৭ই মার্চের ভাষণেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিহিত ছিল : ইমাম

618

সৈয়দ আলতেফাত হোসেইন ।।
ঢাকা, ৭ মার্চ, ২০২১ (বাসস) : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম তার মৃত্যুর কিছুদিন আগে বাসসকে দেয়া অপ্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণটির মাঝে মূলত বাংলাদেশের ঐতিহাসিক স্বাধীনতার বীজ নিহত ছিল। এটা ছিল তাঁর সুদীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও দূরদর্শীতার উপসংহার স্বরূপ।
তিনি এই সাক্ষাৎকারে বাসসকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু এই ভাষণে বাঙালিদের ওপর শোষন-নির্যাতনের পাশাপাশি আমাদের আত্মত্যাগের কথাও তুলে ধরেছেন। আর তারপর তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করতে আমরা রক্ত আরো দেব।’
একটি ঐতিহাসিক ভাষণের দিন হিসেবে বিবেচনা করে ৭ই মার্চ তার এই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করা হবে বলে ইমাম আশা প্রকাশ করেন।
ইমামের মতে, রাজনৈতিক ভূখ-ের বিভক্তি ও শাসক পরিবর্তন ‘আমাদের বঞ্চনার ভাগ্যে’ কোন পরিবর্তন আনতে পারবে না বুঝতে পেরে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৭ সালের দেশ-ভাগের এক বছরের মধ্যেই একটি স্বাধীন দেশের কথা ভাবতে শুরু করেন। আমলা থেকে টেকনোক্র্যাট হওয়া ইমাম বলেন, বঙ্গবন্ধু তাঁর সুদীর্ঘ সংগ্রামী জীবনে বাঙালিদে মনে এই অনুভূতি জাগ্রত করেন যে- জাতি হিসেবে তারা পশ্চিম পাকিস্তানীদের থেকে আলাদা। ইমাম বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সচিব ছিলেন।
৭ই মার্চের ভাষণটি সর্বাত্মক স্বাধীতনা যুদ্ধের ইঙ্গিত দিয়েছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু প্রথমে ভাষা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আমাদের চেতনা জাগ্রত করেন। আর এটাই আমাদের মনে এই অনুভূতি জাগ্রহ করে যে- আমরা সব দিক থেকে একটি আলাদা জাতি।
ইমাম বলেন, মাত্র ১৮ মিনিটের ভাষণটির ছিল ‘গেরিলা যুদ্ধ’ ও ‘গণ-যুদ্ধের’ জন্য একটি বিস্তারিত রূপরেখা।
প্রধানমন্ত্রীর সদ্য-প্রয়াত এই উপদেষ্টা বলেন, বঙ্গবন্ধু দুটি পয়েন্ট নির্ধারণ করেছিলেন- একটি হলো ‘জনগণের মুক্তির’ ডাক আর দ্বিতীয়টি হলো- ‘মুক্তিযুদ্ধের’ আহ্বান।
ইমাম বলেন, এই ‘মুক্তি’র ডাক ছিল মূলত ক্ষুধা, দারিদ্র, নিরক্ষরতা ও অপুষ্টি দূর করার স্বপ্ন। তিনি জনগণের মাঝে এই ধারণা জাগ্রত করেন যে- একমাত্র বাংলাদেশের স্বাধীনতাই এই স্বপ্ন পূরণ করতে পারে। আমরা স্পেশাল ব্রাঞ্চের গোপন দলিল থেকে জেনেছি যে- ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকেই বঙ্গবন্ধুর অসামান্য ব্যক্তিত্ব ও সম্ভাব্যতার কারণে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ উপর নজর রাখছিল। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী ভেবেছিল যে- বঙ্গবন্ধু তাদের জন্য ভয়ের কারণ হবেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রখর বিচক্ষণতা ও নেতৃত্বের গুণে জনগণের মনকে স্বাধীনতার জন্য তৈরি হতে কিছুটা সময় নেন।
তিনি বলেন, সময় নেয়ার এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে, পাকিস্তানী শাসকদের কাছে বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালে প্রায় স্বাধীনতা অথবা স্বাধীনতার কাছাকাছি ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন এবং এভাবে তিনি তাঁর দাবি প্রত্যাখ্যান করলে কার্যত স্বাধীনতার পটভূমি তৈরি করেছিলেন।
অবশেষে, বঙ্গবন্ধু ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনে ছয় দফা দাবির ওপর জনগণের ম্যান্ডেট গ্রহণ করেন ফলে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর অস্তিত্ব প্রায় বিলুপ্ত হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু শুধু তাঁর ৭ মার্চের ভাষণে সীমাবদ্ধ ছিলেন না উল্লেখ করে যুদ্ধকালীন সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, পূর্ব পাকিস্তান সরকার ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ এবং অসহযোগ আন্দোলনের মুখে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুসারে আওয়ামী লীগ দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল এবং রেডিও ও টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে একটি শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রের শিরোনাম করা হয়েছিল ‘শেখ মুজিব সেন্সর ছাড়াই স্বাধীনতার ঘোষণা দেন’। মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে গিয়ে ইমাম বলেন, দেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ বিশ্বের মহান সফল গণযুদ্ধ, যা বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে শুরু হয়েছিল। ততকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলো এবং সর্বস্তরের জনগণ এই যুদ্ধ সফল করেছিলো।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে ১৯৭১ সালে এপ্রিলে একটি গণপরিষদ গঠন করা হয়। এবং ওই পরিষদ (গণ পরিষদ) ১০ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে দেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, বলেন ইমাম। তিনি বলেন, ’৭১ এর ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণায় মুক্তিযুদ্ধের সকল দিক বর্ণনা করার পর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর নাম ঘোষণা করা হয়।
‘তখন থেকে আমরা জাতির পিতা পেয়েছি,’ উল্লেখ করে ইমাম বলেন, তবে উক্ত ঘোষণা সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করার পর তিনি সাংবিধানিকভাবে জাতির পিতা হলেন।
তিনি বলেন, ‘আমি তাঁকে (বঙ্গবন্ধু) স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা বলেছি। তিনি বাঙ্গালি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের উদ্দীপিত করেছিলেন এবং পাকিস্তানী দখলদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য অনুপ্রণিত করেছিলেন।