নাটোরে রসুনের শ্বেত বিপ্লব

322

নাটোর, ১৭ এপ্রিল, ২০২১ (বাসস) : দেশের ৩০ ভাগ রসুন উৎপাদনকারী জেলা নাটোরে এবার বাম্পার ফলনের মধ্য দিয়ে শ্বেত বিপ্লব ঘটেছে। চলতি মৌসুমে ফলন দুই লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে। জমি থেকে কৃষকদের রসুন সংগ্রহ এখন শেষের পথে। বাড়ির আঙিনায় গায়ের বধূরা ব্যস্ত সময় পার করছেন রসুন প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ কাজে।
চলতি মৌসুমের কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশের ১৪টি কৃষি অঞ্চলের ৬৪ জেলায় রসুনের আবাদি জমির পরিমাণ ৮৬ হাজার ৪৯৯ হেক্টর। এরমধ্যে দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ নাটোরে ২৫ হাজার ১৩০ হেক্টর জমিতে রসুন আবাদ হয়েছে। অর্থাৎ দেশের রসুনের আবাদি জমির প্রায় ৩০ ভাগই নাটোর জেলায়।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বিগত বছরগুলোতে জেলায় রসুনের আবাদি জমির পরিধি ও উৎপাদন উভয়ই ক্রমশঃ বেড়েছে। ২০১২ সালে ১৪ হাজার ৮০৫ হেক্টর জমিতে রসুন আবাদ করে ফলন পাওয়া গিয়েছিল এক লাখ ১১ হাজার ৪৩৮ টন। চলতি রবি মৌসুমে নাটোর জেলায় ২২ হাজার হেক্টর জমিতে রসুন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে চাষ হয়েছে ২৫ হাজার ১৩০ হেক্টর। কৃষি বিভাগের প্রাথমিকভাবে প্রাপ্ত তথ্যে এবার রসুনের উৎপাদন হবে অন্তত দুই লক্ষ ছয় হাজার টন। অর্থাৎ বিঘাপ্রতি গড় ফলন প্রায় ২৮ মণ।
নাটোরে উৎপাদিত রসুনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- বিনা চাষে রসুন উৎপাদন। প্রচলিত পদ্ধতিতে জমি চাষ করে রসুন লাগানো হয়। নাটোরে এবার রসুনের আবাদি জমির শতভাগই বিনা চাষের রসুন। ১৯৯৪-৯৫ সালে জেলার সীমান্তবর্তী বড়াইগ্রাম ও গুরুদাসপুর উপজেলার কৃষকরা স্বপ্রণোদিত হয়ে বিনা চাষে রসুন আবাদ করেন। গুরুদাসপুর উপজেলার কাছিকাটা এলাকার কৃষক জেহের আলী কার্তিক মাসে বর্ষার পানি নেমে যাওয়ার পর জমিতে রসুনের কোয়া বুনে বিনা চাষে রসুন উৎপাদনের প্রচলন করেন। এ পদ্ধতিতে রসুন আবাদে জমি চাষ করতে হয় না, সেচও লাগেনা। আগাছা থাকে কম এবং সারের ব্যবহার খুবই কম। উৎপাদন ব্যয় তুলনামূলক কম হওয়ার পাশাপাশি উৎপাদনের পরিমাণ বেশী হওয়ায় এ পদ্ধতি কৃষকদের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। প্রসার ঘটে জেলার অন্যসব উপজেলা ছাড়িয়ে দেশের অন্য জেলাগুলোতে।
জেলার বেশিরভাগ রসুন উৎপাদিত হয় গুরুদাসপুর ও বড়াইগ্রাম উপজেলায়। জেলার ২৫ হাজার ১৩০ হেক্টর আবাদি জমির মধ্যে বড়াইগ্রাম উপজেলায় সর্বোচ্চ ১০ হাজার ৭৪০ হেক্টর, গুরুদাসপুরে ছয় হাজার ৩০০ হেক্টর, নাটোর সদর উপজেলায় তিন হাজার ৪৫০ হেক্টর, লালপুরে এক হাজার ৫১০ হেক্টর, সিংড়ায় এক হাজার ৪৬০ হেক্টর, বাগাতিপাড়ায় এক হাজার ১১০ হেক্টর এবং নলডাঙ্গা উপজেলায় ৫৬০ হেক্টর। জমি থেকে রসুন সংগ্রহ প্রায় শেষ হয়েছে বলা চলে। ২৫ হাজার ১৩০ হেক্টরের মধ্যে ২১ হাজার ৪০০ হেক্টর জমির রসুন ইতোমধ্যে সংগ্রহ করা হয়েছে। জমি থেকে রসুন সংগ্রহের ব্যস্ততা প্রায় শেষের পথে। এখন কৃষকদের বাড়ির আঙিনায় ব্যস্ততা। সফলতা ও সমৃদ্ধির সুখ স্বপ্নে বিভোর গ্রামের বধূরা এখন রসুন প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। এ কাজে কৃষক বধূদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মত।
বড়াইগ্রাম উপজেলার তিরাইল গ্রামের রসুন চাষি তোফাজ্জল হোসেন চলতি মৌসুমে ১ বিঘা জমিতে রসুন আবাদ করেছেন। তিনি বলেন, মৌসুমের শুরুতে অনুকূল আবহাওয়া বিরাজ করায় রসুন বীজের অঙ্কুরোদগম ভালো হয়েছিল। বিঘাপ্রতি ২৯ মণ ফলন পেয়েছেন তিনি। উপজেলার বাজিতপুর এলাকার হাসানুল বান্না উজ্জল বিঘায় ফলন পেয়েছেন ৩১ মণ। গুরুদাসপুর উপজেলার সিধুলি গ্রামের খলিলুর রহমানের বিঘায় ফলন ২৭ মণ। সিংড়া উপজেলার বড় সাঁঐল গ্রামের কৃষক নেতা আনিসুর রহমান সরকার এক বিঘা জমিতে রসুন চাষ করে ফলন পেয়েছেন ২৮ মণ। তিনি বলেন, খরচ হয়েছে ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা। বর্তমান বাজার দরে অন্তত ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করলে মুনাফা থাকবে অন্তত ৩০ হাজার টাকা। তবে সংরক্ষণ করলে পরে বেশী দাম পাওয়া যাবে।
বড়াইগ্রাম উপজেলা কৃষি অফিসার শারমিন সুলতানা বলেন, উপজেলা জমি থেকে রসুনের সংগ্রহ কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। বিঘাপ্রতি ২৮ মণ গড় ফলনে সন্তোষ প্রকাশ করে কিছু ক্ষেত্রে রসুনের উৎপাদন কম হওয়ার কারণ সম্পর্কে কৃষিবিদ শারমিন সুলতানা বলেন, একই জমিতে বার বার রসুন চাষ এবং মাটিতে জৈব সারের ঘাটতির কারণে ক্ষেত্র বিশেষে এমন হতে পারে।
গুরুদাসপুর উপজেলা কৃষি অফিসার হারুনর রশীদ জানান, শুধু বিনা হালে রসুন চাষই নয়, রসুনের জমিতে সাথী ফসল হিসেবে তরমুজ ও বাঙ্গী চাষের উদ্ভাবনও এলাকা থেকেই হয়েছে।
বড়াইগ্রাম উপজেলার সরকার বাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক খাদেমুল ইসলাম বলেন, ৯০-এর দশকে উদ্ভাবনের পর থেকে রসুন চাষের মাধ্যমে এলাকার মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে। এলাকার কাঁচাবাড়ীগুলো পাাকা হয়েছে। বাড়িতে বাড়িতে শিক্ষার্থীরা ব্যয় নির্বাহ করে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছেন।
বিগত দুই দশকে নাটোরে কৃষি ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈচিত্রকরণ হয়েছে। কৃষকদের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং কৃষি বিভাগের নতুন নতুন প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণের সমন্বয়ে প্রচলিত শস্যের বাইরে কৃষকরা অপ্রচলিত কিন্তু লাভজনক শস্যের প্রতি ঝুঁকে পড়েছেন। এক্ষেত্রে রসুন অগ্রগামী শস্য। বর্তমানে রসুন চলনবিল অধ্যুষিত গুরুদাসপুর ও বড়াইগ্রাম এলাকার সবচেয়ে লাভজনক শস্য।
নাটোর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ পরিচালক সুব্রত কুমার সরকার বাসসকে বলেন, কৃষকদের প্রচেষ্টা এবং কৃষি বিভাগের পরামর্শ ও সহযোগিতায় রসুনের আশাতীত উৎপাদন হয়েছে। রসুনের বহুমুখী ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়াতে মৌসুমের শুরুতেই উর্ধ্বমুখী বাজার দর ভবিষ্যতে আরো বৃদ্ধি পেয়ে কৃষকরা অধিক লাভবান হবেন বলে আশা প্রকাশ করেন উপ পরিচালক।