বাসস দেশ-৪১ : শেরপুরে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রতিরোধের আখ্যান

130

বাসস দেশ-৪১
প্রথম-প্রতিরোধ
শেরপুরে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রতিরোধের আখ্যান
শেরপুর, ৭ এপ্রিল, ২০২১ (বাসস) : মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে শেরপুর উজ্জল নাম। ভারত সীমান্তবর্তী এ জনপদের পরতে-পরতে রয়েছে মুক্তিসংগ্রামের বিভীষিকাময় ও গৌরবোজ্জল অতীত। যা নতুন প্রজন্মের কাছে অনেকটাই অজানা। আজ এখানে আমরা তুলে ধরবো শেরপুরে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রতিরোধের আখ্যান।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পরদিন ৮ মার্চ শেরপুরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এ পরিষদের সদস্য ছিলেন আনিসুর রহমান এমএনএ, নিজামউদ্দিন আহম্মেদ এমপিএ, এডভোকেট আব্দুস সামাদ, কমরেড রবি নিয়োগী, খন্দকার মুজিবর রহমান, আব্দুর রশীদ ও মুহম্মদ মুহসীন আলী। প্রায় একই সময়ে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এ কমিটিতে ছিলেন আমজাদ হোসেন, লুৎফর রহমান মোহন, মোজাম্মেল হক, আখতারুজ্জামান, গোলাম রহমান রতন, দুলাল দে বিপ্লব প্রমুখ। ২৩ মার্চ শহীদ দারগ আলী পৌরপার্ক মাঠে জনতার বিশাল সমাবেশে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আমজাদ হোসেন, মোজাম্মেল হক, আখতারুজ্জামান, লুৎফর রহমান মোহন প্রমুখ ছাত্র নেতৃবৃন্দ স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। গ্রামে-গঞ্জে চলতে থাকে মিটিং-মিছিল সমাবেশ। শেরপুর এবং থানা শহরগুলোতে প্রথম থেকেই আন্দোলন দানা বেঁধে উঠে।
২৫ মার্চের কালোরাতে ঢাকায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালীকে নির্বিচারে হত্যার খবর প্রচারিত হওয়ার সাথে-সাথে ২৬ মার্চ ভোর থেকে শেরপুর শহরের নিউমার্কেট মোড়ে উদ্বিগ্ন ও উত্তেজিত জনতার ভিড় জমতে শুরু করে। এখানে ঝিনাইগাঁতীর নকশী ক্যাম্পের ইপিআর ওয়্যারল্যাস সেটের ম্যাসেজের মাধ্যমে পাওয়া বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করে শোনানো হয়। সন্ধ্যায় শহীদ বুলবুল সড়কে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের অস্থায়ী কার্যালয়ের সম্মুখে ছাত্র জনতার বিশাল সমাবেশ ঘটে। সমাবেশ থেকে নেতৃবৃন্দ শত্রুর মোকাবিলায় বজ্রকঠিন প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য জনতার প্রতি আহ্বান জানান।
কোম্পানী কমান্ডার এ. এ. জাফর ইকবাল সম্পাদিত শেরপুরের মুক্তিযুদ্ধ গ্রন্থসূত্রে জানা যায়, ২৬ মার্চ থেকে ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত শেরপুর সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের কর্তৃত্তাধীন ছিল। শুরুতেই সংগ্রাম পরিষদ শত্রু বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যুহ গড়ে তোলার লক্ষ্যে ছাত্র-জনতার সামরিক প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সংগ্রহে মনোনিবেশ করেন। প্রথম পর্যায়ে ১২ জন টগবগে ছাত্রের একটি দলকে ভারতীয় সীমান্তের কাছে নকশী পাতার ক্যাম্পে অস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়। এরা হচ্ছেন- মমিনুল হক, আব্দুল ওয়াদুদ অদু, ফরিদুর রহমান ফরিদ, মোকছেদুর রহমান হিমু প্রমুখ।
২৭ মার্চ সংগ্রাম পরিষদের নের্তৃবৃন্দের বৈঠকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার প্রধান এবং প্রথম উপকরণ অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদের অপরিহার্যতার কথা আলোচনা করা হয়। এসময় ঝিনাইগাঁতীর নকশী ইপিআর ক্যাম্পসহ আশেপাশের ইপিআর ক্যাম্পগুলোতে চলছিল চরম উত্তেজনা। ঢাকার নৃশংস হত্যাকান্ডের খবর শুনে উত্তেজিত হয়ে পড়ে এলাকার সাধারণ মানুষ। তারা পাঞ্জাবী ইপিআর সদস্যদের তাদের হাতে তুলে দেওয়ার আহ্বান জানায়। তখন নকশী ইপিআর ক্যাম্পের সুবেদার ছিলেন আব্দুল হাকিম। তিনি প্রথমে মোট ২২ জন পাঞ্জাবী ইপিআর সদস্যকে ক্যাম্পের মসজিদে আটকে রাখেন। শেষ পর্যন্ত নিজে সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করতে পেরে এদের বিচারের ভার তুলে দেন জনতার আদালতে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এদের ঘন জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে অবশ্য ২ জন ইপিআর সদস্য পালিয়ে যায়। এদের একজন গারোকোণা এলাকায় জনতার হাতে ধরা পড়ে মৃত্যুবরণ করে। তবে, অপরজনের আর খোঁজ পাওয়া যায়নি।
এরপরই সুবেদার হাকিমকে নিয়ে গড়ে তোলা হয় ইপিআর, পুলিশ, মুজাহিদ ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনির সমন্বয়ে সম্মিলিত প্রতিরোধ বাহিনী। সুবেদার হাকিমের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রের ট্রেনিং শুরু হয়। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহেই প্রতিবেশী দেশ ভারতের কাছ থেকে সৌজন্যমূলক অস্ত্র পাওয়া যায়। সশস্ত্র বাহিনীর তত্ত্বাবধানে সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে এসব অস্ত্র হস্তান্তর করা হয় টাঙ্গাইলের মধুপুরে পাকবাহিনীর অগ্রযাত্রারোধে গঠিত প্রতিরোধ বাহিনীর কাছে। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে সুবেদার আব্দুল হাকিম আনসার মুজাহিদ ও ইপিআর সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত দলকে নিয়ে পাক বাহিনীর প্রতিরোধে মধুপুরে যান। কিন্তু দলটি ভারি অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানী বাহিনীর মোকাবিলা করতে না পেরে জামালপুরের দিকপাইতে প্রতিরোধ গড়ে তুলে। কিন্তু সেখানেও টিকতে না পেরে ব্রহ্মপুত্র নদ পেরিয়ে শেরপুরের চরাঞ্চলে অবস্থান নেয়। এ সময় টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ ও জামালপুর থেকে বিপুল সংখ্যক শরনার্থী ভারত সীমান্ত অতিক্রম করার জন্য শেরপুরে আশ্রয় নেয়। ২০ এপ্রিল হানাদার বাহিনী হেলিকপ্টার থেকে মারাত্মকভাবে প্রতিরোধ বাহিনীর উপর শোলিং করে। এতে ১৩ জন সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তি হতাহত হয়।
সুবেদার আব্দুল হাকিমের নেতৃত্বে প্রায় দুই প্ল্যাটুন ইপিআর ও আনসার মুজাহিদ সদস্যদের এ প্রতিরোধই ছিল শেরপুরে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রতিরোধ। যদিও সুসজ্জিত পাকহানাদার বাহিনীর অগ্রযাত্রা তখন প্রতিরোধ করা যায়নি। সুবেদার হাকিম তার দলবলসহ শেরপুর শহরে চলে আসেন। সেসময় যারা দেশত্যাগ করছে, তাদের নিরাপদে ভারতের মেঘালয়ে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নেন। মাইকযোগে এ ঘোষণা প্রচারিত হওয়ার পর ২২ এপ্রিল ভোর ৫ টা থেকে মুক্তিকামী শেরপুরবাসী ভারত অভিমুখে যাত্রা শুরু করে। ২৭টি বাসট্রাক যোগে শুরু হওয়া এ যাত্রা ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। এসময় শেরপুর প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়ে। অধিকাংশ হিন্দু ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের মেঘালয় রাজ্যে আশ্রয় নেয়। অনেকে নিভৃত গ্রামগঞ্জে আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে ঠাঁই নেয়।
২৭ এপ্রিল ১৯৭১ পাক হানাদার বাহিনী কোন ধরনের বাঁধা ছাড়াই পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ পাড়ি দিয়ে গুলি করতে-করতে শেরপুর শহরে প্রবেশ করে। অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও হত্যার মাধ্যমে শেরপুর দখলে নিয়ে ঘাঁটি স্থাপন করে নয়ানী জমিদার বাড়িতে। এ দিন শহীদ হন-রঘুনাথ বাজারের রুটি বিক্রেতা আহমদ আলী, শনি বিগ্রহ মন্দিরের পুরোহিত সুব্রত ভট্টাচার্য, মুচকুন্দ দুবে, ফটিক মালাকারসহ নাম না জানা অনেকে। এক সপ্তাহের মধ্যেই হানাদার বাহিনীর প্রতিটি থানা সদরসহ সীমান্ত চৌকিগুলোতে শক্ত ঘাঁটি স্থাপন করে। আহমদনগর ছিল পাকহানাদারদের সেক্টর হেডকোয়ার্টার।
শেরপুর ছিল ১১ নং সেক্টরের অধীন। স্বাধীনতা যুদ্ধের দীর্ঘ ৯ মাস জেলার বর্তমান ৫টি উপজেলার ৩০/৪০টি এলাকায় ছোট-বড় যুদ্ধ হয়েছে। এসমস্ত যুদ্ধে বীরত্বের সংগে লড়াই করে জীবন দিয়েছেন ৮৪ জন বীর সন্তান। পাক হানাদারদের নির্মমতার শিকার হয়ে শহীদ হয়েছেন অসংখ্যা নিরীহ মানুষ। একাত্তরের ২৫ জুলাই নালিতাবাড়ী উপজেলার কাকরকান্দি ইউনিয়নের সোহাগপুর গ্রামে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ১৮৭ জন নারীÑপুরুষ, শিশুসহ নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করা হয়। শ্রীবরদীর জগৎপর গ্রামে পাকবাহিনী তাদের এদেশীয় দোসরদের সহায়তায় নারকীয় তান্ডব চালিয়ে হত্যা করে ৬১ জন নিরীহ গ্রামবাসী ও গ্রামে আশ্রয় নেওয়া মানুষদের। ২৪ নভেম্বর সদর উপজেলার সূর্যদী গ্রামে গণহত্যা ও প্রতিরোধ যুদ্ধে এক মুক্তিযোদ্ধাসহ শহীদ হন ৬৯ জন। স্বাধীনতা যুদ্ধে অনন্য অবদানের জন্য এ জেলার একজন বীর বিক্রম, দুইজন বীর প্রতীক উপাধি পেয়েছেন। এরা হলেন-শহীদ শাহ মুতাসীম বিল্লাহ খুররম বীর বিক্রম, কমান্ডার জহুরুল হক মুন্সি বীর প্রতীক ও ডা. মাহমুদুর রহমান বীর প্রতীক।
বাসস/এনডি/বি.প্র./ সংবাদদাতা/কেজিএ/১৮২০/আরজি