ডিজিটালের ছোঁয়ায় ই-কমার্সের জোয়ার

1895

কুমিল্লা (দক্ষিণ), ১২ মে, ২০২১, (বাসস) : চাল-ডাল যে অনলাইনে কেনা যায়, তা এ করোনাকাল শিখিয়ে দিল দেশের মানুষকে। এখন অনেকেই অনলাইনে কাঁচাবাজারও সারছেন। ইলেক্ট্রনিকস পণ্য, পোশাক, গৃহস্থালির বিভিন্ন সরঞ্জাম অনলাইনে কেনার প্রবণতা আগেই ছিল। এখন করোনার কারণে ঈদকে কেন্দ্র করে তা আরো গতি পেয়েছে। সামাজিক দূরত্ব মেনে কেনাকাটার সুবিধার পাশাপাশি ই-কমার্স সাইটগুলো অনলাইন কেনাকাটায় বিশেষ মূল্যছাড়সহ দিচ্ছে বিভিন্ন ধরনের অফার। তবে নগর জীবনের ব্যস্ততা, যানজট আর নানা ঝক্কি-ঝামেলা এড়াতে অনলাইন কেনাকাটাতেই ঝুঁকছে মানুষ। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, শিক্ষিত তরুণদের পাশাপাশি কর্মব্যস্ত মানুষের জন্য এখন কেনাকাটার অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে ই-কমার্স সাইটগুলো। ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলোতে ই-কমার্সের জোয়ার এখন চোখে পড়ার বিশাল ব্যাপার। সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রচেষ্টার সফলতা হিসেবে যোগাযোগ প্রযুক্তি এখন শুধু বড় শহর নয়, বরং ছোট শহর এমনকি, গ্রামে-গঞ্জের মানুষের হাতে হাতে পৌঁছে গেছে। আর এর কল্যাণে ই-কমার্স তথা অনলাইনে কেনাকাটার প্রবণতাও ছড়িয়ে গেছে সবখানে। যোগাযোগ প্রযুক্তির সহজলভ্যতার সুযোগ নিয়ে মফস্বল থেকেও নিত্যনতুন পণ্য দিনে এখন অনেক উদ্যোক্তা যুক্ত হচ্ছেন ই-কমার্সের সাথে।
সহজলভ্যতার কারণে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের বাসিন্দারাও এখন চালডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনছেন বিভিন্ন ই-কমার্স সাইট থেকে। রমজান মাসে খোলা বাজারে যখন সবকিছুর দাম বাড়ে, তখন নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের ওপর মূল্যছাড় দিয়ে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি কেড়েছে এসব অনলাইন বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান।
ই-কমার্স সাইটগুলো থেকে কেনাকাটা করেন এমন মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে দিনকে দিন। শুধু রাজধানী কিংবা কুমিল্লাতে নয়, সরাদেশেই বাড়ছে অনলাইনে কেনাকাটা। এতোদিন কেবল ঢাকাভিত্তিক অনলাইন মার্কেট থাকলেও এখন দেশের সর্বত্রই গড়ে উঠছে এ ধরনের কেনাবেচার প্লাটফর্ম।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে ই-কমার্স খাত গতি পেতে শুরু করে ২০১৩ সাল থেকে। ওই বছর দুটি ঘটনা ঘটেছিল। প্রথমত, ক্রেডিট কার্ড দিয়ে আন্তর্জাতিক কেনাকাটার ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। একই বছর দেশের মোবাইল অপারেটরগুলো দ্রুতগতির তৃতীয় প্রজন্মের ইন্টারনেট সেবা (থ্রিজি) চালু করে। এরপর চতুর্থ প্রজন্মের ইন্টারনেট সেবা (ফোরজি) চালু হয়েছে। মানুষের স্মার্টফোন ব্যবহারের প্রবণতা বেড়েছে। অন্যদিকে ই-কমার্স খাতে নতুন নতুন বিনিয়োগ এসেছে। সব মিলিয়ে খাতটি বড় হয়েছে। ক্রেতাও বেড়েছে। ই-ক্যাবের হিসাবে, তাদের সদস্যসংখ্যা ১ হাজার ২০০। বছরে বিক্রির পরিমাণ আট হাজার কোটি টাকার মতো। অবশ্য এর বাইরে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছোট ছোট পণ্যবিক্রেতা রয়েছেন আরো অনেক। আবার অনেক দোকান মালিকও অনলাইনে পণ্য বিক্রি করেন।
অনলাইনে কেনাকাটার প্রতি বেশ কয়েক বছর ধরেই আগ্রহ বাড়ছে দেশের মানুষের। আর ঈদকে সামনে রেখে আরও জমজমাট হয়ে উঠেছে এ মাধ্যম। মাত্র কয়েক বছর আগেও ঈদ শপিং মানেই ছোটবড় বিভিন্ন শপিংমল, বিপণী বিতান ও ফ্যাশন হাউসে ঘুরে ঘুরে পণ্য কেনার ব্যাপার ছিল। কিন্তু ক্রেতাকে এখন আর যানজটে আটকে থেকে, মার্কেটে মার্কেটে ঘুরে ক্লান্ত ও গরমে ঘেমে অস্থির হতে হচ্ছে না। পছন্দের পণ্যটিতে ক্লিক করে অর্ডার করলেই পৌঁছে যাচ্ছে ক্রেতাদের ঘরে। ফলে এক দিকে যেমন অনলাইন শপিংয়ের পরিধি ও পরিসর সম্প্রসারিত হচ্ছে অন্যদিকে শহরের বড় বড় শপিং কমপ্লেক্সেও পড়ছে তার প্রভাব।
ই-কমার্স সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গতবছরের তুলনায় এবছর তাদের ক্রেতার সংখ্যা বেড়েছে। কেনাবেচার জন্য নির্দিষ্ট সাইটগুলোর পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও জমে উঠেছে এ কেনাবেচা। বিশেষ করে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে খোলা হচ্ছে পেজ। আর তা থেকেই ক্রেতারা খুঁজে নিচ্ছেন পছন্দের পণ্য। উদ্যোক্তাদের মতে, নতুনদের পাশাপাশি বিশ্বের বড় মাপের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন তাদের পণ্যের প্রচারে ব্যবহার করছে ফেইসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে। অল্প পুঁজিতে, এমনকি বিনা পুঁজিতে এ ব্যবসা করা যায়। ঘরে বসেই ব্যবসা পরিচালনা করা যায়। তাই নতুন উদ্যোক্তাদের কাছে এ মাধ্যমটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
ভিআইপি ফ্যাসন’র সত্ত্বাধিকারী ফারজানা কামাল সোমা বলেন, কিছুদিন হলো আমি ই-কমার্স শুরু করেছি। অনলাইনে একটি পেইজ ওপেন করে তাতে কিছু ছবি দিয়ে যে ধরনের সাড়া পাচ্ছি তা বেশ ইতিবাচক। লেখাপড়ার পাশাপাশি তিনি এ কাজটি করছেন। সোমা বলেন, কুরিয়ারের লোক বাসায় এসে অর্ডার নিয়ে যায়, আমার তেমন কোনো ঝামেলা পোহাতে হয় না। তা ছাড়া ব্যবসা করতে গেলে যে ধরনের ঝামেলা থাকে তা এ ব্যবসায় নেই।
কেনাকাটায় ঝামেলামুক্ত ও সহজ এ মাধ্যমে ঝুঁকছে বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের একটা বড় অংশ। প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের ই-কমার্স ব্যবসা অথবা ডটকম করোনাকালে আগের চেয়ে তিন গুণ পণ্য কেনাবেচা করছে। তারা জানিয়েছে, এ সময়ে ক্রেতারা সবচেয়ে বেশি কিনেছেন মাস্ক, জীবাণুনাশক, হ্যান্ড গ্লাভস বা দস্তনাসহ বিভিন্ন ধরনের সুরক্ষাসামগ্রী। এরপরই রয়েছে পার্সোনাল কেয়ার পণ্য, ভোগ্যপণ্য, ব্যায়াম করার জন্য ট্রেডমিল ও বিভিন্ন ধরনের ফল। বাইসাইকেলের চাহিদাও বেড়েছে। স্যামসাং ব্র্যান্ডের ইলেকট্রনিকস পণ্য উৎপাদনকারী ফেয়ার ইলেকট্রনিকসের বিপণনকারী মোখলেসুর রহমান বলেন, করোনার আগে তাঁদের মোট বিক্রির ১ থেকে ২ শতাংশ হতো অনলাইনে। এখন সেটা ৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা অনলাইনে জোর দিচ্ছি। বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছি।
ঝাউতলার বাসিন্দা আমেনা বেগম বলেন, আট ঘণ্টা অফিস আর সড়ে তিন ঘণ্টার যানজট ঠেলে কাজ করার পর সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বের হতে ইচ্ছে হয় না। এছাড়া বাচ্চাদের সময় দেয়া এবং অন্যান্য জমে থাকা কাজ তো আছেই। এজন্য কেনাকাটার জন্য আলাদা করে সময় বের করতে পারেন না তিনি। তাই অনলাইন কেনাকাটা তার জীবনকে সহজ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় করেছে। তিনি বলেন, একটি জিনিস কিনতে আগে পুরো বিণিীবিতান ঘুরতে হতো। এতে অনেক সময় নষ্ট হতো। এখন ঘরে বসেই পছন্দের জিনিস পেয়ে যাচ্ছি।
অনলাইন কেনাকাটায় আগ্রহী কেন জানতে চাইলে আয়েশা আক্তার ও মনির তালুকদার দম্পতি বলেন, একে তো কর্মব্যস্ত থাকি। তারপর আমরা যে পণ্যটি কিনতে চাই তা কোথায় পাব? তার কোন মডেলটি আমি নেব? তার গুণাগুণ কী? এটা মার্কেটে ঘুরে ঘুরে বের করা এবং জানা কঠিন। কিন্তু অনলাইনে সহজেই জানা যায়।
তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এবং ই-কমার্স বিশ্লেষকরা বলছেন, গত দুই বছরে দেশের বড় শহরগুলোর কেনাকাটার চরিত্রে অনেক পরিবর্তন এসেছে। এর ফলে চিরাচরিত বাজারগুলোতে ভিড় কমেছে প্রায় ৪০ শতাংশ। টেকনোলজির ব্যবহারের ফলে অনলাইনে বেশ কিছুটা কম দামে জিনিস দেওয়া সম্ভব, যা কোনোভাবেই সাধারণ দোকানে দেওয়া সম্ভব নয়। শুধু পোশাক নয় অনান্য জিনিস কেনার ক্ষেত্রেও বাড়ছে অনলাইনের চাহিদা।
অনলাইন মার্কেটিং বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস)-এর সাবেক সভাপতি ফাহিম মাশরুর জানান, এখন শুধু অনলাইন ওয়েবসাইটেই (ফেসবুক বাদে) আমাদের লেনদেনের ৪০ শতাংশের মতো হচ্ছে এমএফএসের মাধ্যমে। এটা করোনার আগে ২০ শতাংশ ছিল। অনলাইনে এখন নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস থেকে সব ধরনের পণ্যই পওয়া যায়। টিকেট বিক্রি, স্বাস্থ্যসেবাও দেয়া হয় অনলাইনে। তিনি আরও বলেন, অনলাইনে সবচেয়ে বড় সুবিধা ক্রেতারা যেটা পাচ্ছেন, সেটা হলো ঘরে বসে অর্ডার দিয়ে ঘরে বসেই পেয়ে যাচ্ছেন কাক্সিক্ষত পণ্য। আসলে ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল পাচ্ছে সাধারণ মানুষ। দিন যত যাবে, এর পরিধিও তত বাড়বে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।