বাসস দেশ-২ : মহান ভাষা আন্দোলনে কিছুটা ভূমিকা রেখেছিল ফেনীর গণমাধ্যম

196

বাসস দেশ-২
ভাষা-আন্দোলন-ফেনী
মহান ভাষা আন্দোলনে কিছুটা ভূমিকা রেখেছিল ফেনীর গণমাধ্যম
॥ আরিফুল আমীন রিজভী ॥
ফেনী, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ (বাসস) : মহান ভাষা আন্দোলনে ফেনীর সন্তান ভাষা শহীদ সালাম আর ভাষা সৈনিক গাজীউল হকের ভূমিকার কথা সবাই জানে, কিন্তু গণমাধ্যমেও ভাষা আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ ঢাকার সঙ্গে সমস্বরে ফেনীকেও ছুঁয়েছিলো তীব্রভাবে এ খবর নতুন প্রজন্মের অজানা। ভাষা আন্দোলনে ফেনীর গণমাধ্যমের ভূমিকার কথা ১৯৪৮ সাল হতে সে সময়ের আন্দোলনকারী ও বিভিন্ন গ্রন্থ এমন তথ্যকেই জোর সমর্থন দেয় এবং তথ্য নিশ্চিত করে।
ফেনীতে ভাষা আন্দোলনে সেসময়ের বেশ কিছু তরুণের নাম বিভিন্ন বইতে জ্বলজ্বল করছে। দু’টো সংবাদপত্রের কথা বলা হচ্ছে যা ফেনীর মানুষদের দাবি আদায়ের পক্ষে সংগঠিত করেছিল।
ফেনীতে ভাষা আন্দোলনকে দুই ভাবে দেখা যেতে পারে। সংবাদপত্রের ভূমিকা এবং রাজপথের আন্দোলন।
১৯৪৮ হতে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ভাষা আন্দোলনকালে ফেনীর কোন সংবাদপত্রের কপি কোথাও সংরক্ষণের খবর পাওয়া যায়নি। তবে বিভিন্ন ইতিহাস গবেষণায় ফেনীতে ভাষা আন্দোলনে সংবাদপত্রের ভূমিকা প্রবলভাবে ফুটে ওঠে।
১৯৪৮ সালে (মতান্তরে ১৯৪৭) ফেনী হতে প্রকাশিত সাপ্তাহিক সংগ্রাম পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন ফেনীর রাজা খ্যাত ভাষা সৈনিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম খাজা আহাম্মদ। সংগ্রামে নিয়মিত স্থান পেত রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনের খবর এবং প্রবন্ধ।
মুদ্রণশিল্পের কথা; অতীত ও বর্তমান গ্রন্থটিতে দেখা যায়, মাস্টার পাড়ায় সুজাত প্রেস নামে একটি ছাপাখানা হতে সংগ্রাম পত্রিকাটি প্রকাশিত হত। গ্রন্থটিতে ভাষা আন্দোলনে মুদ্রণশিল্পের ভূমিকা অধ্যায়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে।
শুরু থেকেই তৎকালীন পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী ভালভাবে নেয়নি সাপ্তাহিক সংগ্রাম পত্রিকাটিকে। খাজা আহাম্মদ নিজেই তখন ফেনীতে ভাষা আন্দোলনের অগ্রনায়ক। বলা হয়ে থাকে সাপ্তাহিক সংগ্রাম যুবাদের আন্দোলনে উদ্বুদ্ধকরণে ভূমিকা রাখত।
২০১৭ সালে নিউজ পোর্টাল নতুন ফেনী’র ভাষা আন্দোলনে ফেনী শিরোনামে ‘অন্যপক্ষ’ ম্যাগাজিন প্রকাশ করে। এতে উপেক্ষিত খাজা আহাম্মদ শিরোনামে একটি লেখায় বলা হয়, একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাষা সৈনিক বিচারপতি কাজী এবাদুল হক স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন খাজা আহাম্মদের নেতৃত্বে আমরা ভাষা আন্দোলনে অংশ নেই। তিনি তখন ভাষা সংগ্রামের আহবায়ক।
কাজী এবাদুল হক কোন সালের কথা বলেছেন তা এখানে স্পষ্ট হয়নি। তবে সমসাময়িককালে খাজা আহাম্মদ নোয়াখালী জেলা যুবলীগের সভাপতি ছিলেন বলে ফেনীর ইতিহাস গ্রন্থে জমির আহমেদ উল্লেখ করেন। উল্লেখ্য যুবলীগ ছিল পূর্ব পাকিস্তানের যুব সংগঠন। এ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে।
‘ফেনী ছিল ভাষা আন্দোলনে উত্তাল জনপদ’ শিরোনামে রফিকুল ইসলামের একটি তথ্যবহুল নাতিদীর্ঘ লেখা, আমানুল্লাহ কবীর এবং ফাইজুল ইসলাম সম্পাদিত ‘জেলায় জেলায় ভাষা আন্দোলন ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’ বইতে ছাপা হয়। এতে লেখক বাংলাদেশের প্রবীন সাংবাদিক ও ফেনীর কৃতি সন্তান মরহুম এবিএম মূসার দেয়া একটি তথ্য উল্লেখ করেন। এবিএম মূসার উদ্ধৃতি দিয়ে লেখা হয়, রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে তাঁর একটি প্রবন্ধ ছাপানোয় পত্রিকার সব কপি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। যুবনেতা সামছুর (সামছুল হুদা প্রকাশ টুকটাক হুদা) সম্পাদনায় অপর একটি পত্রিকাও ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল বলে তিনি জানান। টুকটাক হুদা সম্পাদিত পত্রিকাটির নাম জানা যায়নি।
ভাষা আন্দোলন চলাকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে যে কয়টি স্থানীয় ও আঞ্চলিক পত্রিকা ভূমিকা রেখেছে ‘সংগ্রাম’ তন্মধ্যে অন্যতম।
বদর উদ্দিন উমরের ‘পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ গ্রন্থমালার দ্বিতীয় খন্ডের পঞ্চম পরিচ্ছদে ২১টি পত্রিকার নাম উল্লেখ করেন। এরমধ্যে ফেনীতে সংগ্রাম ও তালীম পত্রিকার উল্লেখ রয়েছে। যদিও সংগ্রাম পত্রিকার ঠিকানা দেয়া হয়েছে নারায়ণগঞ্জ। এটি টাইপিং মিস্টেক হবার সম্ভাবনাই বেশি। কারন একই নামে দ্বিতীয় পত্রিকা অনুমোদনের বিধান কখনোই ছিল না।
ফেনীতে ভাষা আন্দোলনে তালীম পত্রিকাটির ভূমিকার কথা বদর উদ্দিন উমর নওবেলাল নামে একটি ডাকসাইটে পত্রিকার সংবাদ সূত্রে নিশ্চিত করেন। এতে ধারণা করা যেতে পারে, টুকটাক হুদা হয়ত এ পত্রিকাটির মাধ্যমে ফেনীতে ভাষা আন্দোলনের খবর প্রচার করে থাকতে পারেন।
তবে এক সাক্ষাতকারে ভাষা আন্দোলনে তালীম পত্রিকার বিরোধী মনোভাবের সমালোচনা করেছিলেন মরহুম শিক্ষাবিদ কামাল হাসান চৌধুরী। তাই এ তথ্য নিশ্চিত নয়, টুকটাক হুদা কোন্ পত্রিকায় ভাষা আন্দোলন নিয়ে কাজ করেছেন।
সংগ্রাম বীরদর্পে ভাষা আন্দোলনের খবর খুব বেশিদিন ছাপতে পারেনি। এরই মধ্যে নেমে আসে নিষিদ্ধের খড়গ। ১৯৫০ সালে আন্দোলনে নেতৃত্বের অপরাধে গ্রেফতার হন খাজা আহাম্মদ। বদর উদ্দিন তাঁর একই গ্রন্থের একই পরিচ্ছদে উল্লেখ করেন, ১৯৫০ সালের অক্টোবর মাসের শেষের দিকে ফেনী থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক সংগ্রাম পত্রিকার সম্পাদক খাজা আহাম্মদকে (ভুলে ফয়েজ আহমেদ লেখা হয়েছে) জননিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়। এই গ্রেফতারের প্রতিবাদে ২রা নভেম্বর নওবেলাল ‘দুর্ভাগা সাংবাদিক’ নামে একটি দীর্ঘ ও কঠোর সমালোচনামূলক সম্পাদকীয় প্রকাশ করে।
গ্রন্থে উল্লেখিত সম্পাদকীয়তে লেখা হয়, সরকারের হাতে ‘আইন’- সাংবাদিকের হাতে ‘জনমত’ এই দুইটির পরস্পর বিরোধী শক্তি পরীক্ষা চলিয়াছে- সত্যিকারের জনমতকে ব্যক্ত করিবার অধিকার সাংবাদিকের নাই।…ডানে আমাদের শত্রু- বামে আমাদের শত্রু- তারই মধ্যে সংগ্রাম সম্পাদক একটি বলি মাত্র।…
নওবেলাল মহান ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে প্রগতিশীল ধারার একটি শক্তিশালী গণমাধ্যম হিসেবে কাজ করেছে বলে লেখক গ্রন্থের একাধিক স্থানে উল্লেখ করেছেন।
মরহুম কামাল হাসান চৌধুরী তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, সংগ্রামে প্রকাশিত খবর সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা যোগাত। আমরা ধলিয়া স্কুলে কাগজটি সবাই মিলে পড়তাম। বিভিন্ন মসজিদ মক্তবে খবরগুলো দেখাতাম। কারন একটি মহল মানুষকে বোঝাতো, বাংলা বিধর্মীদের ভাষা।
তিনি জানিয়েছিলেন, নুরুল হক নামে একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নিয়মিত সোনাগাজী এসে বিভিন্ন পত্রিকার কপি সরবরাহ করতেন। তাঁর সাথে আরও কয়েকজন একসাথে এসে স্কুলে মাদ্রাসায় পত্রিকার কপি দিতেন। ইত্তেফাক, নওবেলাল পত্রিকাগুলো তখন থেকে আমাদের কাছে বেশ পরিচিত ছিল।
বাসস/এনডি/এসপিএল/সংবাদদাতা/০৯৩৮/কেজিএ