মেহেরপুরে বাঁশ শিল্পের কারিগররা ফিরে আসছে পেশায়

252

॥ দিলরুবা খাতুন ॥
মেহেরপুর, ২২ এপ্রিল, ২০২১ (বাসস) : মানুষ স্বাস্থ্য সচেতন হবার কারণে ঐতিহ্যবাহী বাঁশ শিল্পের তৈরি বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা ফের বাড়ছে। জেলায় যারা এ পেশা থেকে সরে গিয়েছিলেন বাঁশশিল্পের পণ্যের চাহিদা বাড়াতে তারা আবার এ পেশাতে ফিরে আসছে। প্লাষ্টিক, এ্যালোমেনিয়ামের সাথে প্রতিযোগিতা করে জীবন জীবিকার তাগিদে বাপ-দাদার এ পেশাকে ধরে রেখেছিলো অনেক পরিবার। তাদের মুখে এখন হাসি ফুটছে তাদের তৈরী পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধির কারণে।
এক সময় গ্রামীণ জনপদের মানুষ গৃহস্থলি, কৃষি ও ব্যবসা ক্ষেত্রে বাঁশের তৈরি সরঞ্জামাদি ব্যবহার করতো। বাসা-বাড়ি, অফিস-আদালত সবখানেই ব্যবহার করা হতো বাঁশের তৈরি আসবাবপত্র। স¦ল্প দামে হাতের নাগালে প্লাস্টিকের পণ্য পাওয়ায় বাঁশ শিল্পের চাহিদা প্রায় হারিয়ে গিয়েছিল। প্লাস্টিক ব্যবহারকারীরা ফের ফিরে আসছে বাঁশের দিয়ে তৈরী পণ্যের কাছে। কারণ প্লাস্টিক সামগ্রী ব্যবহারে বাঁশ দিয়ে তৈরী পণ্যের মতো ব্যবহারয্যো না হওয়া। তাছাড়া প্লাস্টিক স্বাস্থ্য সম্মত না হবার কারণে বাঁশ শিল্প পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। একইসাথে চাহিদা বেড়ে যাবার কারণে নতুন নতুন বাঁশবাগানও তৈরী হচ্ছে। বাঁশ শিল্পের কারিগররা জানায় এখনো নববর্ষ, গ্রামীণ উৎসব ও মেলাগুলোতে বাঁশের তৈরী কুলা, ঝুড়ি, খোল, চাটাই, খোলুই, ধামা, টোনা, মোড়া, দোলনা, বুক সেলফ ব্যাপক বিক্রি হয়। শহর ও গ্রাম গঞ্জেও এসবের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে।
মেহেরপুর জেলা শহর ও গ্রামীণ জনপদে ফেরি করে বাঁশ দিয়ে তৈরী পণ্য ্র বিক্রি করতে আসা রজনি বলেন, বেত শিল্পের এতদিন দুর্দিন ছিলো। তার পর ও বাঁশ শিল্পকে আঁকড়ে ধরে ছিলেন। যদিও কেউ কেউ এ পেশা ছেড়ে চলে গেছে। পূর্বপুরুষের হাতেখড়ি এ পেশাকে কিছুতেই ছাড়তে পারেননি তারা। প্রতিদিন তাদের তৈরি কিছু পণ্য পৌর বাজারসহ গ্রাম-গঞ্জে ও গ্রামীণ হাটে বিক্রি করেন। ক্রেতাদের অধিকাংশজন এতদিন সৌখিন মানুষ ছিলো। এখন আবার বিক্রি বেড়েছে মানুষ স্বাস্থ্য সচেতন হবার কারণে।
একসময় ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মেহেরপুর জেলা শহরের বামনপাড়াতে কোল সম্প্রদায় বাঁশের চটা দিয়ে চাটাই, কুলা, ডালা, চাঙারি, টুকরি, ওড়া, চালুনি, মাছ রাখার খালই, ঝুড়ি ও হাঁস-মুরগির খাঁচাসহ বিভিন্ন জিনিস তৈরি করতো। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও এ কাজে সামিল হতো। আর হাটবারে হাটে, স্থানীয় বাজারে এমনকি বাড়ি বাড়ি ফেরি করে এসব বাঁশ-বেতের পণ্য বিক্রি হতো। এখন বাড়িতে বসেই তারা অর্ডার পান। এ জনগোষ্ঠীর একজন শুখি দাস। মেহেরপুরের বামনপাড়ার কোল কলোনির বাসিন্দা। স্বামীর নাম শুব্রত দাস। সংসারের অর্থ উপার্জনে রেখেছে ব্যাপক ভ’ুমিকা। বাঁশ দিয়ে তৈরি করেন নানা রকম গৃহস্থলি পণ্য। টুকা, , ঝুড়ি, খাচাসহ আরও অনেক কিছু। সামনের আম মৌসুমের জন্য নিজ হাতে বানাচ্ছে আমের ঝুড়ি। পুরুষদের পাশাপাশি সমান তালে এগিয়ে যাচ্ছেন শুখি দাস। বাঁশের তৈরি বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করে খরচ বাদে মাস শেষে ৬-৭ হাজার টাকা জমা হয় বলে জানিয়েছেন শুখি। তিনি বলেন, প্রায় ১৫ বছর আগে স্বামীর ঘরে প্রবেশ করেন। ১৫ বছরের সংসারে রয়েছে দুই ছেলে। একজনের বয়স ১৩ আরেক জনের ৭। বড় ছেলেও লেখা পড়ার পাশাপাশি বংশগত এ কাজে সহযোগিতা করে। স্বামীর সাথে সাথে নিজেও এ বাঁশের কাজ করে সংসারকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে।
একই পাড়ার আরেকজন অদম্য নারী পবি রানী । তিনিও বাঁশের কারিগর। পূর্ব পুরুষদের এ ঐতিহ্যবাহী কাজ করে অসছেন প্রায় ৫ বছর ধরে। সংসার জীবনে রয়েছে এক ছেলে। স্বামী রঞ্জিত দাস এর সাথে বাঁশের বিভিন্ন পণ্য তৈরিতে সহযোিগতা করেন। অর্থ উপার্জনে রেখেছেন বড় ভ’মিকা। আমের মৌসুম সামনে। তাই বেশ জোরে সরেই করছিলেন ঝুড়ি তৈরির কাজ। কথা হলো তার সাথে, পবি রানী বলেন, এটা আমাদের বংশগত কাজ। এর এলাকার প্রায় প্রতিটি মেয়েই এ কাজের সাথে জড়িত। সংসার চালিয়ে মাস শেষে ৫-৬ হাজার টাকা সঞ্চয় হয়।
সামাজিক হেনেস্তার শিকার হতে হয় কিনা জানতে চাইলে আরেক কারিগর লিপি বলেন, কখনো কখনো হতে হয়। আমাদের অন্য মানুষরা খাটো করে দেখে। অথচ সমাজে আমরাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করি। পুরুষদের পাশাপাশি নিজেরাও উপার্জন করতে পারছি। ৮ বছর ধরে লিপি দাস বাঁশের কাজ করছেন। এক মেয়ের জননী লিপির স্বামী সুজন বাঁশের পণ্য তৈরির পাশাপাশি ভ্যানও চালায়। অর্থ উপার্জনের দিক থেকে তিনি বেশ এগিয়ে। মাস শেষে এখন সঞ্চয় হচ্ছে। লিপির দাবি- স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর প্লাস্টিক রাষ্ট্রীয়ভাবে বন্ধ করলেই তারা ফিরে পাবে তাদের ব্যবসা। হবে তারা স্বাবলম্বী। যারা পেশা বদলেছে তারও আবার ফিরে আসবে এ পেশায়।