বাসস দেশ-২ : নাটোরে আজ শহীদ সাগর দিবস

86

বাসস দেশ-২
শহীদ সাগর দিবস
নাটোরে আজ শহীদ সাগর দিবস
নাটোর, ৫ মে, ২০২১ (বাসস) : আজ ৫ মে নাটোরের নর্থ বেঙ্গল চিনিকলের গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের এ দিনে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাক হানাদার বাহিনী চিনিকল অবরুদ্ধ করে তৎকালীন প্রশাসকসহ ৪২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে। শহীদদের স্মরণে দিবসটি শহীদ সাগর দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী উত্তর বঙ্গের হেডকোয়ার্টার হিসেবে নাটোরে অবস্থান নেয়। ৫ মে সকালে তারা লালপুরের গোপালপুরে যাত্রা করে। চিনিকলের কাছাকাছি পৌঁছে গোপালপুর রেল ষ্টেশনের রেল ক্রসিং এ বাঁধার সম্মুখীন হয়। ষ্টেশনের পরিত্যক্ত ওয়াগন টেনে এনে রেল ক্রসিং এ ব্যারিকেড দেয় মুক্তিযোদ্ধারা। এ ব্যারিকেডের সাথে জড়িতদের হত্যার মাধ্যমে শুরু হয় হত্যাযজ্ঞ। হানাদার বাহিনী নর্থ বেঙ্গল চিনিকল ঘিরে ফেলে। চিনিকলের সবগুলো গেটে তালা লাগিয়ে অবরুদ্ধ করে অবাঙ্গালিদের যোগসাজশে বাঙ্গালিদের সনাক্ত করে চিনিকলের এক নম্বর গেট সংলগ্ন পুকুর ঘাটে নিয়ে যায়। তাদেরকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে নির্মমভাবে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে লাশগুলো পুকুরে ফেলে দেয়। সেদিনের এ হত্যাযজ্ঞে কোন অবাঙ্গালি যাতে মারা না পড়ে সে জন্যে তাদের সবার মাথায় সাদা রুমাাল বাঁধা ছিল।
পাক হানাদার বাহিনীর লোমহর্ষক হত্যাযজ্ঞের নীরব স্বাক্ষী বুলেটবিদ্ধ হয়ে লাশের স্তুপের নিচে চাপা পড়েও সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে ছিলেন কয়েকজন। তাদের একজন এ চিনিকলের পাওয়ার হাউজের এসবিএ পদে চাকুরী করতেন খন্দকার জালাল আহমেদ। কিছুদিন আগে না ফেরার দেশে চলে যানা খন্দকার জালাল আহমেদ। জীবিত অবস্থায় দেয়া তার এক সাক্ষাৎকারে জানা যায় ঐদিনের ঘটনার বিবরণ। তিনি বলেন, “আনুমানিক সকাল সাড়ে দশটা। ডিউটি করছি। দুজন পাক সেনা আমার দুপাশে এসে দাঁড়ালো। একজন পিঠে রাইফেল ঠেকিয়ে বললো, ‘ইয়ে বাঙ্গালি চলো, মিটিং হোগা, মিটিং মে চলো’। এসময় মাথায় সাদা রুমাাল বাঁধা মঞ্জুর ইমান নামে একজন অবাঙ্গালি কর্মচারী বাঙ্গালিদের সনাক্ত করে দিচ্ছিল। এদিকে মিলের প্রশাসক আনোয়ারুল আজিমসহ অন্যান্যদের ধরে এনে মাটিতে বসিয়ে রাখে। একজন পাক অফিসার আজিম সাহেবকে লক্ষ্য করে বলে, ‘কিসনে মেজর আসলামকে মারা হায়’? তিনি বলেন, ‘জানিনা’।
নরপশুরা আমাদেরকে অফিসার্স কোয়ার্টারের পুকুর ঘাটে নিয়ে গিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করায়। তখনই বুঝতে পারলাম, নিশ্চিত মারা যাচ্ছি। কয়েক মিনিটের মধ্যে ঘাতকদের ১৩ টি স্বয়ংক্রিয় এলএমজি এক সঙ্গে আমাদের ওপর গর্জে উঠে। গগনবিদারী চিৎকারে আকাশ-বাতাসে আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়ে। মুহুর্তের মধ্যে পুকুর ঘাট লাশের স্তুপে পরিণত হয়। তাজা রক্তের স্রোতে রক্ত রাঙা হয়ে যায় পুকুরের পানি। নিথর নিস্তব্ধ হয়ে যায় প্রকৃতি। মৃত্যু নিশ্চিত করতে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে পুকুরের মধ্যে গড়িয়ে দেয় মরদেহগুলো। এক সময় জ্ঞান ফিরে পেয়ে দেখি, আমার মাথাটা পুকুর ঘাটের সিড়ির ওপরে এবং শরীরের অর্ধেকটা রক্তে রঞ্জিত পানির মধ্যে ডুবে আছে। লাশের স্তুপের মধ্যে উল্টিয়ে-পাল্টিয়ে জীবন্ত কাউকে খুঁজে ফিরেেছ আমার এক সহকর্মী মেহমান আলী। বুঝলাম, তিনিই আমাকে লাশের স্তুপের মধ্যে থেকে উদ্ধার করেছেন। বহু কষ্টে উঠে বসতেই দেখতে পেলাম, পাশে পড়ে আছে ছোট ভাই মান্নানের লাশ। সে বিভৎস দৃশ্যের কথা মনে হলে আজও শিউরে উঠি, গায়ে কাঁটা দিয়ে লোম খাড়া হয়ে উঠে”।
শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে শহীদ সাগর চত্বরে স্মৃতিসৌধ ও জাদুঘর নির্মিত হয়েছে। ১৯৭৩ সালের ৫ মে মিলের প্রশাসক লেঃ আনোয়ারুল আজিমের স্ত্রী বেগম শামসুন্নাহার শহীদ সাগর চত্ব¡রে স্মৃতিসৌধ উদ্বোধন করেন। স্মৃতি ফলকে ৪২ জন শহীদের নামের তালিকা লিপিবদ্ধ করা আছে। আনোয়ারুল আজিমের নামানুসারে গোপালপুর রেল স্টেশনের নামকরণ করা হয় আজিমনগর স্টেশন। মুক্তিযুদ্ধে আতœদানের স্বীকৃতি হিসেবে শহীদ আনোয়ারুল আজিমকে ২০১৮ সালে সরকার স্বাধীনতা পদক (মরণোত্তর) প্রদান করে।
তমালতলা কৃষি ও কারিগরি কলেজের উপাধ্যক্ষ বাবুল আকতার বলেন, ৩০ মার্চ লালপুরের ময়নায় পাক হানাদার বাহিনীর সাথে প্রতিরোধ যুদ্ধে ৪০ জন বাঙালী এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মেজর খাদেম হোসেন রাজাসহ সাতজন নিহত হন। মেজর রাজাসহ সাতজন হত্যার প্রতিশোধ এবং নর্থ বেঙ্গল চিনিকলের প্রশাসক লে. আনোয়ারুল আজিম কর্তৃক মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতার কারনেই সম্ভবত শহীদ সাগর হত্যাযজ্ঞ।
নর্থ বেঙ্গল চিনিকল হাইস্কুলের ছাত্র রিদওয়ান হোসেন জানায়, নতুন প্রজন্ম কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করে শহীদ সাগরের এ আতœদানকে। চিনিকলের ঐ সময়ের সহকারী হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা শহীদ মোছাদ্দারুল হক দেশের জন্যে প্রাণ দিয়েছেন বলে গর্ববোধের কথা জানালো তাঁর নাতনী একই স্কুলের ছাত্রী ফাইজা ফারহা।
শহীদ সাগর প্রাঙ্গনে প্রবেশ করলে ফুলের গাছগুলো মনকে পবিত্র করে দেয়। শত বছরের প্রাচীন আর আকাশ ছোঁয়ার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা ১৩টি পাম গাছ যেন বিষন্নতা ছড়িয়ে দিচ্ছে, কেঁদে ওঠে মন। পুকুরের চারিদিকে গাছের তলায় শহীদদের মরদেহগুলো গণকবর দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এসব কবর চিহ্নিত করা নেই। কবরগুলো চিহ্নিতকরণের পদক্ষেপ নেয়া হবে বলে প্রত্যাশা সচেতন মানুষের।
প্রতিবছর শহীদদের আত্মীয়-স্বজন, চিনিকলের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও স্থানীয় লোকজন ৫ মে শহীদ সাগর চত্বরে সমবেত হন। এবছর করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে চিনিকল কর্তৃপক্ষ বেলা এগারোটায় সংক্ষিপ্ত পরিসরে শহীদ সাগর চত্বরে ফাতেহা পাঠ ও দোয়া মাহফিল আয়োজন করেছে বলে জানালেন চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কৃষিবিদ হুমায়ুন কবীর।
বাসস/এনডি/সংবাদদাতা/১০৫২/নূসী