কিশোরী মায়ের জন্য কৈশরবান্ধব স্বাস্থ্যকেন্দ্র বানাচ্ছে সরকার

371

ঢাকা, ৩ মার্চ, ২০২১ (বাসস) : আশরাফি সুমি (১৬) বিয়ের সতেরো মাসের মধ্যে মা হয়েছেন। তার স্তনে শিশু দুধ পাচ্ছে না বলে সুমি চিকিৎসকের কাছে এসেছেন। শিশুর ওজন কম এবং সে স্তন চুষে দুধ খাওয়ার মতো শক্তি পাচ্ছেনা বলে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। সুমি জানন, ‘ডাক্তার বলছে এ অবস্থায় কিছুই করার নেই। তিনি আমাকে বেশি বেশি খেতে বলেছেন এবং শিশুকে স্তনের দুধ খাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যেতে বলেছেন।”
চিকিৎসকরা বলছেন, কম বয়সে বা কিশোরী অবস্থায় মা হলে এ ধরনের সমস্যা হয়। কমপক্ষে ১৯ বছরের নিচে মা হলে তার নানা ধরনের সমস্যা হতে পারে। নিজের জীবনের যেমন ঝুঁকি থাকে তেমনি নবজাতকের মৃত্যু ঝুঁকি বেড়ে যায় বহুগুণ।’
একজন নারীর মা হওয়ার সঠিক সময় কোনটি জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ এন্ড হাসপাতালের গাইনী বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান ও অধ্যাপক ডা. আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘সঠিক সময় অবশ্যই ১৮ বছরের পরে। ১৯-২৫ বছর ভালো সময়। তবে সবচেয়ে ভালো সময় ২১-২২ বছর। আবার ১৯-৩৫ বছর পর্যন্ত মা হতে বাধা নেই। কিন্তÍু ১৯ এর নিচে এবং ৩৫ এর পরে নানা ঝুঁকি বা জটিলতা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বলে চিকিৎসকরা এ সময়ের মধ্যে সন্তান নেয়ার পরামর্শ দেন।’
তিনি বলেন ‘কিশোরী অবস্থায় মা হলে দুই ধরণের সমস্যা হয়। এক. তার নিজের এবং দুই. তার সন্তানের। নিজের সমস্যাগুলো হলো কিশোরী হওয়ায় তখনও সে সন্তান নেয়ার জন্য মানসিকভাবে তৈরি থাকেনা। তখনও তার শরীরের গঠণ পরিপূর্ণ হয়না। ফলে এর প্রভাব তার সন্তানের ওপর পড়ে। অনেকের রক্তস্বল্পতা থাকে। এক্ষেত্রে তাদের প্রি-একলামশিয়া হওয়ার ঝুঁকি থাকে। যে রাস্তা দিয়ে প্রসব হয় একজন কিশোরীর তখনও সে রাস্তা পরিপূর্ণ বা পরিপুষ্ট না হওয়ায় সন্তান হওয়ার সময় তা বাধাগ্রস্থ হয়। কিংবা অনেক সময় ধরে সেখানে সন্তান আটকে থাকে বলে ওই জায়গায় চাপ পড়ায় পরবর্তীতে মায়ের ফিস্টুলা নামের জটিল রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। শুধু এ কারণে বাংলাদেশে প্রচুর নারী ফিস্টুলায় ভোগেন। প্রসবের সময় প্রসবের রাস্তায় সেলাই দেয়ার প্রয়োজন হলে সেই সেলাই লাগতে চায় না। অনেক সময় সংক্রমণও হয় এবং মায়ের সারাজীবন ধরে তলপেটে ব্যথা হয়।’
তিনি আরো বলেন, ‘সন্তানের সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম মায়ের বয়স কম থাকায় সে সন্তানের ঠিকমতো খেয়াল রাখতে পারেনা। তার প্রতি যথাযথ মনোযোগ দিতে ও যতœ নিতে পারেনা। মায়ের শরীর ঠিকভাবে পরিপুষ্ট হয়না বলে শিশু অপুষ্টিতে ভোগে। সাধারণত কিশোরী মায়েদের নবজাতকরা কম ওজন নিয়ে জন্মায়। পরবর্তীতেও তাদের গ্রোথ কম হয়। অনেক সময় প্রিম্যাচিউর বা অপরিণত শিশু জন্মায়। ডেলিভারীর সময় ইনফেকশন হয়ে নবজাতকের সমস্যা হয় বা মারা যায়। কিশোরী মায়ের স্তনে ঠিকভাবে দুধ সরবরাহ হয়না এবং শিশু কম দুধ পায়।’ তিনি আরো বলেন, ‘এজন্য শিক্ষা, সচেতনতা এবং আমাদের যে আইন আছে সেটা অনুসরণ করা দরকার। সবচেয়ে বড় কথা শিক্ষাটা জরুরী। শিক্ষা থাকলে কিশোরী নিজেই নিজের বিষয়ে সচেতন হবে এবং ১৮ বছরের আগে নিজেই বিয়ে করতে চাইবেনা।’
নবজাতক এবং কিশোরী মা’র মৃত্যু ঝুঁকিসহ নানা জটিলতার জন্য বাল্যবিবাহকে দায়ী করলেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রামের প্রকল্প পরিচালক ড. আবুল হোসেন। তিনি বলেন, ‘বাল্যবিবাহ বন্ধের জন্য আমরা প্রয়োজনীয় সকল বিষয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। বিয়ের পর ১৯ বছরের নিচে সন্তান নেয়ার বিষয়টি প্রত্যেকের ব্যক্তিগত হলেও সরকার এবং তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এর নেতিবাচক বিষয়গুলো মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করছে। এরপরও যারা কিশোরী বয়সে মা হচ্ছে তাদেরকে কীভাবে আরো ভালো স্বাস্থ্যসেবা দেয়া যায় সে বিষয়ে সরকার কাজ করছে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ‘অ্যাডোরেসেন্ট এন্ড স্কুল হেলথ প্রোগ্রাম’এর প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. সবিজুর রহমান বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন স্কুলে কিশোরীরা যাতে বাল্যবিবাহ না করে এবং কিশোরী বয়সে মা না হয় সে বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। যদি কেউ অপরিণত বয়সে মা হয় তাহলে সরকারের বিভিন্ন হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে ‘কৈশরবন্ধব স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র’ রয়েছে যেখানে কিশোরী মা’দেরকে স্বাস্থ্য সেবা দেয়া হয়। এ মুহূর্তে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ৮০টি কেন্দ্র রয়েছে। এ বছর আরো ৬০টি কেন্দ্র করার চেষ্টা করছে সরকার। এভাবে দু’চার বছরের মধ্যে আমরা সারাদেশে এ ধরনের কেন্দ্র গড়ে তোলার চেষ্টা করছি। পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়েরও এ ধরনের বেশ কিছু কেন্দ্র রয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আগে এগুলো ছিল না। ২০১১ থেকে কিশোরী মা’দের জন্য এসব স্বাস্থ্যকেন্দ্র চালু হয়েছে। কিশোরীদের প্রাইভেসি রক্ষা করে ইউনিসেফের সাথে আমরা একাজ করছি।’
কিশোরী বয়সে মা হওয়া বন্ধের জন্য আরো ব্যাপক সচেতনতা এবং কৈশরবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোর সেবা দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিলে মা ও নবজাতকের সমস্যাগুলো রোধ করা অনেক সহজ হবে এমনই বলছেন সংশ্লিষ্টজনরা।