জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছে : মোমেন

447

।। তানজিম আনোয়ার ।।
ঢাকা, ১৬ এপ্রিল, ২০২১ (বাসস) : পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন বলেছেন, রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর বিষয়ে এক প্রাথমিক প্রতিবেদনে জাতিসংঘ (ইউএন) একটি ‘খুবই ইতিবাচক’ মন্তব্য করেছে।
তিনি আজ বাসসকে বলেন, ‘তারা প্রাথমিকভাবে আমাদের (ভাসানচর সম্পর্কে) দু’পৃষ্ঠার একটি প্রাথমিক মূল্যায়ন প্রতিবেদন দিয়েছে এবং তাদের প্রতিবেদনটি বেশ ইতিবাচক। তার অফিস এখন ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর বিষয়ে জাতিসংঘের বিশদ প্রতিবেদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
কয়েকটি অধিকার সংস্থা সম্প্রতি চার বছর আগে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দ্বারা বিতাড়িত এই সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি সম্পর্কে আশঙ্কা করার পর রোহিঙ্গাদের জন্য বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পর্যালোচনা করতে জাতিসংঘের একটি কারিগরি দল স¤প্রতি এ দ্বীপটি পরিদর্শন করেছে।
মোমেন বলেন, জাতিসংঘের দলটি রোহিঙ্গাদের জন্য সুবিধাগুলো সম্পর্কে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে অনেক রোহিঙ্গা তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সেখানে যেতে বাধ্য হয়েছে এমন জল্পনা নাকচ করে দিয়েছে।
তিনি বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ সপ্তাহের মধ্যে একটি বিশদ মূল্যায়ন প্রতিবেদন পাওয়ার প্রত্যাশা করছে। যদিও, দেশব্যাপী কোভিড-১৯ লকডাউনের পরিপ্রেক্ষিতে এটি আরো কিছুটা সময় নিতে পারে।
শরণার্থীদের জন্য ইউএন হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর)-এর বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের সহকারী প্রতিনিধি ফুমিকো কাশিওয়া ১৮ থেকে ১৫ মার্চ ভাসানচর সফরকারী ১৮ সদস্যের দলটির নেতৃত্ব দেন। দলের সদস্যরা স্থানান্তরিত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।
সরকার ইতোমধ্যে প্রায় ১৩ হাজার রোহিঙ্গাকে হাতিয়ার প্রশাসনিক আওতাধীন মূল ভূখন্ডের ৩৭ মাইল দূরের ভাসান চরে স্থানান্তর করেছে।
ভাসান চরকে ১ লাখ রোহিঙ্গার বসবাসের উপযোগী করার জন্য সমস্ত নাগরিক সুযোগ-সুবিধাসহ একটি মডেল শহরে পরিণত হয়েছে।
সেখানে মোট ১২০ টি ইটের তৈরি গুচ্ছগ্রাম এবং ১২০ টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, শিক্ষা, হাসপাতাল, চাষ ও মাছ ধরা এবং খেলার মাঠের সুবিধা করা হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতি দ্বীপবাসীর সুরক্ষা নিশ্চিত করেছে।
জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা এর আগে অশঙ্কা প্রকাশ করেছিল যে ভাসনচরের বাসিন্দারা জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকির মুখোমুখি হতে পারে।
অবকাঠামোগত উন্নয়নের সাথে ঘনিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, প্রকল্পের চারপাশে বন্যাসুরক্ষা বাঁধ এখন নয় ফুট থেকে ১৯ ফুট পর্যন্ত উঁচু করা হচ্ছে এবং বাড়িগুলো মাটির চার ফুট ওপরে নির্মাণ করা হয়েছে।
মোমেন যোগ করেন যে দ্বীপটিকে জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষার ব্যবস্থা জোরদারে বাঁধটি আরো উঁচু করার কাজ চলছে।
মন্ত্রী বলেন, ‘তাদের (জাতিসংঘ ও সহায়তা সংস্থা) একটি ভ্রান্ত ধারণা ছিল যে ভাসানচর একটি ছোট দ্বীপ যা জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যেতে পারে। এখন তারা জেনেছে যে এটি একটি ৪০ বর্গ কিলোমিটার দ্বীপ, যা আমাদের সেন্টমার্টিন দ্বীপের চেয়েও ১০ গুণ বড়।’
মোমেন বলেন, জাতিসংঘ দল অবশ্য তাদের প্রাথমিক প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা শিশুদের পড়াশোনা এবং ভাসানচর ও মূল ভূখ-ের মধ্যে যোগাযোগের বিষয়ে জানতে চেয়েছে।
মন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা দিতে বাংলাদেশের কোনো সমস্যা নেই। তবে, তা অবশ্যই মিয়ানমারের ভাষা ও পাঠ্যক্রমের অধীনে থাকতে হবে যাতে তারা রাখাইনে ফিরে এটি কাজে লাগাতে পারে।
সরকার জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থাকে ভাসানচরে তাদের কার্যক্রম শুরু করার জন্য আহ্বান জানিয়ে আসছে, যেখানে তাদের জন্য আলাদা ভবন তৈরি করা হয়েছে।
তবে, জাতিসংঘ বলেছিল যে দ্বীপে তাদের কার্যক্রম সরেজমিন পরিদর্শনের ওপর নির্ভর করবে।
মোমেন বলেন, ‘বাস্তুচ্যুত মানুষদের মানবিক সহায়তা দেওয়াটা জাতিসংঘের বাধ্যবাধকতা। তাদের কোথায় আশ্রয় দেওয়া হচ্ছে এটি গৌণ বিষয়।
তিনি বলেন, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষদের জন্য মানবিক সহায়তার জন্য বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী প্রচারণা চালায়। ফলে, ইউএনএইচসিআর রোহিঙ্গাদের জন্য তহবিল পাচ্ছে।
তিনি যোগ করেন, ‘সুতরাং, তারা (ইউএনএইচসিআর এবং অন্যান্য সংস্থাগুলো) রোহিঙ্গারা যেখানেই থাকুক সেখানেই সেবা দেওয়ার কথা।’
মোমেন জানান, সরকারি পরিকল্পনার আওতায় ১১ লাখ বা মোট রোহিঙ্গাদের এক দশমাংশকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হবে।
মন্ত্রী বলেন, ইউএনএইচসিআর বা অন্যান্য বিদেশি সহায়তা সংস্থা সেবা দিতে ব্যর্থ হলে সেক্ষেত্রে এই সমস্ত লোকদের দেখাশোনার জন্য মানবিক সহায়তা সংস্থাগুলো যে সহায়তা পাচ্ছে তার বাংলাদেশ তার দশ শতাংশ দাবি করতে পারে।
গত বছরের ডিসেম্বরে রোহিঙ্গাদের প্রথম ব্যাচ স্থানান্তর করার পর প্রায় ৪৪টি এনজিও শরণার্থীদের মানবিক সহায়তা দেওয়ার জন্য স্বেচ্ছায় এই দ্বীপে গিয়েছিল।
স্থানান্তরের পর ১ লাখ রোহিঙ্গার জন্য কীভাবে তহবিলের ব্যবস্থা করা হবে তা নিয়ে উদ্বেগ ছিল।
জাতিসংঘের দলটি সফরের সময় দ্বীপে কর্মরত স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এবং নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর পাশাপাশি সেখানে কর্মরত কয়েকটি এনজিও এবং ব্যবসায়ীদের সাথেও বৈঠক করে।
জাতিসংঘ টিমের সফরের তিন সপ্তাহ পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নয়জন বিদেশি দূতের ভাসানচর সফরের সুযোগ করে দেয়। তারা ছিলেন অস্ট্রেলিয়, কানাডা, তুরস্ক, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ফ্রান্স, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত বা প্রবীণ কূটনীতিক।
এই দূতদের বেশিরভাগই ভাসানেরচরের সুযোগ-সুবিধাগুলি নিয়ে গণমাধ্যমের কাছে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
বাংলাদেশ নৌবাহিনী ১ লাখ রোহিঙ্গার আবাসনের জন্য ৩১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ভাসানচরে আশ্রয়ন-৩ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে।
প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গা ২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নির্মম সামরিক অভিযান থেকে পালিয়ে এসে টেকনাফের উখিয়ায় আশ্রয় নেয়।