বাসস দেশ-১৫ : মুক্তিযুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধে পাবনা জেলা

88

বাসস দেশ-১৫
মুক্তিযুদ্ধ-পাবনা
মুক্তিযুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধে পাবনা জেলা
\ রফিকুল ইসলাম সুইট \
পাবনা, ২৮ মার্চ, ২০২১ (বাসস) : মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাথে পাবনা শহরে প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ। ২৮ ও ২৯ শে মার্চ টানা দুইদিন ধরে সংঘটিত সেই যুদ্ধে পাবনায় অবস্থানরত প্রায় ২ শত পাকসেনাদের হত্যা করা হয়েছিল। পাবনা শত্রু মুক্ত ছিল ১৪ দিন।
২৫ মার্চ গভীর রাতে শ’দুয়েক পাকসেনার একটি সুসজ্জিত বহর পাবনা শহরে এসে ঢুকে সার্কিট হাউসের সামান্য দূরে ওয়াপদা কলোনিতে এসে তাদের হেডকোয়ার্টার বানাল। সেই রাতেই তারা ২০/২৫ জনের একটি গ্রুপ অত্যন্ত সুসজ্জিত অবস্থায় গিয়ে পুরাতন টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ভবন দখলে নিয়ে পাবনার অভ্যন্তরীণ এবং বাইরে যোগাযোগের সব টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিল। জেলা পরিষদের রেস্টহাউস দখলে নিয়ে সেখানে বানিয়েছিল টর্চার সেল। শহরের বিভিন্ন স্থানে অবস্থান করেছিল পাক বাহিনী।
২৬ মার্চ ভোর থেকে স্থানীয় তথ্য অফিসের গাড়ী সেনা প্রহরায় শহরে প্রচার শুরু করেছে। কার্ফ্যু আইন জারী করা হয়েছে। সকাল থেকে পৈশাচিক আক্রমণ শুরু করল পাবনার সাধারণ মানুষের ওপর। সন্ধ্যায় তারা পাবনার স্থানীয় জামাতিদের সহায়তায় কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা যেমন এমপিএ এডভোকেট আমিন উদ্দিন আহমেদ, ভাসানী ন্যাপ নেতা দন্ত চিকিৎসক অমলেন্দু দক্ষিস, তৃপ্তি নিলয় হোটেলের মালিক সাঈদ তালুকদারসহ কয়েকজনকে নিজ নিজ বাসা থেকেই ধরে নিয়ে যায়। বাকি নেতারা আগে থেকেই অন্যত্র আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় আর কোনো রাজনৈতিক নেতাকে তারা গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
২৭ মার্চ সন্ধ্যা। সবে মাগরিবের আজান শেষ হয়েছে। হঠাৎ করেই আর্মি ট্রাক অস্ত্রসজ্জিত অবস্থায় এসে পাবনা পুলিশ লাইন আক্রমণ এবং পুলিশ অফিসের একজন গার্ডকে গুলি করে বসে। জেলখানা, হেডপোস্ট অফিস, রেজিস্ট্রি অফিস এবং জজ কোর্টেও ছাদে পুলিশ ও ছাত্র তরুণরা অস্ত্র রাস্তার দিকে তাক করে ছাদে শুয়েছিলেন। আর্মির ট্রাক দেখামাত্র চতুর্দিক থেকে গুলি। দিশেহারা হয়ে আর্মি ট্রাক যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকেই পালাল। পুলিশের একজন অপারেটর শহীদ হলেন আর্মি যারা মারা গেল তাদের লাশ নিয়েই ট্রাকটি দ্রুতবেগে চলে গেল। রাতে তারা আর আসেনি।
২৮ মার্চ ভোররাতে পাকহানাদার বাহিনী পাবনা পুলিশ লাইন আক্রমণ করে। পাবনার অকুতোভয় পুলিশ বাহিনী জীবন বাজী রেখে পাকহানাদার বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করে। পুলিশ লাইনের যুদ্ধে পুলিশ বাহিনীর সাথে পাবনার ছাত্র-জনতা রফিকুল ইসলাম বকুলের নেতৃত্বে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। অস্ত্রাগারের দরজা খুলে দেয় আর আই। এ সময় জেল খানার দরজাও খুলে দেয়া হয় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। বিপুল পরিমাণ ক্ষতি স্বীকার করে পাকবাহিনী পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। পাক হানাদার বাহিনী পুলিশ লাইন থেকে পিছুহটে তাড়াশ ভবন সংলগ্ন টেলিফোন একচেঞ্জে এসে পজিশন নেয়। সকাল ৯টায় সময় রফিকুল ইসলাম বকুলের নেতৃত্বে পাবনার ছাত্র-জনতা ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যগণ টেলিফোন একচেঞ্জে অস্থানরত পাকহানাদার বাহিনীর উপর আক্রমণ চালায়। এই যুদ্ধে ২৮ পাক হানাদার মৃতুবরণ করে এবং কিছু সংখ্যক পাকহানাদার গুলি করতে করতে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে চলে যায়। পাবনা শহরের ময়লাগাড়ী নামক স্থানে পাক হানাদার বাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী জনতার যুদ্ধ সংগঠিত হয়। সেখানে বেশ কয়েকজন পাকহানাদার বাহিনীর সদস্য নিহত হয়।
২৮ মার্চ টেলিফোন একচেঞ্জ দখল করার পর একই দিন লস্করপুর (বর্তমান বাস টার্মিনাল) চেকপোস্ট আক্রমণ, বালিয়াহালট গোরস্থানে যুদ্ধ, সার্কিট হাউস এবং বিসিকে অবস্থানরত পাকসেনাদের ওপর আক্রমণ করে পাকসেনাকে হত্যা করা হয়। লস্করপুর যুদ্ধে শহীদ হন বুলবুল (যার নামে সরকারি শহীদ বুলবুল কলেজ নামকরণ), ফুনু, মুকুল এবং আফসার।
২৯ মার্চ বিসিক শিল্পনগরী আক্রমণ, মালিগাছা যুদ্ধ এবং দাপুনিয়া মাধপুরে পলায়নরত পাকসেনাদের উপর আক্রমণ করে প্রায় ৯০ জন পাকসেনাকে হত্যা করা হয়। পাবনার প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধে পাক মেজর আসলামসহ প্রায় ২ শত সৈন্য নিহত হন। মালিগাছা যুদ্ধে আটঘরিয়া থানার দারোগা আব্দুল জলিল শহীদ হন। মাধপুর, দাশুড়িয়া, ঈশ্বরদী, লালপুর পর্যন্ত প্রতিরোধ যুদ্ধে প্রায় ১২ জন বীর জনতা শহীদ হন। বিসিক মুক্ত হবার পর পাকসেনাদের হাতে আটক সংসদ সদস্য এডভোকেট আমিন উদ্দিন, ন্যাপ নেতা ডা. অমলেন্দু দক্ষিস, সাঈদ তালুকদার, রাজন পাগলসহ অজ্ঞাত অনেক নারী ও পূরুষের গলিত অর্ধ গলিত লাশ পাওয়া যায়।
২৯ মার্চ পাবনা প্রথম জেলা হিসেবে হানাদার মুক্ত হয়। ১১ এপ্রিল পর্যন্ত পাবনা শত্রু মুক্ত থাকে।
বাসস/এনডি/বি.প্র./সংবাদদাতা/১৫৩৫/কেজিএ/আরজি