিটু চাকমা জানান, ভার্মি কম্পোজ বা কেচো সার তৈরীর জন্য কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে রিং,টিন,পাকাকরণের জন্য আর্থিক সহযোগিতা এবং দুইবার কেচো সরবরাহ করা হয়। তিনি জানান, কোন সমস্যা হলে বা কিছু জানার থাকলে মোবাইলের মাধ্যমে আমরা এখন কৃষি কর্মকর্তাদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারি, যে সুযোগটা একসময় ছিলনা। বর্তমান সরকারের ডিজিটাল সুযোগ সুবিধার কারনে পাহাড়ের দূর্গম এলাকা হলে ও আমরা খুব দ্রুততার সঙ্গে সেবা নিয়ে কৃষি কাজসহ অন্যান্য অনলাইন ব্যবসা করার সুযোগ পাচ্ছি।
বর্তমানে টিটু চাকমা স্বাবলম্বী হয়ে ভার্মি কম্পোজ সার উৎপাদনের পাশাপাশি নিজে বিভিন্ন ফসলী জমিসহ হাস-মুরগী ও গবাদী পশুর খামার গড়ে তুলেছেন। সফল উদ্যোক্তা টিটু চাকমা বর্তমানে এলাকায় একজন সফল কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবেই পরিচিত।
অনলাইন মাধ্যম ছাড়া ও বিভিন্ন এলাকার কৃষক দামে কম হওয়ায় টিটু চাকমার সার কিনতে চলে আসেন দুর্গম পাহাড়ী এলাকা সাপছড়ি পাড়াতে। একই এলাকার আরেক কৃষক বিনয় চাকমা বলেন, আমিসহ এখানকার স্থানীয় অনেক কৃষকই টিটু চাকমার থেকে সার কিনে ফসলী জমিতে প্রয়োগ করছি এতে ফলন ও ভালো হয়েছে।
তিনি জানান ফসলী জমিতে আগে যে রাসায়নিক সার ব্যবহার করা হতো তার থেকে টিটু চাকমার উৎপাদিত ভার্মি কম্পোজ সার অনেক ভালো এবং দামে কম ও এসব সার স্থানান্তরে ও রয়েছে অনেক সুবিধা।
টিটু চাকমার সফলতা দেখে কৃষি বিভাগের পরামর্শে এলাকায় আরো অনেকেই ভার্মি কম্পোজ বা কেচো সার তৈরীর প্রজেক্ট গড়ে তুলেছে। এরকম এক সফল উদ্যোক্তা হলো সাপছড়ি পাড়ার আশীষ চাকমা। তিনি একইভাবে ভার্মি কম্পোজ সার উৎপাদন করে অনলাইনের মাধ্যমে বিক্রয় করছে।
সফল উদ্যোক্তা আশীষ চাকমা জানান, বেকারত্ব দূরীকরনে ভার্মি কম্পোজ প্রজেক্ট অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তিনি ও টিটু চাকমার মতো ভার্মি কম্পোজ সার ছাড়া বিভিন্ন ফলের বাগান করে উৎপাদিত এসব ফসল অনলাইন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বিক্রি করে এখন সফল উদ্যোক্তা হিসেবেই পরিচিত।
এলাকার আরেকজন সফল কৃষক সুনীল কুমার চাকমা জানান, আমরা ধানসহ যেসব বিভিন্ন বাগান করছি মোবাইল আসার আগে এসব ফসল উৎপাদন নিয়ে আমাদের কৃষকদের আগে কৃষি বিষয়ক সেবা পেতে অনেক কষ্ঠ পেতে হতো। ফসলের ঔষধসহ অন্যান্য ছোটখাটো প্রয়োজনে কৃষকদের শহরে কৃষি অফিসারদের কাছে যেতে হতো, এখন আর তার প্রয়োজন পড়েনা, মোবাইল নেটওয়ার্কের কারনে আমরা কৃষি বিষয়ক যে কোন সমস্যা নিয়ে তাদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করে আলাপ করতে পারি। নেটওয়ার্ক হওয়ার কারনে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান পাহাড়ের দূর্গম এলাকার এই কৃষক।
এ বিষয়ে রাঙ্গামাটি সদর উপজেলা উপ-সহকারী কৃষিকর্মকর্তা মো. হারুনুর রশীদ ভুঁইয়া বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকে (বাসস) জানান, ডিজিটাল বাংলাদেশের যেসব সুফলগুলো ভোগ করা হচ্ছে তার মধ্যে কৃষিবিভাগই বেশী সফল হচ্ছে।
তিনি জানান, বাংলাদেশ সরকার কৃষকদের সরকারি ডিজিটাল পদ্ধতির মাধ্যমে কৃষি সেবা প্রদানের জন্য দেশের প্রতিটি কৃষি বিভাগের প্রত্যেক উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের ট্যাব প্রদান করা হয়েছে। সরকার কর্তৃক বরাদ্দকৃত এই ট্যাবে কৃষি বিষয়ক প্রত্যেকটা বিষয়ের উপর অ্যাপস রয়েছে।
এর মধ্যে রয়েছে কৃষকের জানালা, কৃষি তথ্য সার্ভিস, বিণা নামের একটি গবেষণাগার প্রতিষ্ঠান আছে ওখান থেকে বিভিন্ন ফসলের প্রযুক্তির অ্যাপস, ফার্টিলাইজারের অ্যাপসসহ আরো বিভিন্ন সরকারী অ্যাপস রয়েছে যার মাধ্যমে আমরা কৃষকদের কৃষি সেবা প্রদান করে থাকি।
তিনি জানান, তার কর্মরত এলাকার আওতাধীন ১০-১২ গ্রাম রয়েছে যেখানে সব গ্রামে সবসময় যাওয়া তার পক্ষে অনেক সময় সম্ভব হয়ে উঠেনা। এই নেটওয়ার্ক ও ডিজিটাল সেবা চালু হওয়ার কারনে কোন সমস্যা হলে কৃষক এখন সরাসরি তাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারে।
তিনি জানান, মাঠ পর্যায়ে কৃষি সেবা প্রদানের পাশাপাশি কৃষকদের ডিজিটাল সেবা নিশ্চিতের জন্য কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে কৃষকদের সরকারী কৃষি সেবার বিভিন্ন অ্যাপসগুলো বিষয়ে অবহিত করা হচ্ছে।
কৃষি উপসহারী কর্মকর্তা মো. হারুনুর রশীদ ভূঁইয়া জানান,তার নিজের তত্বাবধানে রাঙ্গামাটির সাপছড়িপাড়া দূর্গম পাহাড়ী এলাকায় ৬৫জন বেকার যুবক ও কৃষকদের ভার্মি কম্পোজ বা কেচো সার ও বিভিন্ন ফসল উৎপাদনের প্রশিক্ষণসহ তা অনলাইনে বিক্রির বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। সরকারী ডিজিটাল সেবা গ্রহনের মাধ্যমে রাঙ্গামাটির পাহাড়ের দূর্গম এলাকার এসব বেকার যুবক ও কৃষকরা এখন বেশীরভাগই সফল হয়েছেন বলে জানান তিনি।
পাহাড়ে ডিজিটাল নেটওয়ার্কের সরকারী সেবা প্রসারের কারনে রাঙ্গামাটিতে এবার ফসলের বাম্পার ফলন হয়েছে বলে উল্লেখ করে এই কৃষি কর্মকর্তা বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান।
সরকারি ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করে ভার্মি কম্পোজ বা কেচো সার ও অন্যান্য ফসল উৎপাদন বিষয়ে সচেতন করাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত এলাকায় তা ছড়িয়ে দিতে পারলে রাঙ্গামাটির পাহাড়ী এলাকায় শিক্ষিত বেকার যুবকেরা স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি পাহাড়ে কৃষিক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারবে বলে বিশ^াস এখানকার কৃষকসহ স্থানীয়দের।