বাসস ইউনিসেফ ফিচার-২ : পুরুষের তুলনায় নারী শ্রমিকরা মজুরি বৈষম্যের শিকার

79

বাসস ইউনিসেফ ফিচার-২
নারী-শ্রমিক
পুরুষের তুলনায় নারী শ্রমিকরা মজুরি বৈষম্যের শিকার
ঢাকা, ২ মার্চ, ২০২১ (বাসস/ইউনিসেফ) : ‘আমার ঘরে চারডে ছলমায়ে (ছেলে-মেয়ে)। সুয়ামিডা (স্বামী) ভ্যান চালাতি যায়ে অসুকে পড়িছে। ডাক্তার দিহানুর মতো টায়াপয়সা নাই। এইহেনে (চালকলে) দিনভরে কাজ করে ১৫০ থেকে ২০০ টায়ার মতো পাই। সংসারডা চলে না।’
কথাগুলো বলতে গিয়ে যেন গলা ধরে আসছিল বললেন- নড়াইলের কালিয়া উপজেলার পহরডাঙ্গা গ্রামের চালকল শ্রমিক সালেহা বেগমের। তার স্বামী আদুল মালেক ভ্যান চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়ে আহত হয়ে ঘরবন্দি। তিন ছেলে-মেয়েসহ পাঁচজনের সংসার চালাতে এখন ত্রাহি-ত্রাহি অবস্থা।
শুধু সালেহা-ই নন, গ্রামের একটি চালকলে কাজ করেন প্রায় ৫০জন নারী। যাদের বেশির ভাগেরই বাস এই গ্রামের কিন্তু দিনভর হাড়-খাটুনীর পর যে মজুরি পান তা দিকে কোনো মতেই উনুন জ্বলে না। ধার-দেনা করে চলতে হয়। তবুও মজুরি বাড়ায় না চালকল মালিকেরা।
নারী শ্রমিকেরা বলছেন, নড়াইলের চার শতাধিক চালকলে হাজার চারেকের মতো নারী শ্রমিক রয়েছেন। কিন্তু তারা মজুরি বৈষম্যের শিকার। পুরুষেরা যেখানে ৪৫০-৫০০ টাকা পান, সেখানে দিন-রাত পরিশ্রম করেও নারীরা পান ২০০ টাকা। অথচ সমান কাজ করেন তারা।
চালকলের শ্রমিক জোবায়দা খাতুন বলেন, আকাশে মেঘ থাকলি, বৃষ্টি হলি আট-নয় দিনেও ধান শুকানো যায় না। তবে ধান এক দিনে শুকায়ে চাল কত্তি পারলি মণপ্রতি ২৫ টায়া আবার ১৫ দিনি করলি ৩০ টায়াই মুজরি দেয় মালিকরা। আমাগের চেয়ে পুরুষরা বেশি টায়া পায়। আমরা এক বস্তা ধান শুকায়ে সিদ্ধ করে চাল করলি তার মুজরি ২৫ টায়া দেয়। পুরুষেরা ধানের বস্তা মাথায় নিয়ে জাগামতো থুলি পরে পোরতেক বস্তায় ৫ থেকে ১০ টায়া বেশি পায়। আমাগেরই আবার সেই বস্তা মাথায় তুলে দিতি হয়।’
তবে জেলা চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নান দাবি করেন, তারা নারী ও পুরুষ শ্রমিকদের সমান মজুরি দেন। যারা কম মজুরির কথা বলেছেন তারা ঠিক বলেননি।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শুধু চালকল শ্রমিক-ই নন, অন্যান্য খাতে কাজ করা নারী শ্রমিকেরাও বঞ্চিত হচ্ছেন ন্যায্য পাওনা থেকে। এ বিষয়ে বারবার দাবি জানিয়ে এলেও কোনো কাজ হয়নি।
সম্প্রতি অন্যের ক্ষেতে কাজ করে বাড়ি ফিরছিলেন খাগড়াছড়ির দীঘিনালার ভৈরফা রাবার কারখানা এলাকার মিতা চাকমা। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভোর থেকে বিকেল পর্যন্ত কাজ করি। দিনশেষে বেতন পাই দেড়শ’ টাকা। অথচ পুরুষেরা পান ৩শ’থেকে সাড়ে ৩শ’ টাকা। কাজ পাই না বলে আমাদের মজুরি কম।
তার মতো উপজেলার কয়েক শ’ নারী শ্রমিক মজুরি বৈষম্যের শিকার হলেও, তাদের হয়ে কথা বলার কেউ নেই। তবে সরকারের মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর বিভিন্ন সময় সভা ও মানববন্ধনের মাধ্যমে সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করে। নারীদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করার বিষয়ে সেভাবে খাগড়াছড়িতে কারও সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম চোখে পড়েনি।
উপজেলা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চলতি বছর উপজেলার ২২টি কৃষি ব্লকে ১ হাজার ৭ হেক্টর জমিতে বোরো ও ৫১০ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে। এসব জমিতে কাজ করেন নারী শ্রমিকেরা। মজুরি কম বলে চাষিরা নারী শ্রমিকদেরই বেশি নিয়োজিত করেন।
হাচিনসনপুর এলাকার কয়েকজন তামাকচাষি বলেন, ‘তামাক ক্ষেতে পুরুষ শ্রমিকেরা মজুরি পান সাড়ে ৩শ’ থেকে ৪শ’ টাকা। আর নারী শ্রমিকদের দিই দু’শ টাকা।’
তামাক শ্রমিক সাজেদা আক্তার (৪০), জমিরন বেগম (৪৫) ও কুলসুমা বেগম (৬০) বলেন, ‘আমরা কোনোভাবেই পুরুষের চেয়ে কাজ কম করি না। পুরুষের সমান সমানই কাজ করি। পুরুষদের মতোই আমরা সকাল সাতটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত কাজ করি। কিন্তু এরপরও আমাদের মজুরি পুরুষের তুলনায় অর্ধেক।’
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বোরো চাষের সঙ্গে যুক্ত নারী শ্রমিকের মজুরি আরও কম। জমিতে নয় ঘণ্টা কাজ করে তারা বেতন পান দেড় শ’ টাকা। কৃষিশ্রমিক উষা রানি চাকমা, মমতা চাকমা, শান্তি রানি চাকমাসহ বেশ কয়েকজন শ্রমিক জানান, তারা দেড়শ’ টাকা মজুরিতে বোরোর জমিতে কাজ করেন। আর পুরুষেরা কাজ করলে পান সাড়ে ৩শ’ টাকা। তারা কাজ না পাওয়ায় বাধ্য হয়ে কম মজুরি নিচ্ছেন।
নারীনেত্রী সীমা দেওয়ান বলেন, একজন নারী কোনোভাবেই পুরুষের চেয়ে কম কাজ করেন না। নারী-পুরুষ সমানই কাজ করেন। তাই মজুরি বৈষম্য মেনে নেয়া যায় না। বিষয়টি নিয়ে সরকারিভাবে মাঠপর্যায়ে কাজ করা উচিত। নারী শ্রমিকদেরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন রয়েছে।
এ বিষয়ে উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা অনুকা খীসা বলেন, ‘পুরুষের চেয়ে নারী শ্রমিকের মজুরি অর্ধেক হওয়া সত্যি দুঃখজনক। তবে এই বৈষম্য নিরসনে সচেতনতামূলক সভাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছি। এর বাইরে আমাদের সেভাবে কিছু করার থাকে না।
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা ইন্দিরা বলেন, সরকার জেন্ডার বৈষম্য নিরসনে ১ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকার বাজেট বাস্তবায়ন করছে। তবে এক্ষেত্রে নারীদের এগিয়ে আসতে হবে। সচেতন হতে হবে।
বাসস/ইউনিসেফ ফিচার/তাসলিমা/মহ/১৮২০/কেজিএ