মেহেরপুরে পরাগায়নের মাধ্যমে সবজি উৎপাদন বাড়ছে

587

॥ দিলরুবা খাতুন ॥
মেহেরপুর, ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ (বাসস) : উন্নত ও অধিক ফলন উৎপাদনের জন্য দেশের অন্যান্য বীজ উৎপাদন খামারের মতো মেহেরপুরের আমঝুপি বীজ উৎপাদন খামারে বিভিন্ন ফলনগাছে পরাগায়ন করা হচ্ছে। জেলায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সবজির জমিতে শতভাগ ফুলে ফল ধরাতে কৃষকরাও পরাগায়ন করছে। এতে একদিকে যেমন জমিতে শতকরা ৯৯ ভাগ ফুলে ফল ধরাতে দেশের মানুষের চাহিদা মিটছে। পরাগায়নে সুফল পাওয়াতে কৃষকরা পরাগায়ন করছে। অপরদিকে মানুষের কর্মসংস্থানও হচ্ছে।
ফসলী জমিতে অবাধে কীটনাশক প্রয়োগে বর্তমানে কীটপতঙ্গ, উপকারী পাখি হারিয়ে যাওয়ায় কৃষকরা কৃত্রিম উপায়ে পরাগমিলনের কাজটি করছে। কেউ কেউ বাক্সবন্দি মৌমাছি কিনে এনে তাদের জমিতে মৌমাছি পালন করছে পরাগমিলনের জন্য। চাষাবাদের জমিতে ব্যাপকহারে কীটনাশক ব্যবহারে দিনে দিনে কমে গেছে মৌমাছিসহ পতঙ্গরা। গ্রামে গ্রামে ব্যাপকহারে কীটপতঙ্গের অভাব দেখা দিয়েছে। ফলে চাষীরা ফসল উৎপাদনে বাধার সম্মুখীন হচ্ছিল। বেশী ফসল উৎপাদনের জন্য চাষীরা কৃত্রিম উপায়ে ফুলে ফুলে পরাগমিলন ঘটাচ্ছে। একটি পুরুষ ফুলের পুংকেশর দিয়ে ৬ থেকে ৭টি স্ত্রী ফুলের গর্ভমুন্ড পরাগায়ন করা যায়। পরাগায়ন করলে শতকরা ৯৯টি স্ত্রী ফুলে ফল ধরবে। মেহেরপুরের বিভিন্ন গ্রামের চাষীরা এখন ভোর হতেই সবজি ক্ষেতে গিয়ে পুরুষ ফুল নিয়ে স্ত্রী ফুলের সঙ্গে স্পর্শ করাচ্ছেন পরাগমিলন ঘটানোর জন্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন- অবাধে কীটনাশক ব্যবহার বন্ধ না হলে ছোট ছোট পতঙ্গ বিলুপ্তি হবে দূর ভবিষ্যতে। তখন ফসল উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দেবে।
চাষীদের অভিমত কৃষিজমিতে ব্যাপকহারে কীটনাশক ও সার প্রয়োগের ফলে দ্রুতহারে কীট পতঙ্গের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। ফলে এতকাল ধরে প্রাকৃতিক নিয়মে যে কাজ হত এখন চাষীরা কৃত্রিমভাবেই সেই কাজ করছেন। এরফলে ফসলের উৎপাদনও অনেকাংশে বাড়ছে।
সরেজমিনে আমঝুপি বীজ উৎপাদন খামারে দেখা যায় সকাল বিকেল পরাগায়ন করা হচ্ছে। ফার্মের ডিএডি নিমাই কুমার প্রামানিক জানান- উন্নত ফলনশীল বীজ উৎপাদনের জন্য পরাগায়নের মাধ্যমে হাইব্রিড বীজ উৎপাদনে পরাগায়ন করছেন। বর্তমানে টমোটো, বেগুন,শিম , লাউ ইত্যাদি সবজিগাছে পরাগায়ন ঘটানো হচ্ছে। তিনি জানান ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে খাদ্যচাহিদা বেড়েছে। খাদ্যচাহিদা মোকাবেলা করতে পরাগায়নের বিকল্প নাই। পরাগায়নে ফলনবৃদ্ধির সাথে নতুনজাত তৈরী করা যাচ্ছে।
সাহারবাটি গ্রামের চাষী আনিসুর রহমান জানান- গতবছর একবিঘা জমিতে কাকরোল চাষ করেছিলেন। প্রতিদিন ভোরে উঠে তিনি সবজি ক্ষেতে গিয়ে পুরুষ ফুল সংগ্রহ করে প্রতিটি স্ত্রী ফুলের স্পর্শ করাতেন। এবছর একই জমিতে টমেটো করেছেন। এখনও একই পদ্ধতিতে পরাগায়ন করে দিগুণ টমেটো পাচ্ছেন। একই গ্রামের মাঠে দেখা গেল কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের পরামর্শে টমেটো, লাউ, কাকরোল, কুমড়া, ইত্যাদি জমিতে কৃষকরা পরাগয়ন করছেন।
কৃষি বিভাগের এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে, দেশে গত ৫০ বছর আগে যেহারে বিভিন্ন প্রজাতির কীটপতঙ্গ ছিল। সাম্প্রতিককালের ৬০ভাগ প্রজাতীর কীটপতঙ্গ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ব্রিটিশ জার্নাল ‘প্রসিডিংস অব দ্য রয়্যাল সোসাইটি বি’ এক প্রতিবেদনে বলেছেন অতিমাত্রায় কীটনাশক ব্যবহারে পরাগায়নে সহযোগিতাকারী মৌমাছি‘র মধ্যে মহামারি আকারে বন্ধাত্ব ছড়িয়ে পড়ছে। আরও বলা হয়েছে প্রতিবছর শত শত কোটি ডলার মূল্যমানের পরাগায়নে ভূমিকা রাখে মৌমাছি।
কৃষিবীদ রকিব উদ্দীন জানান- লাউ গাছের ফুল একলিঙ্গ এবং গাছটি ভিন্নবাসী উদ্ভিদ। ভাল ভাবে লাউ ধরাতে হলে কৃত্রিমভাবে পরাগায়ন করতেই হবে। অর্থাৎ এসব গাছে পুরুষ ও স্ত্রী ফুল পৃথক পৃথক হয়। একই বয়সের পুরুষ ও স্ত্রী ফুল কাছাকাছি থাকলে এবং বাতাসের বেগ প্রবল হলে কিছু পরাগায়নের সম্ভাবনা থাকে তবে তা একেবারেই নগন্য। তাই পোকা-মাকড় বা মৌমাছি বেশি না থাকলে পুরুষ ও স্ত্রী ফুল পরাগায়নের মাধ্যমে প্রাকৃতিক পরাগায়ন সম্ভব হয় না। লাউয়ের ফুল সাদা বলে মৌমাছি বা পোকামাকড় থাকলেও লাউ ফুলে পরিভ্রমণ কম করে। এ জন্য লাউ ধরে না। লাউয়ের পুরুষ ও স্ত্রী ফুল পৃথক হওয়ায় কৃত্রিমভাবে পুরুষ ফুল এনে স্ত্রী ফুলের পরাগায়ন ঘটাতে হয়। পুরুষ ফুলের বোঁটার অগ্রভাগে ফুটে। পাপড়ির গোড়ায় গর্ভাশয় থাকে না। পাপড়ির মাঝখান দিয়ে বেড়ে যাওয়া পুংদন্ডে পাউডারের গুঁড়ার মত পুংরেণু থাকে। পুংদন্ডের শীর্ষভাগে গর্ভমুন্ড থাকে না। শুধু বোঁটার অগ্রভাগে ফুটে থাকা ফুলগুলো পুরুষ ফুল। আর ক্ষুদ্রাকৃতি লাউয়ের মত গর্ভাশয়ধারী ফুলগুলো স্ত্রী ফুল। গর্ভাশয়ের ওপর থেকে পাপড়ি থাকবে। পুংদন্ড থাকবে না। গর্ভদন্ড ছোট ও মোটা। গর্ভদন্ডে আঠালো পদার্থ থাকবে। পুংরেণু এখানে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আঠায় আটকে যায়। অনেকেরই ধারণা, শুধু স্ত্রী ফুলের এই গর্ভাশয় থাকলেই লাউ ধরবে। এ ধারনাটা ভুল। গর্ভমুন্ডে পুরুষ ফুলের পুংরেণু না লাগা পর্যন্ত লাউ ধরবে না। পুরুষ ফুল থেকে ফল হয় না ফল হয় স্ত্রী ফুল থেকে, তাই পুরুষ ফুল ছিড়ে এনে স্ত্রী ফুলে পরাগায়ন করতে হবে। স্ত্রী ফুল ছেড়া যাবেনা।
মেহেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ স্বপন কুমার খাঁ জানান- অবাধে কীটনাশক ব্যবহারে মৌমাছিসহ অনেক পতঙ্গ মারা গেলেও মৌচাষে খাচাবন্দি মৌমাছি বেড়েছে। স্থানীয় মৌমাছির চেয়ে সুন্দর বনের মৌমাছি অনেকদুর পর্যন্ত উড়ে বিচরণ করতে পারে। এবং তাদের দেহে প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশী। সুন্দরবনের বাইরের মৌমাছি বা পতঙ্গরা কীটনাশক ওষুধ ব্যবহার সহ্য করতে পারেনা। সুন্দর বন এলাকার মৌমাছি তা সহজেই সহ্য করতে পারে। সুন্দর বনের মৌমাছি দিয়ে একদিকে যেমন সবজি ক্ষেতে পরাগমিলন করে উৎপাদনবৃদ্ধি করা যাবে, অপরদিকে মধু উৎপাদন করে সবজি চাষের খরচ মেটানো সম্বব। এই কৃষিবিদের মতে সুন্দরবন এলাকার মৌমাছি যেহেতু নদী-নালা এলাকায় থাকে সেই কারণেই তারা সহজেই নদী পারাপারও হতে পারে। কমকরে ৩ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ওই মৌমাছিরা বিচরণ করতে পারে। যা একটি সাধারণ মৌমাছির পক্ষে সম্ভব না। সঙ্গে সঙ্গে দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতাও অনেক বেশী।