চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ ২৫ মার্চ রাতে

471

চট্টগ্রাম, ২৫ মার্চ, ২০২১ (বাসস) : মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ হয় বিপ্লবের তীর্থ স্থান চট্টগ্রামে ২৫ মার্চ রাত ৯ টায় ক্যাপ্টেন রফিকের নেতৃত্বে। মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান ডা. মাহফুজুর রহমান দাবি করেন, এটিই পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালি সেনাদের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ।
‘মরার আগে মারতে হবে’ অথবা ‘আঘাতের আগেই প্রতিঘাত’ এ মন্ত্রেই চট্টগ্রামে অবস্থানরত বাঙালি সেনা কর্মকর্তা ও সৈন্যদেরকে উজ্জীবিত করার প্রয়াস ছিল ক্যাপ্টেন রফিকের। মূলতঃ সিনিয়র জুনিয়র অফিসার ও সৈন্যদের মধ্যে এ মানোবল গড়ে তুলতে তিনি ধারাবাহিকভাবে চেষ্টা চালান। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ, তাঁদের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা নিয়ে আসা এবং বিভিন্ন সাংকেতিক বাক্যের মাধ্যমে বাঙালি সেনাদের চূড়ান্ত প্রস্তুতি ও যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার রণকৌশল ঠিক করতে ব্যস্ত সময় পার করেন তিনি।
সে সময়ে নগরীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার (ইবিআরসি) ও অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টে বাঙালি সৈন্য ছিল ২ হাজার, আর পাকিস্তানি ছিল ৫শ’। সেনাবাহিনীতে বেশ কিছু বাঙালি অফিসার ছিলেন। বিশেষ করে ব্রিগেড কমান্ডে ছিলেন বাঙালি ব্রিগেডিয়ার মজুমদার, ইবিআরসি’তে ছিলেন লে. কর্নেল চৌধুরী। কিন্তু বাঙালি অফিসার ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে অপসারণ করা হলে অন্য অফিসাররা সময়মতো সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হন। চার গুণ বেশি ফোর্স থাকা সত্ত্বেও সেনানিবাসের দখল বাঙালিদের হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার এটি অন্যতম কারণ।
একাত্তরের মার্চে স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্দীপ্ত সারাদেশের মানুষ। আন্দোলন সংগ্রাম ছড়িয়ে পড়ে আনাচে-কানাচে। কিন্তু বন্দর নগরী, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের গতিশীলতায় চট্টগ্রাম মুক্তি সংগ্রামের অন্যতম নির্ভরতার প্রতীক হয়ে ওঠে। উপরন্তু, ২৪ মার্চ সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাসের ঘটনা এবং ছাত্র-জনতার সশস্ত্র প্রতিরোধ ও গুলিতে বেশ কিছু মানুষের প্রাণহানিতে প্রতিবাদী জনতার রোষ আরো বেড়ে যায়। ঐদিন উত্তাল জনতার প্রতিরোধ ভাঙতে গিয়ে পাক বাহিনীর নির্বিচারে গুলিতে অসংখ্য মানুষ নিহত হন। ডক শ্রমিকরা অস্ত্র খালাসে অস্বীকৃতি জানালে বেঙ্গল রেজিমেন্টের নবাগতদের এ দায়িত্ব দেয়া হয়। ঐ রাতে ব্রিগেডিয়ার আনসারির তত্ত্বাবধানে সোয়াতের অস্ত্র খালাস শুরু হলে ক্যাপ্টেন রফিক, লে. কর্নেল এম আর চৌধুরী ও মেজর জিয়াউর রহমান বৈঠকে বসেন। কিন্তু বাঙালি সৈন্যদের বিদ্রোহের ব্যাপারে তারা একমত হতে পারেননি।
হালিশহর ইপিআর ক্যাম্পে ক্যাপ্টেন রফিকের সিনিয়র অবাঙালি অফিসার মেজর ইকবাল চেষ্টা করেন ২৫ মার্চ সকালেই ক্যাপ্টেন রফিককে ছুটি দিয়ে দেবেন। বিষয়টি রফিকও বুঝতে পারেন। ফলে, ছুটি না নিয়ে তিনি কর্মস্থলে থেকে ঘনিষ্ঠভাবে পরিস্থিতি বুঝতে চেষ্টা করেন। অবস্থার দ্রুত অবনতি উপলব্ধি করে ক্যাপ্টেন রফিক বিকেলে আওয়ামী লীগ নেতা ডা. আবু জাফরের সাথে সাক্ষাত করেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা না থাকায় কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া যায়নি। তবে ডা. জাফর রাত আটটার দিকে ক্যাপ্টেন রফিককে জানান, ঢাকার অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। পাকিস্তানি বাহিনী সারা ঢাকা শহরে টহল দিচ্ছে এবং সম্ভবত খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে। এ খবর জেনে ক্যাপ্টেন রফিক আওয়ামী লীগ নেতা এম আর সিদ্দিকী ও ডা. জাফরের সাথে দেখা করেন। এ বৈঠকেই রফিক পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রথমেই আঘাত করার সিদ্ধান্ত নেন।
মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান ডা. মাহফুজুর রহমান জানান, ক্যাপ্টেন রফিক রাত ৮ টা থেকে ৯ টার মধ্যে টেলিফোনে তার সাথে মতৈক্যের অফিসারদের চূড়ান্ত প্রস্তুতির কথা জানিয়ে দেন। ডা. জাফরকে পাঠানো হয় ষোলশহর ক্যান্টনমেন্টের বাঙালি অফিসারদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য। রাত পৌনে নয়টায় রফিক রওয়ানা হন ওয়্যারলেস কলোনি অভিমুখে। সেখানে পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন হায়াত ও সুবেদার হাসমতের অধীনে এক প্লাটুন ইপিআর সেল ছিল। ক্যাপ্টেন রফিকের নেতৃত্বে এখানে অভিযানে পাক অফিসার ও সেনাদের নিরস্ত্র করে বন্দী করা হয়। রাত ৯ টার একটু পর ওয়্যারলেস কলোনির অবস্থানে পাক বাহিনী প্রথম আক্রান্ত হয়। ওয়্যারলেস সেন্টার দখল করার পর ক্যাপ্টেন রফিক রাত সাড়ে নয়টার দিকে যান হালিশহরস্থ ইপিআর ক্যাম্প দখল করতে। এর মধ্যে রফিকের সাংকেতিক বার্তা পেয়ে বাঙালি সেনারা হালিশহর ক্যাম্পের তিনটি অস্ত্রাগার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এলে বাঙালিদের হাতে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র চলে আসে। বাঙালি সেনারা পুরো ক্যাম্প এলাকা দখল করে অবাঙালি সেনাদের পালানোর পথ বন্ধ করে দেন। কেননা, ক্যাম্পের আশেপাশের এলাকা ছিল অবাঙালি অধ্যুষিত। কোনো কারণে এসব এলাকায় খবর গেলে তারাও সেনাদের সাথে যোগ দিতে পারতো। হালিশহর ইপিআর ক্যাম্পে সে সময় অধিকাংশ জুনিয়র অফিসার ছিল অবাঙালি। এর কিছুদিন আগেই ইপিআর কমান্ডার লে. কর্নেল আবদুল আজিজ বাঙালি জুনিয়র অফিসারদের সীমান্তে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। রাত ১১ টার মধ্যে পাকিস্তানি প্রায় তিনশ’ সেনা ও কর্মকর্তাকে বন্দী করে ফেলেন ক্যাপ্টেন রফিক ও তার বাহিনী।
ক্যাপ্টেন রফিক সিআরবিস্থ রেলওয়ে হিলে তার সদর দফতর স্থাপন করেন। হালিশহর ক্যাম্প থেকে ১০০ সৈন্যকে ভাগ করে বিভিন্ন মোড়ে পাঠানো হয় পাকিস্তানিদের প্রতিরোধের জন্য। দুই প্লাটুন যায় সমুদ্র উপকূলীয় বাঁধ এলাকায়। এক প্লাটুন দায়িত্ব নেয় রেলওয়ে হিল প্রতিরক্ষায়। ক্যাপ্টেন রফিকের কমান্ডেই এসব কর্মকা- পরিচালিত হয়। আধা ঘণ্টার মধ্যে পরিকল্পনা অনুযায়ী এসব নির্দেশনা দিয়ে ১১ টা ৪০ মিনিটে তিনি রেলওয়ে হিলের সদর দপ্তরে অবস্থান নেন। কিন্তু এ রাতেই বিমানবন্দরে ইপিআর-এর বাঙালি সৈন্যরা গ্রেপ্তার হয়ে যান।
২৫ মার্চ রাত সোয়া ১১ টায় অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টের পাক কমান্ডিং অফিসার জানজুয়া এক প্লাটুন সৈন্য নিয়ে মেজর জিয়াকে একটি ট্রাকে করে বন্দরে অস্ত্র খালাস অভিযানে পাঠান। পথে জনতার প্রতিরোধ ও ব্যারিকেডের কারণে যেতে বিলম্ব হচ্ছিল। এর মধ্যে মেজর রফিকসহ বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের অনেকেই এ খবর জেনে যান। জনতার বাধা উপেক্ষা করে জিয়া ব্যারিকেড সরিয়ে বন্দরের দিকে এগুতে থাকলে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান দ্রুত জিয়াকে বাঙালি সৈন্যদের বিদ্রোহের খবর জানান। ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান এও বলেন যে, সোয়াত জাহাজে জিয়াকে পাঠানো একটি মৃত্যুফাঁদ। ওখানে গেলে তাকে আর জীবিত ফেরত পাঠানো হবে না। পরে এ আশঙ্কাই সত্যি হতে দেখা যায়। ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানের কাছে ঘটনাপ্রবাহ জেনে জিয়া ক্যান্টনমেন্টে ফিরে আসেন এবং পরে বিদ্রোহ করে যুদ্ধে যোগ দেন।
যেসব বাঙালি অফিসার ও সেনা সদস্য ২৪ মার্চ হতে অস্ত্র খালাসের দায়িত্ব পালন করেছেন তাদেরকে আর ফিরে আসতে দেয়া হয়নি। ২৭ মার্চ বিকেল চারটায় এ বাঙালি সেনাদের জেটির প্ল্যাটফরমে দাঁড় করিয়ে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরও যাদের জীবিত মনে হয়েছে তাদেরকে বেয়োনেটে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারা হয় এবং লাশ কর্ণফুলীতে ফেলে দেয়া হয়। নায়েক সুবেদার তৈয়ব ও নায়েক সুবেদার নুরুল ইসলাম তখনও বেঁচে ছিলেন এবং গুরুতর আহতাবস্থায় কোনো রকমে সাঁতরে নদী পার হন।
আওয়ামী লীগ নেতা এম আর সিদ্দিকী ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় টেলিফোনে কাপ্তাইয়ে ক্যাপ্টেন হারুনকে বিদ্রোহের চূড়ান্ত সাংকেতিক বাক্য ‘আমার জন্য কিছু কাঠ আনো’ জানিয়ে দেন। হালিশহর ক্যাম্পের ইপিআর এডজুট্যান্ট ক্যাপ্টেন রফিক ৬ মার্চ বাঙালি জুনিয়র অফিসারদের নিয়ে একটি গোপন বৈঠক করেন। বৈঠকে বিভিন্ন শলা-পরামর্শের সাথে তিনি দু’টি সাংকেতিক বাক্য জানিয়ে দেন। এক. ‘আমার জন্য কিছু কাঠের ব্যবস্থা করো’ অর্থাৎ পাকিস্তানিদের আক্রমণের প্রস্তুতি নাও। দুই. ‘আমার জন্য কিছু কাঠ আনো’ অর্থাৎ পশ্চিমাদের খতম করে শহরের দিকে এগিয়ে আসো। এম আর সিদ্দিকীর বার্তা পেয়ে মেজর পীর মোহাম্মদ, ক্যাপ্টেন জায়েদীসহ সব পাকিস্তানি সেনাকে নিরস্ত্র করে ক্যাম্পের দখল নেন ক্যাপ্টেন হারুন। রাত সাড়ে তিনটার দিকে বাঙালি সেনাদের নিয়ে ক্যাপ্টেন হারুন চট্টগ্রাম শহরের দিকে রওয়ানা হন। তারা কালুরঘাট পৌঁছালে সেখানে অবস্থানরত মেজর জিয়া তাকে সব সৈন্যসহ সেখানে রেখে দেন। এমনকি, ক্যাপ্টেন রফিকের পরামর্শে তার সাথে যোগ দিতে যাচ্ছেন জানালেও ক্যাপ্টেন হারুনকে আসতে দেননি মেজর জিয়া। ফলে, পথিমধ্যে বাঙালি সৈন্যদের একটি বহর আটকে যায়। শহরে ক্যাপ্টেন রফিক দুর্বল হয়ে পড়েন। ফলে, সৈন্য ও অস্ত্রের অভাবে যুদ্ধ নিয়ে আগে থেকে এঁকে রাখা ছকে আর এগোতে পারেননি রফিক।
২৫ মার্চ রাতে ক্যান্টনমেন্টে ঘটে অত্যন্ত মর্মান্তিক ঘটনা। বাঙালি অফিসার লে. কর্নেল এম আর চৌধুরী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি আর নির্দেশ দিতে পারেননি। ক্যাপ্টেন এনামুল হক ছিলেন ক্যান্টনমেন্টে। রাত সাড়ে ১১ টায় মেজর শওকত ব্রিগেডিয়ার আনসারির নির্দেশের উল্লেখ করে ইবিআরসি’র গাড়িগুলো তার কাছে পাঠিয়ে দিতে বলেন। মেজর শওকত জানান, ব্রিগেডিয়ার আনসারি তাকে গাড়িগুলোতে সৈন্য নিয়ে বন্দরে যেতে বলেছেন। কিন্তু গাড়ি পাঠানোর আগেই এনাম টেলিফোনে ঢাকার বর্বরোচিত পাক নৃশংসতার খবর পান। এনাম কর্নেল এম আর চৌধুরীকে ঢাকার অবস্থা জানালে তিনি বাঙালি সৈন্যদের অস্ত্র নিয়ে দ্রুত অবস্থান নিতে নির্দেশ দেন। কিন্তু তার আগেই বেলুচ রেজিমেন্ট সেনানিবাসে হামলা চালিয়ে বাঙালি অফিসারদের বন্দী করে ফেলে।
ডা. মাহফুজুর রহমানের ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম’ গ্রন্থে বেলুচ রেজিমেন্ট এ সময় কর্নেল চৌধুরীসহ প্রায় এক হাজার সৈন্যকে হত্যা করে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ হামলায় ট্যাংক, মর্টারসহ ভারী সব অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল। সারারাত নিধনযজ্ঞ চলে। শুধুমাত্র সময়ক্ষেপণ ও সিদ্ধান্তহীনতার কারণে এ সেনানিবাসের দু’হাজার বাঙালি সৈন্য হত্যা অথবা গ্রেপ্তারের শিকার হন। কিছু সংখ্যক সৈন্য ও কয়েকজন অফিসার পালিয়ে আসতে পেরেছিলেন।
সেনানিবাস বাঙালিদের হাতছাড়া হয়ে গেলে পাক সেনারা আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ২৬ মার্চ উপকূল এলাকা হয়ে হালিশহর ইপিআর ক্যাম্প দখল করতে গেলে বাঙালি সৈন্যদের এমবুশে পড়ে। এ লড়াউয়ে বহু পাক সেনা মারা যায়। একটি অংশ গ্রামে ঢুকে পড়লে জনতা তাদের পিটিয়ে মেরে ফেলে। এদিন ঢাকা থেকে আরো পাক সেনা আনা হয়। তারা হালিশহর ও আগ্রাবাদ অভিমুখে এগোতে থাকে। একই সময়ে নৌবাহিনীর জাহাজ থেকে ক্যাপ্টেন রফিকের রেলওয়ে হিল কার্যালয়ে আক্রমণ শুরু হয়। অন্যদিকে, স্থলপথে অগ্রসরমাণ পাক সেনারা রেলওয়ে হিল ঘিরে ফেলে। এখানে দীর্ঘক্ষণ যুদ্ধ চলে। কিন্তু রণকৌশল হিসেবে ক্যাপ্টেন রফিক সৈন্যদের সরে যেতে বলেন। তিনি নিজেও রেলওয়ে হিল ছেড়ে যান।
একই দিন বিকেল ৫ টায় ক্যাপ্টেন এমএস ভুঁইয়া ১০২ জন সৈন্য নিয়ে বিকেল ৫ টার দিকে কুমিরার দিকে রওয়ানা হন। সন্ধ্যা ৬ টায় কুমিরায় পৌঁছে সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান নেন। তাদের অবস্থানের এক পাশে ছিল সাগর, আরেক পাশে পাহাড়। এর এক ঘণ্টা পরই এ আস্তানা থেকে পাক বাহিনীর ওপর প্রথম আক্রমণ চালানো হয়। এ যুদ্ধে কমান্ডিং অফিসার একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল ও একজন লেফটেন্যান্টসহ ১৫২ জন পাক সেনা নিহত হয়। ১৪ বাঙালি সেনা শহীদ হন। তিন ট্রাক অস্ত্র ফেলে পালিয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনী। পরে নৌ সেনাদের সহায়তায় পাক সেনারা বাঙালি সৈন্যদের হটাতে সক্ষম হয়।
কুিমরায় পরাজয়ের পর পাকিস্তানিদের মনোবল ফিরিয়ে আনার জন্য পাক নৌবাহিনী কুমিরা টার্পেট করে মর্টার শেল ও কামান দাগানো শুরু করে। ঢাকা থেকে বিশেষ বিমানে কমান্ডো ব্যাটালিয়ন আনা হয়। এদিন পাকিস্তানি জিওসির হেলিকপ্টারে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলি লাগলে হেলিকপ্টারটি ঢাকা ফিরে যায়।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর কাছে একটি ওয়্যারলেস বার্তা আসে। আওয়ামী লীগ নেতাদের রুদ্ধধার বৈঠক তখনও চলছিল। বৈঠকেই জহুর আহমদ চৌধুরীর হাতে বার্তাটি পৌঁছে দেয়া হয়। এটাই ছিল বহুল কাঙ্খিত বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা। মুহূর্তেই বৈঠকের পরিবেশ বদলে যায়। নেতৃবৃন্দ সিদ্ধান্ত নেন দ্রুততম সময়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর এ ঐতিহাসিক ঘোষণা চারিদিকে ছড়িয়ে দিতে হবে। বার্তাটি সাইক্লোস্টাইল মেশিনে ছাপিয়ে লিফলেট আকারে ছাত্রলীগ বিলি করার কাজে নেমে পড়ে। কেউ কেউ মাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়েন বার্তাটি প্রচারের উদ্দেশ্যে। ২৫ মার্চ রাতে ওয়্যারলেস বার্তাটির ব্যাপারে পাকিস্তান সেনা কর্মকর্তা সিদ্দিক সালেহ তার ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন। ওয়্যারলেসে পাঠানো বঙ্গবন্ধুর বার্তাটি জহুর আহমদ চৌধুরীর বাসভবনে এখনো রক্ষিত আছে।
২৬ মার্চ চট্টগ্রামকে চারটি জোনে ভাগ করে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন সেক্টরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। শহর এলাকার দায়িত্ব নেন জহুর আহমদ চৌধুরী, এম এ মান্নান ও আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। কালুরঘাট সেক্টরের দায়িত্ব নেন এমএ হান্নান, আতাউর রহমান খান কায়সার, ডা. এমএ মান্নান ও ডা. আবু জাফর। চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় সেক্টরের দায়িত্ব নেন এমএ ওহাব। শুভপুর সেক্টরের দায়িত্ব নেন ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন।
২৬ মার্চ এম আর সিদ্দিকীর আমবাগানের বাসায় জরুরি বৈঠক ছিল। কিন্তু নিরাপত্তার কথা ভেবে জহুর আহমদ চৌধুরী, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী এ বৈঠকটি পাথরঘাটা বান্ডেল রোডে আখতারুজ্জামান বাবুর বাসায় স্থানান্তর করেন। এ বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা বেতারে প্রচারের সিদ্ধান্ত হয়।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে এম আর সিদ্দিকী, জহুর আহমদ চৌধুরী, এমএ হান্নান, এমএ মান্নান ও অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদকে নিয়ে একটি সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। ঢাকায় ২৩ মার্চ এক বৈঠকে এম আর সিদ্দিকীকে চট্টগ্রাম কব্জায় রাখার নির্দেশ দেন বঙ্গবন্ধু।
২৪ মার্চ সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাসের খবরে ভীতির বদলে আরো উত্তাল হয়ে ওঠে চট্টগ্রাম। বিক্ষোভে ফেটে পড়ে মানুষ। জীবন বাজি রেখে হাজার হাজার মানুষ দেওয়ানহাট থেকে বন্দর পর্যন্ত ব্যারিকেড সৃষ্টি করে। অন্যদিকে বাঙালি-বিহারি দাঙ্গার জের ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। যুদ্ধের আগে থেকে শুরু বাঙালি-বিহারি-অবাঙালি ত্রিমুখী এ রক্তক্ষয়ী সংঘাত অনেকদিন অব্যাহত থাকে।