বাসস দেশ-২ : প্রতিবন্ধী ফরিদার সাফল্যের গল্প

100

বাসস দেশ-২
সাফল্যের গল্প
প্রতিবন্ধী ফরিদার সাফল্যের গল্প
লালমনিরহাট, ৯ মার্চ ২০২১ (বাসস) : শারীরিক প্রতিবন্ধী ফরদিা খাতুন (৩৫)। তার অদম্য ইচ্ছা তাকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছে। নিজ হাতে মাছ ধরার জাল বুনে তা বিক্রি করে। প্রতিমাসে আয় করছে গড়ে ৮/১০ হাজার টাকা। লালনপালন করছে, হাঁস, মুরগী, কবুতর ও ছাগল। বৃদ্ধ বাবা-মা, প্রতিবন্ধী ৪ ভাই বোনের মুখে তুলে দিয়েছে খাবার। দরিদ্র বাবা মার কাছে বোঝা হয়নি। বাবার সংসারের সচ্ছলতা ফিরিয়েছে। যা হয়ত কোন স্বাভবিক সন্তান করতে হিমশিম খেত। প্রতিবন্ধী এ মেয়েকে নিয়ে পরিবারের সদস্য ও গ্রামের মানুষ খুবেই গর্বিত। প্রতিবেশী মানুষের কাছে একজন পরোপকারী ও মানবিক মানুষ। প্রতিবন্ধকতা ও দারিদ্রতা তার জীবনের সাফল্যে বাঁধা হতে পারেনি। সমাজ সংসারে সমাজে সৃষ্টি করেছে সকল স্তরের স্বাভাবিক মানুষ ও নারীদের কাছে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।
জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার গড্ডিমারী ইউনিয়নের ৬নংওয়ার্ডের নিজ গড্ডিমারী গ্রামের দিনমজুর ছোলেমান আলী ও শাহেরা বেগমের প্রথম সন্তান ফরিদা খাতুন। দরিদ্র কৃষিজীবী দিনমজুর বাবার সংগ্রামী মেয়ে ফরিদা। তিস্তা ও সানিয়াজান নদী পাড়ের মেয়ে। কয়েক বছর আগে হঠাৎ বন্যায় তার পরিবারের বসত ভিটাটুকু রাক্ষুসে নদী গর্ভে বিলীণ হয়ে গেছে। বৃদ্ধ বাবা- মা ও ভাই- বোন নিয়ে তাই আশ্রয় মিলেছে সরকারি বাঁধের রাস্তার ধারে ঝুপড়ি ঘরে। বিধাতার কী নির্মম নিষ্ঠুরতা। তার পরিবারের পাঁচভাই -বোনের সকলেই শারীরিক প্রতিবন্ধী ও বামন। স্থানীয় মানুষের ভাষায় বনমানুষ। ছোট বেলায় তাকে সার্কাসে জোকারি করতে নিয়ে যেতে চেয়ে ছিল। কিন্তু তার পরিবারের ইচ্ছে ছিলনা। তাই সার্কাস পার্টির কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়নি। কষ্টে তাদের দিন কাটত অর্ধাহারে অনাহারে। প্রতিবন্ধকতার কারণে আট/দশটা স্বাভাবিক মানুষের মত কাজ করতে পারত না। তাই উপার্জন করতে পারত না। না খেয়ে থাকতে হত। এক কঠিন বাস্তবতার মুখে পড়তে হয়ে ছিল
আত্মপ্রত্যয়ী প্রতিবন্ধী ফরদিা খাতুন কে।
সফল ক্ষুদ্র উদ্যোগতা স্বাবলম্বী ফরদিা খাতুন জানান, ছোট বেলায় দেখেছেন। গ্রামের মানুষ গ্রীষ্মে বাঁশ বাগান, বৃক্ষের ছায়ায় বসে বসে গল্প করতেন ও নিজ মনে মাছ ধরার জাল বুনতেন। এ জাল তৈরির কাজ শেষ হলে বর্ষা মৌসুমে নদীতে, খালে বিলে নতুন পানি এলে সাধারণ মানুষ মাছ ধরতে নেমে পড়তেন। গ্রামের দরিদ্র্র পরিবার গুলোর কেউ কেউ সারা বছর নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কেউ কেউ হাটে গিয়ে জাল কিনে নিয়ে আসেতন। গ্রামের মানুষের কাছে দেখে দেখে জাল বুনা শিখে যায় ফরিদা খাতুন। বেড়ে উঠার সাথে সাথে প্রাথমিক স্কুলেও যেতে শুরৃু করেন। এসএসসি পরীক্ষা একবার দিয়ে ছিলেন। কিন্তু এক বিষয়ে অকৃতকার্য হওয়ায় অর্থাভাবে লেখাপাড়া পূনরায় শুরু করতে পারেনি। তাই পরীক্ষা দেয়া হয়নি। তিনি নিজহাতে জাল বুনে বিক্রি করে নিজের লেখাপড়ার খরচ যুগিয়ে ছিলেন। পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার পর অন্যের কাছে কিছু নগদ অর্থ ঋণ নিয়ে ও কিছু অর্থ সঞ্চয় করে গ্রামের হাট হতে লায়লনের সুতা কিনে মাছ ধরার জাল বুনার কাজ শুরু করেন। এর আগে তিনি জাল বুনে দিয়ে ছিলেন। তিনি জাল বুনে সামান্য পারিশ্রমিক পেয়ে থাকত। এবার তিনি জাল বুনন ও জাল বিক্রির ব্যবসা শুরু করেন। বাড়ির সামনে এ জাল বুনানো ও বিক্রি একসাথে চালু করেন। কয়েক বছরে মধ্যে সংসারে সচ্ছলতা আনেন। বাবা মা ভাই বোনদের মুখে নিত্যদিন খাবার তুলে দেয়। এভাবে সে বাবার সংসারে উপার্জন করতে থাকে। বর্তমানে তার দোকানে প্রায় কয়েক ধরনের কয়েক হাজার টাকা মূল্যেও জাল আছে। তার ব্যবসার মূলধন প্রায় ৫০ হাজার টাকায় দাঁড়িয়েছে। দুই বিঘা কৃষি জমি বন্ধক নিয়ে ধানসহ নানা শস্য চাষ করছে। এ জমির উৎপাদিত ফসল সারা বছরের খাদ্য চাহিদা মিটিয়ে থাকে। সংসারের বাড়তি আয় করতে প্রতিপালন করেন, হাঁস, মুরগী, কবুতর ও ছাগল। এগুলো সন্তানের ন্যায় লালনপালন করেন। পশুপাখি পালন করে সংসারের ডিম ও মাংসের চাহিদা মিটিয়ে প্রতিবছর কয়েক মহাজার টাকা বিক্রি করেন। এভাবে তিনি বাড়িতে বসেই প্রতিমাসে গড়ে ১০/১২ হাজার টাকা আয় করেন। এ্ আয় তাকে আর্থিক স্বচ্ছলতা এনে দিয়েছে।
গ্রামের মুরুবি মোঃ রমজান আরী জানান, ফরিদা খাতুন খুব ভাল মেয়ে। সমাজসেবী ও পরোপকারী নারী হিসেবে সবাই তাকে পছন্দ করেন। গ্রামে ফরিদা একজন সুপরিচিত মুখ। শুনলেই হয় সবার বিপদে ছুটে গিয়ে পাশে দাঁড়ায়। এটা তার একধরণের নেশায় পরিণিত মহয়েছে। বিশেষ করে গ্রামে কোনো গর্ভবতী মা প্রসব বেদনা নিয়ে অসুস্থ হলে ফরিদা খাতুন পাশে গিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। গভীর রাত হউক বা দিন হউক। রোদ হউক বা ঝড় বৃষ্টি হউক। তাকে দ্রুত উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করাবে। তার সুচিকিৎসার ব্যবসা করবেন। এটা তার গুরু দায়িত্ব মনে করেন। তার এ সহযোগিতায় কত নারীর জীবন রক্ষা পেয়েছে তার হিসেব নেই। গ্রামের বেশীর ভাগ দরিদ্র ঘরের মেয়ে এখন ঢাকায় গার্মেন্টেসে কাজ করে। সেখানেই বিয়ে হয়ে যায়। এ সব শ্রমজীবি নারীরা গর্ভবতী হলে স্বামী ও স্বজনরা গ্রামে পাঠিয়ে দেয়। দুইট কারণে শহরে খরচ বেশী ও প্রসবজর্ণিত চিকিৎসার ব্যয় বেশী। স্বামী শহরে চাকরি করে। সন্তান সম্ভবা স্ত্রী গ্রামে মা বাবার কাছে থাকেন। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে এ সব নারীর প্রসব বেদনার উঠলে বৃদ্ধ স্বজনরা পড়েন মহা বিপাকে। বেশীরভাগ সময় স্ত্রীর পাশে স্বামী ইচ্ছে থাকলেও জীবিকার তাগিদে থাকতে পারেন না। এ সব মেয়েদের ভরসারস্থল নানা গুণে গুণান্বিতা ফরিদা খাতুন
বৃদ্ধা মা শাহেরা বেগম জানান, ফরিদা খাতুন বিয়ে করতে চায়না। কারণ প্রতিবন্ধী হিসেবে স্বামী ও স্বামীর স¦জনরা যদি অবহেলা করেন। সে কারও অনুগ্রহ দয়া নিতে চায়না। মানুষের বিপদে ছুটে গিয়ে পাশে দাঁড়ায়। মেয়ে প্রতিবন্ধী দেখে কষ্ট হয়। তবে এ মেয়েকে নিয়ে আমার অহংকারও হয়। স্বাভাবিক মেয়ে হলে হয়ত এভাবে সকলের প্রিয় হতে পারত না। ফরিদা খাতুন এ গ্রামের প্রতিটি বাড়ির মেয়ে। তবে সরকার যদি তাকে সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে সহায়তা করত। তাহলে ফরিদা খাতুন জাল বুনে বিক্রির পাশাপাশি দোকানে মুদি সামগ্রী ও নিত্যপ্রয়োজনী মনিহারি দ্রব্য তুলে বিক্রি করতে পারত। এ দোকান হতে গ্রামবাসি ন্যায্যমূল্যে ভাল মানের পণ্য অবশ্যই পেত।
হাতীবান্ধা উপজলোর সমাজসবো কর্মর্কতা মোঃ মাহাবুবুল আলম জানান, ফরদিা খাতুন(৩৫) একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী। নিজের দায়িত্ব নিতে হিমশিম খাওয়ার কথা। কিন্তু প্রতিবন্ধকতা জয় করে আতœনির্ভর হয়ে উঠেছে। সে মেয়ে হয়ে তার পরিবারের সকল সদস্যের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়েছে। দায়িত্বভার ভালভাবে পালন করছে। ফরিদা খাতুন এ হাতীবান্ধা উপজেলার একজন সফল ক্ষুদ্র উদ্যোগতা। সেই সাথে প্রতিবন্ধিকতা জয়ের একজন সফল নারী। যাহ সকল নারী সমাজের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তার কাছে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। তিনি সমাজের স¦াভাবিক শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত নারীদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। অদম্য ইচ্ছে ও সাহস থাকলে অর্থ প্রতিবন্ধকতা সাফল্যের পিছনে কোন বাঁধা হতে পারে না।
বাসস/এনডি/সংবাদদাতা/১১৫৫/নূসী