বাইডেনকে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাংলাদেশ থেকে শিক্ষা নেওয়ার পরামর্শ নিউইয়র্ক টাইমসের

801

ঢাকা, ১২ মার্চ, ২০২১ (বাসস) : নিউইয়র্ক টাইমসে বৃহস্পতিবার প্রকাশিত এক কলামে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডনকে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বাংলাদেশের উদাহরণের দিকে তাকানোর পরামর্শ দিয়ে এটিকে একটি বিস্ময়কর সাফল্য বলে অভিহিত করেছে।
‘দারিদ্রের জন্য বাইডেনের পরিকল্পনা কী করতে পারে? বাংলাদেশের দিকে তাকান’ শিরোনামের কলামটিতে বলা হয়েছে, ‘পঞ্চাশ বছর পূর্তির মুহূর্তে দেশটির বিস্ময়কর সাফল্য সবচেয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর বিনিয়োগের শিক্ষা তুলে ধরে।’
দুবার পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত নিকোলাস ডোনাবেট ক্রিস্টফ যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভায় বুধবার বাইডেনের ১.৯ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের আমেরিকান পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা চূড়ান্ত অনুমোদনের প্রসঙ্গে বিশ্বের অন্যতম নামকরা সংবাদপত্র নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত কলামে একথা লিখেছেন।
তিনি লিখেছেন, ‘এই (পরিকল্পনা) আমেরিকান নীতির একটি পুনর্মূল্যায়ন এবং স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে যে, সব সমাজেরই দরিদ্র শিশুদের ক্ষেত্রে বিনিয়োগের দায় রয়েছে। এ ক্ষেত্রে যে সুফল পাওয়া সম্ভব তা বোঝার জন্য সারা বিশ্ব থেকে শিক্ষা নেয়ার দিকে নজর দেয়া যাক।’
সিএনএন-এর নিয়মিত প্রদায়ক ক্রিস্টফ ২০০১ সাল থেকে নিউইয়র্ক টাইমসে কলাম লিখছেন। তিনি বলেন, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় নৈতিক দাগ হলো ‘ইতিহাসের সবচেয়ে ধনী এবং শক্তিশালী দেশটি ব্যাপক শিশু দারিদ্রের বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছে।’
প্রখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক বলেন, আমি ১৯৯১ সালে ঘূর্ণিঝড় কাভার করতে বাংলাদেশ সফর করেছিলাম। ওই ঘূর্ণিঝড়ে এক লাখেরও বেশি লোক মারা গিয়েছিল। তখন টাইমসের জন্য আমি একটি নিবন্ধে লিখেছিলাম যে, ঐশ্বর্য্যময় দেশটি দুর্ভাগ্যের শিকার।
নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক হাজারেরও বেশি শব্দের কলামে ক্রিস্টফ বলেন, ‘আমি বলেছিলাম যে, বাংলাদেশ কেবল জলবায়ু পরিবর্তন নয়, বরং অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। তবে আমার সকল হতাশা নিরেট ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কারণ বাংলাদেশ তখন থেকে তিন দশকে অসাধারণ অগ্রগতি অর্জন করেছে।’
তিনি বলেন, আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে এ মাসে গণহত্যা, দারিদ্র্য ও অনাহারের মাঝে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল। হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে ‘একটি ‘বাস্কেট কেস’ বলে অভিহিত করেছিলেন এবং ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের ভয়ঙ্কর ছবি দেশের সুনাম মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন করেছিল।’
তিনি বলেন, ‘(তবে) বিশ্বব্যাংকের মতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার অবিচ্ছিন্নভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বর্তমান মহামারীর আগে চার বছর ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রতি বছর ৭ থেকে ৮ শতাংশ বেড়েছে, যা চীনের চেয়েও দ্রুত।’
ক্রিস্টফ উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশে গড় আয়ু ৭২ বছর, যা মিসিসিপি’র ১০টি কাউন্টিসহ যুক্তরাষ্ট্রে বেশ কয়েকটি জায়গার চেয়ে বেশি।
কলামটিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ একসময় হতাশার উদাহরণ ছিল, তবে এখন কীভাবে অগ্রগতি অর্জন করতে হবে তা বিশ্বকে শেখানোর মতো অনেক কিছুই দেশটির আছে।’

ক্রিস্টফের মতে বাংলাদেশের সাফল্যের গোপন রহস্য হলো শিক্ষা ও মেয়েশিশুরা। ১৯৮০ এর দশকের গোড়ার দিকে এক তৃতীয়াংশেরও কম বাংলাদেশী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া সম্পন্ন করেছে, বিশেষত মেয়েরা খুব কমই শিক্ষিত হয়েছে এবং অর্থনীতিতে নগন্য অবদান রেখেছে।
তিনি বলেন, ‘কিন্তু তখন সরকার ও বেমরকারী সংস্থাগুলো মেয়েদেরসহ শিক্ষার প্রচার-প্রসার করে। আজ বাংলাদেশে ৯৮ শতাংশ শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা সম্পূর্ণ করে। লিঙ্গ ব্যবধানের ইতিহাস রয়েছে এমন একটি দেশের জন্য এখন অবাক করা বিষয় হলো, বাংলাদেশের উচ্চ বিদ্যালয়ে এখন ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের সংখ্যা অনেক বেশি।’
ক্রিস্টফ বলেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে নাটকীয় কাজটি হলো নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা। বাংলাদেশ দরিদ্রতম নারীদের দিয়ে শুরু করে মেয়েদের শিক্ষিত ও ক্ষমতায়ন করেছে। সেই শিক্ষিত নারীরা এখন বাংলাদেশের অর্থনীতির স্তম্ভ হয়ে উঠেছে।
তিনি বলেন, দেশের পোশাক কারখানাগুলো নারীদের ভাল সুযোগ দিয়েছে এবং এ মুহূর্তে কোনো মার্কিন নাগরিক যে পোষাক পরিধান করছেন তা তাদের মধ্যে কেউ তৈরি করে থাকতে পারে, কারণ বাংলাদেশ এখন চীনের পর বিশ্বের বৃহত্তম পোশাক রফতানিকারক দেশ।
ক্রিস্টফ আরো বলেন, বাংলাদেশের কারখানাগুলো পশ্চিমা মানদ-ে কম বেতন দেয়। শোষণ ও যৌন হয়রানির সমস্যা রয়েছে, আগুনের ঝুঁকি এবং অন্যান্য সুরক্ষা সমস্যাও রয়েছে; ২০১৩ সালে একটি কারখানা ধসে ১,১০০ এরও বেশি শ্রমিক মারা গিয়েছিল।
‘তবে শ্রমিকরাই বলছে যে, ১৪ বছর বয়সে বিয়ে করা এবং ধানক্ষেতে কাজ করার চেয়ে এ জাতীয় চাকরি বরং বেশি ভালো। তবে ইউনিয়ন ও নাগরিক সমাজ শ্রমিকদের নিরাপত্তায় কাজ করেছে এবং যথেষ্ঠ না হলেও অনেক উন্নতি অর্জন করেছে।’
ক্রিস্টফ উল্লেখ করেন যে, বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে দারিদ্র্য হ্রাসের একটি অনুপ্রেরণামূলক কাহিনী হিসেবে অভিহিত করেছে। ২৫ মিলিয়ন বাংলাদেশীকে ১৫ বছরের বেশি সময়ে দারিদ্র্য থেকে তুলে আনা হয়েছে। ১৯৯১ সাল থেকে বাংলাদেশে অপুষ্টিজনিত কম উচ্চতার শিশুদের সংখ্যা প্রায় অর্ধেক কমে এসেছে এবং এখন এটি ভারতের চেয়ে কম।
ক্রিস্টফ লিখেছেন, ‘সন্দিগ্ধ পাঠকরা হয়তো মাথা নাড়ছেন এবং মনে মনে বিড় বিড় করছেন: অতিরিক্ত জনসংখ্যা অগ্রগতিটি নস্যাৎ করে দেবে। প্রকৃতপক্ষে, বাংলাদেশী নারীরা এখন গড়ে (সাত জন থেকে কমে) দুটি করে শিশু নেয়।’
তিনি বলেন, সংক্ষেপে বাংলাদেশ সবচেয়ে প্রান্তিক ও সর্বনিন্ম উৎপাদনশীলতার দিকে দৃষ্টি দিয়ে সবচেয়ে কম ব্যবহৃত সম্পদ, তার দরিদ্রদের ওপর বিনিয়োগ করেছে, কারণ সেখান থেকেই সর্বোচ্চ লাভ আসবে।
তিনি বলেন, ‘আমেরিকাতেও এটি সত্য হতে পারে। আমরা আমাদের বিলিয়নিয়ারদের কাছ থেকে আরো বেশি উৎপাদনশীলতা আদায় করতে পারবো না, তবে একটি দেশ হিসাবে আমরা উচ্চ বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে না, এমন সাতটি আমেরিকান শিশুর একটিকে সহায়তা করতে পারলে আমরা অনেক উপকৃত হবো।’
ক্রিস্টফ বলেন, শিশু দারিদ্র নিরসনে বাইডেনের উদ্যোগ তা করতে পারে এবং এ কারণেই এটির কেন্দ্রীয় উপাদান ফেরতযোগ্য শিশু কর ক্রেডিট স্থায়ী করা উচিত।
মার্কিন সাংবাদিক লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, প্রান্তিক শিশুদের জন্য বিনিয়োগ করা কেবল মমতার বিষয় নয়, বরং এটি একটি জাতিকে ওপরে তোলার ক্ষেত্রে সহায়ক।’