একাগ্রতা ও উদ্যম মানসিকতায় এগিয়ে যাওয়া এক প্রতিভা দৃষ্টিহীন চাঁদনী

452

ঢাকা, ১৫ মার্চ, ২০২১ (বাসস) : পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করা প্রতিটি মানুষই মেধাবী। দৃষ্টিহীন কিংবা অন্য কোনভাবে ব্যতিক্রমী হলেও কেউই সমাজের বাইরে নয়। সবাই কোন না কোনভাবে সমাজে অবদান রাখতে পারে। এ জন্য প্রয়োজন কেবলমাত্র তার মধ্যে ইচ্ছা, একাগ্রতা ও মানসিকতা। একাগ্রতা ও লক্ষ্যের সাথে উদ্যম মানসিকতা থাকলে কোন কিছুই ব্যক্তিকে দমিয়ে রাখতে পারেনা। তেমনই একাগ্রতা, লক্ষ্য ও মানসিকতা নিয়ে এগুচ্ছে এক প্রতিভা দৃষ্টিহীন চাঁদনী। পুরো নাম তাবাসসুম ফেরদৌসী চাঁদনী।
হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলার নিজগ্রাম গ্রামের আব্দুল ওয়াহিদের মেয়ে। জন্মের পর থেকে পৃথিবীর আলো দেখতে পায়নি চাঁদনী। তবে এ সীমাবদ্ধতা তাকে দমাতে পারেনি। নিজে দৃষ্টিহীন হলেও স্বপ্ন দেখেন অন্যকে পথ দেখানোর।
জেএসসি পরীক্ষার মাত্র তিন দিন আগে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম পিতার ক্যান্সার ধরা পড়ার খবরে এক মুহুর্তের জন্য থমকে যাওয়া পৃথিবীটাকে নিজের মানসিক শক্তি দিয়ে জয় করে নিয়েছিলেন চাঁদনী। প্রতিকুল অবস্থার মধ্যেও পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ভাল ফল করে গর্বিত করেছেন তার শিক্ষক-শিক্ষিকা ও পরিবারকে। এখন তার স্বপ্ন আরো লেখাপড়া করে শিক্ষক হওয়া। তার মতো দৃষ্টিহীনদের শিক্ষার আলোয় পথ দেখাতে চান তিনি।
হবিগঞ্জের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা চাঁদনীর পিতা আনসার-ভিডিপি সদস্য। পরিবারের তিন ভাইবোনের মধ্যে সে বড়। বাকি দুইভাইও লেখাপড়া করছে। টানাটানির সংসারে যখন লেখাপড়ার ব্যয় চালানো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়, তখন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী চাঁদনীর দায়িত্ব নেয় সিলেটে প্রতিবন্ধীদের সংগঠন ‘গ্রিণ ডিজেবল ফাউন্ডেশন’। এই সংগঠনের আবাসিক ছাত্রী হিসেবে শিশু শ্রেণী থেকে শিক্ষা জীবন শুরু তার। এরপর আর চাঁদনীকে পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। মেধাবী চাঁদনী প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীতে ৪ দশমিক ৮ ও জেএসসি পরীক্ষায় ৪ দশমিক ১১ পেয়ে এখন নবম শ্রেণীর ছাত্রী।
স্বপ্নের কথা জানতে চাইলে চাঁদনী বলেন, আমার ইচ্ছা আমি ব্রেইলের শিক্ষক হবো। যারা আমার মত দৃষ্টিহীন আমি তাদের শিক্ষার জন্য কাজ করতে চাই। নিজের শিক্ষকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে চাঁদনী বলেন, স্যারেরা না থাকলে আমার এতদূর আসা সম্ভব হতো না। এখনো অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। যেখানে আমার শিক্ষকরাই আমার অভিভাবক। তারা আমাকে পথ দেখান।
লেখাপড়ার পাশপাশি গান, আবৃতিতেও যুক্ত চাঁদনী। তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ গ্রিন ডিজেবল ফাউন্ডেশনের নির্বাহি পরিচালক বায়েজিদ খান। তিনি বলেন, যখন আমরা মেয়েটির বাবার ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার খবর পেলাম তখন ভাবিনি সে পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে সে পরীক্ষায় অংশ নেয় এবং ভাল ফল করে। এটা সত্যিই আমাদের জন্য গর্বের। তবে জিপিএ ৫ না পাওয়ায় কিছুটা আক্ষেপ আছে চাঁদনী যে ধরনের ছাত্রী তাতে সে জিপিএ ৫ পেতোই।
এই প্রতিষ্ঠানে চাঁদনীর সঙ্গী আরো ৯ জন। তাদের সবার সাথেই চাঁদনীর সম্পর্কটা পরিবারের সদস্যদের মতো। একই সঙ্গে লেখাপড়ার পাশাপশি দৈনিন্দিন কাজে সকলে একে অন্যের সহচর।
প্রতিষ্ঠানের নির্বাহি পরিচালক বায়েজিদ খান জানান, চাঁদনীসহ ১০ জন আবাসিক শিক্ষার্থীর জন্য এখানে চারজন শিক্ষক-শিক্ষিকা ও একজন মাওলানা রয়েছেন। এ ছাড়া একজন সঙ্গীত শিক্ষক নিজ উদ্যেগে এসে তাদের গান শেখান। বিভিন্ন ব্যক্তির অনুদানে এখানে তাদের খাওয়া-দাওয়াসহ যাবতীয় খরচ চলে। সরকার থেকেও কিছু অর্থ পাওয়া যায়। তবে প্রয়োজনের তুলনায় তা অপ্রতুল। যে কারণে বিভিন্নভাবে অনুদানের অর্থ যোগাড় করেই তাদের খেলাপড়াসহ যাবতীয় খরচ মেটাতে হয় সংস্থাটিকে।